একনজরে লালমাটিয়া
লালমাটিয়া সম্পর্কে
ইট-কাঠ আর কোলাহলের এ শহরে ছায়াঘেরা শান্তির নীড় খুঁজে বেড়াই আমরা অনেকেই। আর তেমন শান্ত-নিরিবিলি ঠিকানা বাস্তবে খুঁজে পেতে চাইলে লালমাটিয়ায় এলাকায় একবার ঘুরে আসতে পারেন। নগরবাসীর এক অন্যতম প্রধান চাহিদা হলো উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা কর্মস্থলে যেন সহজে যাতায়াত করা যায় এমনটাই তাদের চাওয়া। ভীষণ সুপরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা লালমাটিয়া এলাকায় প্রশান্তির পাশাপাশি আপনি পাবেন যাতায়াতের সুব্যবস্থাও। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে প্রচুর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ও রেসিডেনসিয়াল-কমার্শিয়াল অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে উঠেছে এখানে। তবে পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল স্পেস এ এলাকায় খুব বেশি দেখা যায় না বললেই চলে।
লালমাটিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত
আবাসিক এলাকা হিসেবে লালমাটিয়া
পঞ্চাশের দশকে আটটি ব্লকে ভাগ করে লালমাটিয়া এলাকার গোড়াপত্তন ঘটে। ঢাকার আবাসন ব্যবস্থা উন্নয়নের উদ্দেশ্যেই এমনটি করা হয়। এখনো লালমাটিয়া শান্ত-নিরিবিলি এক আবাসিক এলাকা হিসেবেই সুপরিচিত। লালমাটিয়ার রাস্তা ধরে এগোলে নিয়মিত বিরতিতে চোখে পড়ে সবুজে ছাওয়া, প্রশস্ত ব্যালকনির পুরোনো কিছু বাড়ি। আবার রিয়েল এস্টেট বিল্ডার্সের হোল্ডিংও কম নেই এ এলাকায়, অর্থাৎ নগরায়নের ছোঁয়াও এ এলাকায় বেশ ভালো ভাবেই লেগেছে। নতুন গড়ে ওঠা উঁচু দালানকোঠা আর লাল ইটের পুরোনো দু-তিনতলা বাড়ি- সবই রয়েছে এ এলাকায়। লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি ছাড়াও এখানে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত সপ্তনীড় অফিসার্স অ্যাপার্টমেন্ট। আর পার্শ্ববর্তী এলাকা ধানমন্ডির সাথে তুলনা করলে লালমাটিয়ায় বাসা ভাড়া বেশ সাশ্রয়ী মনে হবে। আর এ এলাকায় সাধারণত ২ বেডরুম থেকে ৪ বেডরুমের ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়। ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহীদের জন্য লালমাটিয়ায় সাধারণত ৬০০ বর্গফুট থেকে ২০০০ বর্গফুট এর বিভিন্ন ফ্ল্যাট এর ব্যবস্থা আছে। এছাড়া কিছু রেসিডেনসিয়াল-কমার্শিয়াল অ্যাপার্টমেন্টও পাবেন এখানে। স্টার্ট আপ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেই এ অ্যাপার্টমেন্ট গুলোর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি।
লালমাটিয়ায় প্রপার্টি
লালমাটিয়ায় ভাড়া নেয়ার জন্য এবং কেনার জন্য প্রচুর রেসিডেনশিয়াল প্রপার্টি রয়েছে। মূল্যমান বিবেচনায় বলা যায়, উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের মাঝেই এগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া আয়তনেও এ এলাকার প্রপার্টিগুলোতে বেশ বৈচিত্রের দেখা মেলে। তাই দুজনের জন্য যেমন এ এলাকায় ছোট্ট নীড় খুঁজে পাওয়া সম্ভব তেমনি বড় পরিবারের অধিবাসীরাও এখানে পাবেন মানানসই বাসস্থান। তবে নিরাপদ এলাকা হওয়ায় ও ঢাকার যেকোনো প্রান্তে সহজে যাতায়াত করা যায় বলে পরিবারসহ বসবাসের জন্য আদর্শ এলাকা হিসেবে নামডাক আছে লালমাটিয়ার। পাশেই শের-এ-বাংলা নগরের সরকারি অফিসগুলোতে কর্মরত অনেকেই এ এলাকার সরকারি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। সেইসাথে যোগ হয়েছে হোস্টেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা। লালমাটিয়া মহিলা কলেজ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের নিবাস হিসেবেও এলাকাটি এখন দারুণ জনপ্রিয়। আর সে কথাটি সঠিক প্রমাণ করতেই এ এলাকার বিভিন্ন ব্লকে গড়ে উঠেছে নিবেদিকা ছাত্রী হোস্টেল, ড্যাব ছাত্রী হোস্টেল সহ বেশ কিছু হোস্টেল।
