Reading Time: 6 minutes

পাহাড়, ঝর্ণা আর সবুজের প্রাচুর্যে প্রকৃতি পরম যত্নে সাজিয়েছে সিলেট জেলাকে। সবুজে মোড়া চাবাগান, পাহাড়ের কোলঘেঁষে পাথুরে নদী, গহীন অরণ্যের নেশা —কী নেই এখানে! বাংলাদেশের চা শিল্প ও পর্যটন শিল্পেও এ জেলার অবদান অনেক। সিলেটের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের আজকের ব্লগ। আমার প্রিয় জেলা সিরিজের আগের পর্বগুলোতে পড়তে পারেন ঢাকা, রাজশাহীখুলনার প্রিয় বিষয়গুলো সম্পর্ক। 

সিলেটের জীবনযাত্রা 

Monipuri making yarn

কোনো স্থানকে ভালোভাবে জানতে হলে, চিনতে হলে এর অধিবাসীদের আচার ব্যবহার, জীবনযাপন সম্পর্কে জানা অপরিহার্য। সিলেটবাসীর মধ্যে আরামদায়ক শৌখিনতা বেশ লক্ষণীয়। খেয়াল করলেই দেখবেন, এখানে দোকানে-রেস্তোরায় অহেতুক প্রতিযোগিতা নেই। কাকডাকা ভোরে দোকানের ঝাপি খোলার রীতি এখানে দেখা যায় না বললেই চলে, বরং দোকান খোলা হয় খানিকটা বেলা করেই। জল-পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা সিলেটের মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছে বলেই হয়তো সৃজনশীলতা, কোমলতার মতো গুণাবলি তাদের চরিত্রে দেখা যায়। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই এখানে নানা শ্রেণী-ধর্ম-পেশার মানুষ একত্রে বাস করে। সিলেটে; রয়েছে মণিপুরি, পাত্র, খাসিয়া, চাকমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল নৃ- গোষ্ঠীর মানুষও। ফলে এ এলাকার ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বেশ বৈচিত্রময় ও সমৃদ্ধ, যা নিঃসন্দেহে সিলেটের প্রিয় বিষয়গুলো এর মাঝে একটি। এ জেলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এখানকার মাজারগুলো। প্রসিদ্ধ এসব মাজার সিলেট জেলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

সিলেটকে প্রবাসী বহুল জনপদ বললে ভুল বলা হবে না। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিলেট বিভাগের মানুষের বসবাস রয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা এই বিভাগের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। তবে জীবিকা নির্বাহ এখানে আবর্তিত হয় মূলত দুটো বিষয়কে কেন্দ্র করে; আর সেগুলো হলো চা ও পর্যটন শিল্প। অনেকেই জড়িত রয়েছে পাথর, বালির ব্যবসার সাথে। এছাড়া সরকারী ব্যবস্থাপনায় এখানে দুটো শিল্প নগরীও গড়ে তোলা হয়েছে, যা এ জেলার অধিবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সিলেটিদের কথ্য ভাষা, প্রচলিত বাংলা ভাষা হতে বেশ আলাদা। পূর্বে এ জেলা আসাম রাজ্যের অন্তর্গত ছিলো বলে সিলেটের ভাষা ও সংস্কৃতিতে আসামের প্রভাব লক্ষণীয়। সিলেটের বৈচিত্র্যময় নিজস্ব ভাষা ‘নাগরী লিপি’ হিসেবে পরিচিত।  এ জেলার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত প্রাচীন এ লিপি। 

