মোহাম্মদপুর এলাকার বিস্তারিত
একনজরে মোহাম্মদপুর
ইতিহাস ও মর্যাদার সাথে মিল রেখে মোহাম্মদপুর অঞ্চলটি গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঢাকা নগরের একটি তাত্পর্যপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে। ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক অঞ্চল হিসেবে ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মোহাম্মদপুর। সর্বস্তরের মানুষের আবাস ছিল এ এলাকায় যা এখনও রয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের জন্য সর্বাধিক স্বাছন্দ্য এবং সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য মোহাম্মদপুর চমৎকারভাবে পরিকল্পিত ও সুসজ্জিত। ফলস্বরূপ, এটি ঢাকা শহরের হাতে গোনা কয়েকটি অঞ্চলের একটি যেটি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। যা এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। তাজমহল রোড, হুমায়ুন রোড অথবা বাবর রোডের মতো মোহাম্মদপুরের রাস্তাগুলির নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কেননা এগুলো প্রায় সবই বিখ্যাত মুগল ব্যক্তিত্বের নামে নামকৃত। এমন চমৎকার রাস্তার নাম খুব কমই দেখতে পাওয়া যায় এর পাশাপাশি মোহাম্মদপুরে রয়েছে বেশ কয়েকটি নামকরা স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা এবং ঐতিহাসিক স্থান। এসব কিছুর জন্যই এলাকা হিসেবে মোহাম্মদপুর, বাসিন্দা ও বাইরে থেকে আগত সকলের কাছেই একটি আকাঙ্ক্ষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত।
মোহাম্মদপুর এলাকা সম্পর্কে
আবাসিক এলাকা হিসাবে মোহাম্মদপুর
মোহাম্মদপুর অঞ্চলটি মধ্য আয়ের পরিবারগুলির পাশাপাশি উচ্চ-মধ্য আয়ের পরিবারের জন্যো আদর্শ স্থান হয়ে উঠেছে। ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল হিসাবে, এখানে অনেক প্রজন্মের বাসিন্দা এবং স্থাপনার সন্ধান পাওয়া যায়। যদিও পুরানো অনেক ভবনই আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে রূপান্তরিত হয়েছে, তবে এলাকার জায়গায় জায়গায় এখনো বেশ কিছু স্থাপনা সেই পুরনো বৈশিষ্ট্যগুলির সগৌরবে বহন করে চলেছে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বন্ধনও বেশ দৃঢ়, উদাহরণস্বরূপ মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির কথা বলা যায়, সে সোসাইটির কল্যাণে এলাকার সবাই এক ছাদের নিচে একত্রিত হয়ে আছে। মোহাম্মদপুরে থাকার জায়গা হিসেবে যারা একটু বেশি সিকিউরড কিছু সন্ধান করেন তাদের জন্য আছে কিছু গেটেড কমিউনিট। সাম্প্রতিক সময়ে, মোহাম্মদপুর বর্ধিত হয়ে বসিলা এবং আশপাশের কয়েকটি অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে। এজন্যই সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের সন্ধানপ্রার্থী লোকেদের জন্য এলাকাটি সময়ের সাথে সাথে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে
মোহাম্মদপুরে প্রপার্টি
মোহাম্মদপুর সবসময়ই একটি ব্যস্ত এলাকা ছিল, তবে অ্যাপার্টমেন্ট-জীবনের উত্থান এই এলাকাকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে এই অঞ্চলের নগরীর জীবনের প্রতি। এ শতাব্দীর শুরু থেকেই বেশ কয়েকটি বড় আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের সূচনা ঘটে, ফলে মানুষ অ্যাপার্টমেন্ট-ঘরানার বাড়িতে বিনিয়োগ করতে শুরু। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের বৃহত্তম অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক জাপান গার্ডেন সিটি তৈরি হয়েছে এই মোহাম্মদপুরের বুকেই। বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি, কাদেরাবাদ হাউজিং, চান মিয়া হাউজিং - এদের প্রতিটিই চমৎকার আবাসন প্রকল এবং এগুলি মোহাম্মদপুরে বেশিরভাগ মানুষ যারা প্রপার্টি খুঁজছেন, তাঁদের গন্তব্য। এই অঞ্চলটিতে সম্প্রতি বাণিজ্যিক প্রপার্টিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সহজলভ্যতা, ধানমন্ডির সান্নিধ্যতা, বাকি শহরের সাথে চমৎকার যোগাযোগে ব্যবস্থা এবং তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী মূল্য বা ভারাই মূল কারণ যে জন্য মোহাম্মদপুর বিশেষ করে স্টার্টআপ বিজনেসের শুরু করেছেন এমন উদ্যোক্তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে মোহাম্মদপুর এখনও শহরের মধ্যে প্রধানতম আবাসিক এলাকা হিসেবেও তার সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছে।