যাতায়াত ব্যবস্থা
যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার কথা চিন্তা করলে লালমাটিয়ার জুড়ি মেলা ভার। মিরপুর রোডে যে বাসগুলো চলাচল করে সেগুলো মূলত উত্তরে গুলিস্তান, উত্তরা, মিরপুর থেকে শুরু করে দক্ষিণে আজিমপুর, নিউমার্কেট পর্যন্ত যায়। আর এ বাসগুলোতে উঠতে চাইলে লালমাটিয়াবাসীর জন্য সুবিধাজনক তিনটি পয়েন্ট হলো লালমাটিয়া আড়ংয়ের সামনের মানিকমিয়া এভিনিউ বাস স্টপেজ, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড আর ধানমন্ডি ২৭ এর রাপা প্লাজার স্টপেজ। বর্তমানে আবাসন, বিনোদন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা ধানমন্ডির সাথে লালমাটিয়া যাতায়াত ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো। চাইলেই রিকশায় বা হেঁটে ধানমন্ডি চলে যাওয়া ভীষণ সহজ। সেইসাথে মোহাম্মদপুর বা এলাকার ভেতরে যেকোন জায়গায় চলাচলের জন্যও আছে পর্যাপ্ত রিকশা। সিএনজি এবং উবার, পাঠাও এর মত রাইড শেয়ারিং অপশনগুলো তো থাকছেই। এ এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা আসলে মিরপুর রোড, আসাদ এভিনিউ, সাত মসজিদ রোড এবং ধানমন্ডি ২৭ নাম্বারের মূল সড়কটির।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
সরকারি স্কুলগুলোর মধ্যে লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল, লালমাটিয়া প্রাইমারি স্কুল প্রসিদ্ধ। এছাড়া অ্যাকাডেমিয়া, ম্যানগ্রোভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, পেনফিল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলসহ বেশ কিছু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলও এ এলাকায় রয়েছে। এদের মধ্যে ধানমন্ডি ও লালমাটিয়ার সীমানাবর্তী এলাকায় অবস্থিত অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল সবচেয়ে বিখ্যাত। লালমাটিয়ার আরো একটি প্রখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো লালমাটিয়া মহিলা কলেজ। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রাচীন এ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থাও রয়েছে। পাশাপাশি ন্যাশনাল কলেজ অফ হোম ইকোনমিক্স, শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটিও লালমাটিয়া এলাকায়ই অবস্থিত। তবে এ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ছাড়াও এ এলাকা থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা আসাদ এভিনিউয়ের সেন্ট জোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল, মোহাম্মদপুরের রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ ও ধানমন্ডিস্থ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করে।
চিকিৎসা সুবিধা
লালমাটিয়ার চিকিৎসা সুবিধা বেশ উন্নত ও আধুনিক। ইউরো বাংলা হার্ট হসপিটাল, মিলেনিয়াম হার্ট অ্যান্ড জেনারেল হসপিটাল, সিটি হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আল মানার হসপিটাল দীর্ঘদিন ধরেই লালমাটিয়া ও আশেপাশের এলাকার মানুষদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য ঢাকা শিশু-নবজাতক ও জেনারেল হাসপাতাল এবং মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য ‘মনোচিকিৎসালয়’ - ও রয়েছে। ধানমন্ডিস্থ বাংলাদেশ আই হসপিটাল, ঢাকা ক্যান্সার অ্যান্ড জেনারেল হসপিটাল, ল্যাবএইড, ইবনে সিনা এবং শেরে বাংলা নগরীর সোহরাওয়ার্দি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এখান থেকে খুবই কাছে।
পার্ক ও বিনোদন