সিলেটের যাতায়াত  

ঢাকা থেকে সিলেট যাতায়াতের মাধ্যম তিনটি; বাস, ট্রেন ও বিমান। বাস ও ট্রেন বেশ উন্নত, মানসম্পন্ন এবং আধুনিক। বিমানবন্দরটি শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত হলেও সেখান থেকে শহরে যাওয়ার রাস্তাটি ভীষণ মনোরম। দুপাশে চা বাগান ঘেরা রাস্তাটি পর্যটকদের মন জুড়িয়ে দেয় শুরুতেই। সিলেট জেলার ভেতরের রাস্তাও আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো। শহরের ভেতরের রাস্তা তো বটেই, শহরের বাইরে দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাওয়া-আসার রাস্তাগুলোও বর্তমানে উন্নত। তবে ভোলাগঞ্জ, জাফলং প্রভৃতি স্থান থেকে যেহেতু ভারী ট্রাকে নিয়মিত পাথর, বালি ইত্যাদি পরিবহণ করা হয়, তাই এ রাস্তাগুলোকে নিয়মিতভাবে সংস্কার করতে হয়। সিলেট শহরে চলাচলের জন্য রয়েছে রিকশা ও সি এন জি চালিত অটোরিকশা। এছাড়া অন্যান্য জেলার তুলনায় এখানে সাইকেল যোগে যাতায়াতের রীতি বেশি প্রচলিত। তবে কোনো কোনো দর্শনীয় স্থানগুলোতে যেতে নৌকা, জিপগাড়ির প্রয়োজন হয়।    

সিলেটে যা যা দেখবেন  

Landscape of Jaflong

সিলেটের প্রিয় বিষয়গুলো এর কথা বলতে গেলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের পীঠস্থানগুলোর কথা না বললেই নয়! উত্তরে প্রকৃতি একে সাজিয়েছে জৈন্তিয়া পাহাড়ের সবুজে আর লালাখালের ফিরোজা নীলে। পাথুরে নদী আর পাহাড় মিলে সেখানে যেন রচিত হয়েছে নৈসর্গিক কাব্যগাথা। গোয়াইনঘাট উপজেলা পেরোলে পৌছানো যায় জাফলং,বিছানাকান্দি, জৈন্তাপুর ও লালাখাল সহ জনপ্রিয় এ পর্যটন স্পটগুলোতে।আছে রাতারগুল যা দেশের একমাত্র মিঠা পানির জলাবন, এখানে গড়ে তোলা হয়েছে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। জাফলং ও বিছানাকান্দির মূল আকর্ষণ পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলরাশি আর দূর পাহাড়ে মেঘের লুকোচুরি। জৈন্তাপুর নিজেই এক তিলোত্তমা নগরী, এখানে শতবর্ষের ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে আজও দাড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক জৈন্তিয়া রাজবাড়ি। ভারতের চেরাপুঞ্জি রাজ্যের পাদদেশে অবস্থিত লালাখাল জুড়ে রয়েছে গহীন অরণ্য, চাবাগান ও নদী। এর প্রতি বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে আছে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের উপহার। খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য এ এলাকার অনন্য বৈশিষ্ট্য। রয়েছে প্রাচীন পুরার্কীতি আর তৈল, গ্যাস, বালু, পাথর, চা ও তেজপাতা এবং জলমহাল। সিলেট জেলার এ অংশটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ঠিক শেষভাগে। আর তাই বেশ কিছু মনোরম প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সীমান্তরেখা। পান্থুমাই ঝর্ণার কথাই ধরা যাক। শত ফুট উঁচু যে পাহাড় থেকে ঝর্ণাটি নেমে এসেছে, সে পাহাড়টি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত। তবে বাংলাদেশের শেষ সীমায় অর্থাৎ পিয়াইন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে এ ঝর্ণার অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে যায় শত শত পর্যটক। 

সিলেটের দক্ষিণ অঞ্চলটি প্রকৃতপক্ষে মূল শহর। এখানে পর্যটকদের ভিড় মূলত মাজারকেন্দ্রিক। ৩৬০ আউলিয়ার পূণ্যভূমি হিসেবে খ্যাত সিলেটের মাজারগুলোর মধ্যে হযরত শাহজালাল (র) এর মাজার ও হযরত শাহ পরান (র) এর মাজার উল্লেখযোগ্য। তবে সিলেট শহরে এছাড়াও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে হাছন রাজা জাদুঘর, ওসমানী স্মৃতি জাদুঘর।