যাতায়াত ব্যবস্থা
অবকাঠামোগত পরিকল্পনা এবং বিপুল সংখ্যক সরকারী ও ব্যক্তিগত যানবাহনের সহজলভ্যতার জন্য মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা রাস্তাঘাট ও পরিবহনের বিশাল এক নেটওয়ার্ক উপভোগ করেন সবসময়ই। মোহাম্মদপুর বাসস্টপ কয়েক ডজন ভিন্ন ভিন্ন রুটের পাবলিক বাসের স্টপেজ। এখান থেকে ঢাকা শহরের প্রায় সব দিকে ভ্রমণ করা সম্ভব। এর পাশাপাশি আছে ছোট যানবাহন এবং রিকশা যা মোহাম্মদপুরের অভ্যন্তরে দ্রুত পছন্দসই গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। বিশেষ করে তাজমহল রোডটি সারাদিন জুড়ে প্রচুর ট্র্যাফিকের চাপে ব্যস্ত থাকে, কারণ এটি এই অঞ্চলের মধ্যে একটি প্রধান সংযোগ সড়ক হিসেবে কাজ করে। আসাদগেট এলাকাটি একটি ঐতিহাসিক স্থান, যা জনসাধারণের চলাচলের জন্য একটি কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। মোহম্মাদপুরের বাসিন্দাদের আন্তঃনগর বাসে চড়তে খুব একটা বেগ পেতে হয় না কাছাকাছি গাবতলী বাস টার্মিনাল থাকায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
মোহাম্মদপুরে আছে ঢাকার কয়েকটি প্রাচীনতম এবং সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ স্কুল এবং কলেজ। এলাকার বাসিন্দাদের সর্বপ্রথম চেষ্টাই থাকে বাচ্চাদেরকে সুশিক্ষাইয় সিক্ষিত করার জন্য মোহাম্মদপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর সরকারী কলেজ, সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার। এছাড়া এই এলাকায় বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা বা ধর্মীয় স্কুল এবং বিশেষ যত্ন প্রয়োজন এমন শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক কেন্দ্রও রয়েছে। মোহাম্মদপুর এলাকায় সর্বত্র এমন গুণগত মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমারোহ থাকায় শিশুদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে বাসিন্দাদের তেমন একটা ভাবতে হয় না।
চিকিৎসা সুবিধা
যদিও বেশিরভাগ আবাসিক এলাকা তারপরেও মোহাম্মদপুর অঞ্চলে বেশ কয়েকটি চমৎকার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। এই চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলি সাধারণ ও বিশেষায়িত সেবার পাশাপাশি মানসিক পরিস্থিতি এবং প্রজনন সম্পর্কিত সমস্যার সাধারণ চিকিৎসা দিতে পারে। বিভিন্ন চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, কেয়ার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা জেনারেল ও অর্থোপেডিক হাসপাতাল এবং ট্রমা সেন্টারের স্বাস্থ্যসেবার মান শীর্ষ সারিতে রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে আল-মারকাজুল ইসলামী হাসপাতালও জনপ্রিয়। ইসলামী পদ্ধতি অনুসরণ করে মত্যু ব্যক্তিদের গোসল ও অন্যান্য প্রক্রিয়া অনুসরনের জন্য হাসপাতালটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এছাড়াও ধানমন্ডি এলাকার সান্নিধ্যে হওয়ায় যে কোন প্রয়োজনে ধানমন্ডির সমস্ত হাসপাতাল এবং চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সহজেই গমন করতে পারেন মোহাম্মদপুরবাসী।
মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনালয়