আগেই বলেছি, ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতো ইট-কাঠ-পাথরে ঘেরা নয় লালমাটিয়া। সবুজের প্রশান্তি মিলবে এখানে। শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার কথা মাথায় রেখে এখানে গড়ে উঠেছে জাকির হোসেন রোড খেলার মাঠ, ব্লক ডি খেলার মাঠ, মোহাম্মদপুর-লালমাটিয়ার সীমানাবর্তী মোহাম্মদপুর পার্ক। সকালে-বিকালে শিশু-কিশোরদের কলরবে যেমন মুখর হয় এ মাঠগুলো, তেমনি স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের প্রাতঃভ্রমণও এখানকার নিয়মিত চিত্র। সেইসাথে যোগ হয়েছে আরো দুটো ভিন্নধর্মী বিনোদনকেন্দ্র। একটি হলো দ্বীপ গ্যালারি, নতুন এ গ্যালারিতে আয়োজিত হয় নানা প্রদর্শনী। আর আরেকটি হলো আপসাইড ডাউন নামের একটি ইলিউশনাল আর্ট গ্যালারি। উল্টো জগতের অদ্ভূত দর্শন মিলবে এখানে। এছাড়া লালমাটিয়া-ধানমন্ডির সীমানা যেখানে মিশেছে সেখানেই অবস্থিত ঢাকার জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম এক স্থান, বেঙ্গল বই। বইপড়ুয়া আর নান্দনিক শিল্পের ভক্তেরা নিত্যই ভিড় জমায় বেঙ্গলের আঙ্গিনায়।
ধর্মীয় উপাসনালয়
লালমাটিয়া এলাকায় বেশ অনেকগুলো মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে লালমাটিয়া জামে মসজিদ, মিনার মসজিদ, বাইতুল হারাম জামে মসজিদ, ঢাকা ওয়াসা জামে মসজিদ ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।
আশেপাশের এলাকা
লালমাটিয়া এলাকাটি উত্তর ঢাকার অংশ। ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটো ফাইন্যান্সিয়াল হাব ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের খুব কাছে এর অবস্থান। এ এলাকার উত্তরে আসাদ এভিনিউ পেরোলেই মিলবে মোহাম্মদপুর, আদাবর-শ্যামলী। আর দক্ষিণে ধানমন্ডি ২৭ এর মেইন রোড দিয়ে এলাকাটি ধানমন্ডির সাথে সংযুক্ত। পূর্বদিকের মিরপুর রোড ধরে এগোলে ফার্মগেট, সংসদ ভবন এলাকায় পৌঁছানো সহজ। আবার পশ্চিমে রয়েছে সাত মসজিদ রোড দিয়ে সংযুক্ত শংকর ও ধানমন্ডি এলাকা।
বাসাবোর জীবনযাপন
খাবার ও রেস্টুরেন্ট
দেশী-বিদেশী সব ধরনের খাবারই লালমাটিয়ায় পাবেন। দেশী খাবারের জন্য রয়েছে কুটুমবাড়ি, স্বাদ তেহারী ঘর, আমজাদ হোটেল ও রেস্টুরেন্ট সহ বেশ কিছু ছোট-বড় রেস্টুরেন্ট। আর বিদেশী খাবারের ভক্ত যারা, তাদের জন্য রয়েছে পিজ্জা ও সীফুডের জন্য প্রসিদ্ধ টিবিসি, ফাস্টফুড জয়েন্ট হিসেবে খ্যাত ভূতের বাড়ি, সেভেনথ হেভেনসহ বেশ কিছু রেস্তোরাঁ। এছাড়া ধানমন্ডি ও লালমাটিয়ার সীমানা যেখানে এসে মিশেছে ঠিক সেখানেই রয়েছে তরুণদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় কফিশপ ক্রিমসন কাপ। এ এলাকা থেকে ধানমন্ডিস্থ অন্যান্য রেস্তোরাঁ গুলোতেও সহজেই যাওয়া যায়।
কেনাকাটা
লালমাটিয়া মূলত আবাসিক এলাকা হওয়ায় শপিং মলের জাঁকজমক এখানে তেমন একটা দেখা যায় না। এস এ ওয়ার্ল্ড নামের একটি শপিং সেন্টার এখানে সদ্য খোলা হয়েছে। আর লালমাটিয়ার শেষ সীমায় রয়েছে আড়ং এর একটি আউটলেট। তবে ধানমন্ডি ২৭ সড়কের দুপাশে অবস্থিত রাপা প্লাজা, জেনেটিক প্লাজা এবং টেক্সমার্ট, অ্যাস্টরিয়ন, অরণ্য ইত্যাদি ব্র্যান্ডের আউটলেটগুলো লালমাটিয়ার খুবই কাছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেও লালমাটিয়াবাসীর অন্য এলাকায় যেতে হয় না। প্রচুর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর রয়েছে প্রতিটি ব্লকে। সেইসাথে এখানে নিয়মিত দেখা যায় ভ্যানে করে শাকসবজি ও মাছ বিক্রির দৃশ্য। মীনা বাজার, স্বপ্ন, আগোরার মতো সুপারশপগুলোর আউটলেট ধানমন্ডি ২৭ এর মূল সড়কটিতেই রয়েছে বলে অনেকে সেখান থেকেও নিত্যদিনের বাজার সেরে নেন। কাঁচাবাজার ঘুরে যারা বাজার করতে পছন্দ করেন তাদের জন্য স্বস্তির ব্যাপার হলো যে, মোহাম্মাদপুর টাউনহল বাজার এ এলাকা থেকে অত্যন্ত কাছে।