শহরের শেষ প্রান্তে রয়েছে বেশ কিছু সাজানো-গোছানো চাবাগান, যা সিলেটের প্রিয় বিষয়গুলো এর মধ্যে অন্যতম। এর মধ্যে মালনীছড়া চা বাগান সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ। উচু-নিচু টিলায় সবুজের সমারোহ নিয়ে গড়ে ওঠা এ চাবাগান উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও পুরাতন চা বাগান। চা এর পাশাপাশি বর্তমানে এখানে কমলা ও রাবারও চাষ করা হয়। 

সিলেটের খাবার-দাবার  

Satkara (Citrus_macroptera)

সিলেট অঞ্চলের রন্ধনশৈলী বেশ স্বতন্ত্র। সাতকড়া নামে এক ধরনের লেবু জাতীয় ফল মাছ ও মাংস রান্নায় ব্যবহার করে সিলেটবাসী। টক জাতীয় এ ফলের ব্যবহারে রান্নায় আলাদা এক স্বাদ যোগ হয়। সিলেটিদের মধ্যে আতপ চালের ভাত খাওয়ার রেওয়াজ দেখা যায়। অনেকে মিষ্টান্ন তৈরিতেও আঠালো এ ভাত ব্যবহার করেন। লাল-সাদা আঠালো চালের বিরইন ভাত সিলেট জেলার মানুষের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার। পোলাও বা বিরিয়ানি তৈরিতেও আলাদা ধরন প্রচলিত এ জেলায়, ঘি-মাংস-শাকসবজি দেয়া নিজস্ব ঘরানার রন্ধনরীতিতে তৈরি হয় ‘আখনি পোলাও’ ও ‘আখনি বিরিয়ানি’। ইতিহাসও এ জেলার মানুষের রান্নায় ও খাদ্যাভাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সুফি দরবেশদের আগমনের সাথে সাথে এ জেলার সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে মোগলাই, মধ্য-প্রাচীয়  এবং উত্তর ভারতীয় খাবার। মাজার যেহেতু এ জেলায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ তাই তুশা শিন্নি নামের হালুয়া জাতীয় খাবারও এখানে জনপ্রিয়। আবার খাসিয়া, মণিপুরী, কুকি প্রভৃতি নৃ-গোষ্ঠীর রন্ধনপ্রণালীও এ অঞ্চলের খাদ্যাভাসে প্রভাব ফেলেছে; বাঁশের অংকুর দিয়ে রান্না করা হাঁস-বাঁশ তেমনই একটি বহুল প্রচলিত খাবার। আগেই বলেছি, সিলেটবাসীর অনেকেই প্রবাসী। আর তাদের এক বড় অংশ প্রবাসের রেস্তোরাঁগুলোতে কাজ করেন। ফলে সিলেটের রন্ধন প্রণালী জায়গা করে নিয়েছে লন্ডন সহ পশ্চিমা বেশ কিছু দেশের রেস্তোরাঁয়। ইতিহাসবিদ লিজি কলিংহাম তাঁর বিখ্যাত বই ‘কারি: এ বায়োগ্রাফি’ তে জানিয়েছেন যে ব্রিটেনের খাদ্যাভাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে সিলেটি কারি জাতীয় রান্না।

বুঝতেই পারছেন, সিলেট জেলায় বেড়াতে গেলে খাদ্যরসিকরা একেবারেই হতাশ হবেন না। আর সিলেটের প্রিয় বিষয়গুলো এর তালিকায় এ খাবার গুলোর কথা আসবেই। জিন্দাবাজার এলাকায় রয়েছে পাঁচভাই, পানসী, পালকি প্রভৃতি রেস্টুরেন্ট। ভর্তা-ভাত আর মাছ-মাংসের অতুলনীয় স্বাদ আপনাকে মুগ্ধ করবেই! গভীর রাতেও ভীষণ জমজমাট থাকে এসব রেস্তোরাঁ। ইদানিং শহরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁও।

