একনজরে আদাবর-শ্যামলী
আদাবর-শ্যামলী সম্পর্কে
যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সাশ্রয়ী, তা-ই তো শহুরে মধ্যবিত্তের প্রথম পছন্দ। আদাবর-শ্যামলী এ দুটো চাহিদাই চমৎকারভাবে পূরণ করে বলেই মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের সাথে এলাকাটি দারুণ মানানসই। সুপরিকল্পিত এ এলাকায় একদিকে বাড়ি ভাড়া তুলনামূলক সাশ্রয়ী, অন্যদিকে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এখান থেকে ঢাকার যেকোনো প্রান্তে আসা-যাওয়া করা যায় বেশ সহজেই। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে প্রচুর রেসিডেনসিয়াল-কমার্শিয়াল অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে উঠেছে আদাবর-শ্যামলীতে। ফলে অনেকে এখানে খোঁজেন ছায়াঘেরা শান্তির নীড়, আবার বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবেও এর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।
বাড়ন্ত কমার্শিয়াল প্রপার্টির চাহিদা
আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রপার্টির সংমিশ্রণ আদাবর-শ্যামলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে প্রপার্টি ভাড়া নেয়া যায় ও কেনা যায় বলে এলাকাটির কমার্শিয়াল স্পেসগুলো স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠানের কাছে ইদানিং ভীষণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ এলাকায় অফিস স্পেস ভাড়া নিয়েছে ও কিনেছে বেশ অনেকগুলো আইটি ফার্ম, মার্কেটিং এজেন্সি, এনজিও। এছাড়া ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে শুরু করে কনভেনশন হল, শপিং মল সবই রয়েছে এখানে। মিরপুর সড়কের দুপাশে রয়েছে অনেকগুলো নামকরা ব্যাংকের শাখা ও এটিএম বুথ।হোয়াইট প্যালেস কনভেনশন সেন্টার, সূচনা কনভেনশন সেন্টারে নিয়মিত আয়োজিত হয় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ রয়েছে বলেই হয়তো ব্র্যাক, ওয়ার্ল্ড ভিশনসহ ১৫টি এনজিওর শাখা রয়েছে আদাবর-শ্যামলী এলাকায়।
আদাবর-শ্যামলী সম্পর্কে বিস্তারিত
আবাসিক এলাকা হিসাবে আদাবর-শ্যামলী
ঘনবসতি হলেও আদাবর-শ্যামলী বেশ পরিকল্পিত এলাকা। বেশ কিছু হাউজিং সোসাইটি থাকায় এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ ভালো। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল সবই এখান থেকে কাছে বলে পরিবারসহ বসবাসের জন্য অনেকেই এ এলাকা বেছে নিতে ইচ্ছুক। এ এলাকার বাসিন্দাদের বয়স-শ্রেণী-পেশা-ধর্মে প্রচুর বৈচিত্র্যও রয়েছে। তাই তাদের নানা চাহিদার কথা চিন্তা করেই এখানে গড়ে উঠেছে ধর্মীয় উপাসনালয়, পার্ক, বিনোদনকেন্দ্রসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা। শহরের প্রায় প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হলেও আদাবর-শ্যামলীতে ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতো তেমন আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা যায় না, বরং এ এলাকার বেশ কিছু অংশে এখনো পাড়া-মহল্লার চিরন্তন আন্তরিকতা ও সৌহার্দের দেখা মেলে।
আদাবর-শ্যামলীতে প্রপার্টি