জনপ্রিয় সাত মসজিদ রোডটি ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থিত হলেও এটি মোহাম্মদপুরের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিখ্যাত সাত গম্বুজ মসজিদটি মোহাম্মদপুরেই অবস্থিত। মোগল স্থাপত্যশৈলীতে ১৭ শতাব্দীতে শায়েস্তা খান কর্তৃক নির্মিত এই মসজিদটিতে আজও প্রতি ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয় । এলাকায় মসজিদগুলির পাশাপাশি মোহাম্মদপুরের আশেপাশে বেশ কয়েকটি মন্দিরও রয়েছে। আর আশেপাশের জায়গাগুলিতে আরও কয়েকটি উল্লেখ করার মত মন্দির আছে। তাই মোহম্মদপুরের ধার্মিক বাসিন্দাদের জন্য একটি চমৎকার জায়গা হতে পারে, কারণ প্রার্থনার প্রয়োজনে কাউকেই খুব বেশি ভ্রমণ করতে হবে না।
ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ
যদিও সাত গম্বুজ মসজিদটি মোহাম্মদপুরের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক স্থান, তবে এই এলাকায় এটিই একমাত্র ঐতিহাসিক স্থান নয়। আমাদের জাতির জন্মলগ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটেছিল মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারে, যেখানে শহীদ হয়েছিলেন দেশের সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীরা। সেই ভয়াবহ ঘটনার জায়গাটিতে এখন শহীদদের স্মরণে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ দাঁড়িয়ে আছে। মোহাম্মদপুরের মধ্যে আরেকটি ঐতিহাসিক স্থান জেনেভা ক্যাম্প যা আমাদেরকে এখনো মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানেই উর্দুভাষী মুসলমান বা ‘বিহারি’ জনগোষ্ঠী মানুষজন একাত্তরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে বসবাস করে আসছে।
আশপাশের এলাকা
মোহাম্মদপুরের উত্তর ও দক্ষিণে আছে লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, শ্যামলী এবং আদাবর, আর পূর্ব দিকে রয়েছে শের-ই-বাংলা নগর। সবগুলি এলাকাই ঢাকার প্রধানতম লোকেশন এবং এই এলাকাগুলোতে জাতীয় সংসদে ভবনের পাশাপাশি কয়েকশ অফিস এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া মিরপুর ও ফার্মগেটও বেশ নিকটবর্তী এবং খুব সহজেই পৌঁছানো সম্ভব মাত্র আধঘন্টার মধ্যেই। আছে সদরঘাট-গাবতলী বাইপাস সড়ক, যার মাধ্যমে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা প্রয়োজনে দ্রুত পুরান ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে উভয় স্থানেই ভ্রমণ করতে পারেন।
মোহাম্মদপুরে জীবনযাপন
খাবার এবং রেস্টুরেন্ট
মোস্তাকিমের চাপ, বোবার বিরিয়ানি এবং এরকম আরও কয়েক ডজন কাবাব ও বিরিয়ানি দোকানগুলি মোহাম্মদপুর এলাকাকে করে তোলে ভোজনরসিকদের স্বর্গ। সারা শহর থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসে মোহাম্মদপুরে শুধু এসব খাবারের আকর্ষণে। বিহারি ক্যাম্পের মধ্যে এই বিখ্যাত খাবারের দোকানগুলির অনেককেই পাওয়া যায়। তবে পুরো মোহাম্মদপুর জুড়েই আরও অনেক দুর্দান্ত খাবার রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেখানে করা যেতে পারে ভোজনবিলাশ। এসব জায়গায় প্রচলিত কাবাব থেকে শুরু করে আন্তঃমহাদেশীয় এবং প্রাচ্যের খাবার পর্যন্ত সমস্ত ধরণের খাবার পাওয়া যায়। মোহাম্মদপুর এলাকার খাবারের দৃশ্য সবসময়ই আনন্দদায়ক সেখানে থাকা খাবারের বৈচিত্র্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের জন্য।
শপিংএর গন্তব্য
যদিও মোহাম্মদপুর অঞ্চলে শপিংয়ের গন্তব্যের প্রাচুর্য নেই, তবে টোকিও স্কয়ার শপিং মল সমস্ত বড় বড় শপিং সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তার কেন্দ্র হিসেবে অবস্থান করছে। এখানে বসে সব ধরণের ব্র্যান্ডের দোকানের সমারোহ। এই আধুনিক এবং চমৎকার শপিং মলে সমস্ত প্রকারের প্রয়োজনীয় আইটেম পাওয়া যায় যা একজন ক্রেতার দরকারী চাহিদা মেটাতে সক্ষম। প্রতিদিনের চাহিদা এবং পাইকারী বা খুচরা কেনাকাটার জন্য মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট সকলের কাছে প্রিয় গন্তব্য। এ বাজারে প্রতিদিনের তাজা পণ্য এবং সব ধরণের মাংস বিক্রি হয়। তবে যখন ছোট আকারের কোন শপিংয়ের কথা আসে তখন মোহাম্মদপুরে ছোট ছোট স্টোর এবং আউটলেটের পরিমাণ তুলনামূলক কম।