 

সিলেটের নদী 

Goyain river boats

সিলেটের প্রধান নদী সুরমা। মণিপুরের পাহাড় থেকে নেমে আসা এ খরস্রোতা নদীটি সিলেটের প্রিয় বিষয়গুলো এর একটি। বর্তমানে শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রবল প্রতিপত্তিতে অনেকটাই হারিয়ে গেছে এ নদী। তবে ইতিহাসে এর বর্ণনা পাওয়া যায় এখনো। অমরকোষ অভিধানে বর্ণিত ‘শরাবতী’ কে অনেকেই সিলেটের সুরমা হিসেবে জানেন। আরবী ইতিহাসেও ‘সিলহেট বন্দরের’ উল্লেখ পাওয়া যায়। মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা হযরত শাহজালাল (র:) এর সাথে দেখা করার জন্য সুরমা অববাহিকা ধরেই সিলেটে আসেন। সুরমার তীরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। এগুলোর মধ্যে আলী আমজাদের ঘড়ি ও ক্বীন ব্রিজ বিখ্যাত। পৃথ্বিমপাশার বিখ্যাত জমিদার আলী আমজাদের নির্দেশে তৈরি হয় প্রমাণ সাইজের এ ঘড়িটি। আর ক্বীন ব্রিজ ইতিহাসের আরেকটি নিদর্শন। তিরিশ দশকের দিকে আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল ক্বীনের আগমন উপলক্ষে ব্রিজটি নির্মিত হয়। ব্রিজটি এখন ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী না থাকলেও প্রতিদিন অজস্র মানুষ এ ব্রিজ দেখতে আসে, এখানে কাটায় ছুটির বিকেল। যেহেতু কোন মোটরচালিত যানবাহন এর উপর দিয়ে চলে না তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় পদচারী সেতু হিসেবেও এর নাম উচ্চারিত হচ্ছে।

চায়ের রাজ্য সিলেট  

Tea garden

সিলেটের অপর নাম ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র দেশ। দুই পাতা, এক কুঁড়ি দিয়ে মূলত চা পাতার বৈশিষ্ট্যই বোঝানো হয়েছে। কেননা সিলেট মানেই তো ঢেউ খেলানো ঘন সবুজে আচ্ছ্বাদিত সাজানো গোছানো চা-বাগান। ১৮৩৩ সালে ভারতবর্ষে প্রথমে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি চায়ের চাষ শুরু করে। আর ১৮৫০ সালে তৈরি করা হয় সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান। এর বছর চারেক পর দেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উত্পাদন শুরু হয় মালনীছড়ায়। সারাদেশের ১৬২টি চা-বাগানের মধ্যে সিলেটে চা-বাগানের সংখ্যা ১৩৮টি। 

বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল চা। কেননা দেশ থেকে সর্বোচ্চ রপ্তানিকৃত ফসলের মধ্যে পাটের পরেই চায়ের অবস্থান। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। গত বছর দেশে চা চাষের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। বছরের শুরুতে চা চাষের জন্য কিছুটা প্রতিকূল আবহাওয়া থাকলেও এমন রেকর্ড গড়া সম্ভব হয়েছে। সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার চা–শিল্পের জন্য এটি এক দারুণ সুখবর! 

সিলেটের প্রিয় বিষয়গুলো বলতে শুরু করলে আর শেষ হবে না। সিলেট মানে পাহাড়ি প্রকৃতি আর পাথুরে জলস্রোতের মিতালি। সিলেট মানে সবুজ আর নীলের অবারিত হাতছানি। ভাষা, খাদ্যাভাস, সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এ জেলাকে করে তুলেছে আরো মনোহর। 

Write A Comment