আদাবর-শ্যামলী এলাকায় ভাড়া নেয়ার জন্য এবং কেনার জন্য প্রচুর প্রপার্টি রয়েছে। এদের মূল্যমান ধানমন্ডি বা নিকটবর্তী এলাকাগুলোর তুলনায় কিছুটা সাশ্রয়ী। তাই মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের মাঝেই এগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া আয়তনের দিক দিয়েও এ এলাকার প্রপার্টিগুলোয় বেশ বৈচিত্র রয়েছে। ফলে ছোট পরিবারের জন্য যেমন এখানে সাশ্রয়ী দামে বাড়ি কেনা যায় বা ভাড়া নেয়া যায়, তেমনি বড় পরিবারগুলোও সহজেই ঠিকানা খুঁজে নিতে পারে এখানে। তবে এ কথা মানতেই হবে যে, স্কুল-কলেজ কাছাকাছি হওয়ায় ও ঢাকার যেকোনো প্রান্তে সহজে যাতায়াত করা যায় বলে পরিবারসহ বসবাসের জন্য আদর্শ এলাকা হিসেবে ধরা হচ্ছে আদাবর-শ্যামলীকে। এ এলাকায় এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে যেগুলোর অভিভাবকেরা নিয়মিত আজিমপুর-মিরপুর-উত্তরায় স্বাচ্ছন্দ্যে অফিস করছেন এবং বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য আদাবর-শ্যামলীর নিকটবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেছে নিয়েছেন।
সেইসাথে যোগ হয়েছে এ এলাকার কমার্শিয়াল স্পেসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা। যাতায়াত ব্যবস্থা ও অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যের কারণে স্টার্ট আপ সহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আদাবর-শ্যামলী দারুণ এক এলাকা। আর সে কথাটি সঠিক প্রমাণ করতেই এ এলাকার প্রধান সড়ক মিরপুর রোডের দুপাশে ও ভেতরের রাস্তাগুলোতে গড়ে উঠেছে নামী ব্যাংকগুলোর শাখা, এনজিওর অফিস, কনভেনশন সেন্টার ইত্যাদি।
যাতায়াত ব্যবস্থা
যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার কথা চিন্তা করলে আদাবর-শ্যামলীর জুড়ি মেলা ভার। টোকিও স্কয়ারের সামনের বাস স্টপ থেকে যে বাসগুলো ছাড়ে, সেগুলো দিয়ে নিউ মার্কেট, আজিমপুর বা পুরান ঢাকায় আসা-যাওয়া করা যায়। আবার উত্তর ঢাকার সাথেও এলাকাটি ভালোভাবে সংযুক্ত কারণ শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলো দিয়ে মিরপুর, উত্তরায় যাতায়াত করা সুবিধাজনক। তবে বর্তমানে আবাসন, বিনোদন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা ধানমন্ডির সাথে আদাবর-শ্যামলীর যাতায়াত ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো। চাইলেই রিকশায় ধানমন্ডি চলে যাওয়া ভীষণ সহজ। সেইসাথে মোহাম্মাদপুর বা এলাকার ভেতরে যেকোন জায়গায় চলাচলের জন্যও আছে পর্যাপ্ত রিকশা। সেইসাথে উবার, পাঠাও এর মত রাইড শেয়ারিং অপশনগুলো তো থাকছেই। তবে এ এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা আসলে মিরপুর রোডের।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
ঠিক আদাবর-শ্যামলীতে যে খুব নামকরা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে তা নয়। বরং বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, পলিটেকনিক ও মাদ্রাসার আধিক্যই এখানে বেশি। তবে এলাকাটির খুব কাছেই রয়েছে সেন্ট যোসেফ, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের মতো প্রসিদ্ধ কিছু স্কুল-কলেজ। আবার এখান থেকে ধানমন্ডির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছানোও বেশ সহজ।
চিকিৎসা সুবিধা
চিকিৎসা সুবিধার কথা বিবেচনা করলেও আদাবর-শ্যামলী বেশ উন্নত। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট হাসপাতালসহ বেশ কিছু নামকরা সরকারি হাসপাতাল এখানে রয়েছে। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, কেয়ার হাসপাতাল, ক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ অনেকগুলো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারও এ এলাকায় দেখা যায়। এছাড়া সোহরওয়ার্দি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালও এখান থেকে খুবই কাছে।
পার্ক ও বিনোদন
ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতো উঁচু অট্টালিকার হাহাকারে বন্দী নয় আদাবর-শ্যামলী। এখানে রয়েছে শ্যামলী ক্লাব খেলার মাঠ, চাঁদের হাট খেলার মাঠ সহ বেশ কিছু মাঠ। শুধু তাই নয়, এ এলাকার শ্যামলী শিশু পার্ক ও ঢাকা শিশু মেলা রাজধানীর অন্যতম প্রধান দুটো বিনোদনকেন্দ্র। এছাড়া শ্যামলী স্কয়ারের পাশেই অবস্থিত শ্যামলী সিনেমা হল এখন ঢাকার উন্নত মাল্টিপ্লেক্সগুলোর মধ্যে একটি। সাশ্রয়ী টিকেটমূল্য ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেপ্লেক্সের সুবিধা নিয়ে ইতিমধ্যেই সিনেমাপ্রেমীদের প্রশংসা কুড়িয়েছে হলটি।
জীবনযাপনের মান থেকে শুরু করে নাগরিক সুবিধার ব্যাপ্তি- যা’ই বলি না কেন, সবকিছু মিলিয়ে আদাবর-শ্যামলী মধ্যবিত্ত ঢাকাবাসীর কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় এক এলাকা।
ধর্মীয় উপাসনালয়
বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকের নিবাস আদাবর-শ্যামলী। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর সংখ্যা ও বৈচিত্র্যও সে কথাই বলে। পুরো এলাকাতেই অসংখ্য মসজিদ রয়েছে তবে শ্যামলী জামে মসজিদ সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ। এছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য রয়েছে জহুরি মহল্লার তপোবন মন্দির, চামেলি রোডে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দিরসহ আরো কিছু প্রার্থনালয়। এ এলাকায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও সংখ্যায় নেহায়েত কম নয় ও এখানকার প্রিসবাইটেরিয়ান চার্চ, এ সি কনট্রাক চার্চে নিয়মিত প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়।
আশপাশের এলাকা
আদাবর-শ্যামলী এলাকাটি উত্তর ঢাকার অংশ। ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটো ফাইন্যান্সিয়াল হাব ধানমন্ডি ও মোহাম্মাদপুরের খুব কাছে এর অবস্থান। মিরপুর রোড ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে কল্যাণপুর এলাকা পার করলেই পৌঁছানো যায় গাবতলী ও মিরপুরে, যে দুটো এলাকাই ঢাকার নাগরিক জীবনের জন্য বেশ গুরুত্ববহ। আবার মিরপুর রোড ধরে দক্ষিণে আসলে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, আজিমপুর এলাকায় পৌঁছানো সহজ। এ এলাকার পূর্ব দিকে আগারগাও-তালতলা আর পশ্চিমে মোহাম্মাদপুর ও সাভার জেলার কিছু অংশ।
আদাবর-শ্যামলীতে জীবনযাপন
খাবার এবং রেস্টুরেন্ট
ভোজনবিলাসীদের একদমই হতাশ করবে না আদাবর-শ্যামলী। শ্যামলী আর মোহাম্মাদপুরের ঠিক সীমানা অঞ্চলেই রয়েছে মোস্তাকিম ভ্যারাইটিজ কাবাব অ্যান্ড স্যুপ। সারা ঢাকায় এই ‘মোস্তাকিমের চাপ’, ‘মোস্তাকিমের কাবাব’ এর নামডাক রয়েছে। বর্তমানে প্রসিদ্ধ এ হোটেলটির পাশে আরো কিছু কাবাবের দোকান গড়ে উঠেছে। এ এলাকার আদি নিবাসী বিহারি জনগোষ্ঠীর রন্ধনশৈলীর স্বাদ পেতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনেকেই ছুটে আসেন এখানে। এছাড়া বিরিয়ানি-তেহারি বা দেশীয় খাবারের বেশ কিছু রেস্টুরেন্টও এখানে রয়েছে। ফাস্ট ফুডপ্রেমীদের জন্য এ এলাকার মূল আকর্ষণ হলো শ্যামলী স্কয়ারের ফুডকোর্ট। তুলনামূলক সাশ্রয়ী দামে মজাদার খাবার পরিবেশন করে ইতিমধ্যেই বেশ নাম কুড়িয়েছে ফুডকোর্টটি।
কেনাকাটা
আদাবর-শ্যামলী এলাকায় রয়েছে বেশ কিছু শপিং মল ও দেশী-বিদেশী ব্র্যান্ডের আউটলেট। শপিং মলগুলোর মধ্যে টোকিও স্কয়ার, শ্যামলী স্কয়ারের খ্যাতিই সবচেয়ে বেশী। তবে ইয়োলো, ইউনিকলো, ইনফিনিটির আউটলেটগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেও আদাবর-শ্যামলীর অধিবাসীদের অন্য এলাকায় যেতে হয় না। এখানে মীনা বাজার, স্বপ্ন, আগোরার মতো সুপারশপগুলোর আউটলেটের পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর কাঁচাবাজার ও স্থানীয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এছাড়া মোহাম্মাদপুর কৃষি মার্কেটও এ এলাকা থেকে খুব কাছেই।