নারী আর অলঙ্কার এ যেন অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। অলঙ্কার শব্দটি একটু ভারী বলে সকলের মুখে বেশি শোনায় যে শব্দটি সেটি হল, “গহনা বা গয়না”। হাজার বছর ধরে, এই অলঙ্কার এবং নারী যেন একে অপরেরই পরিপূরক হয়ে বেঁচে আছে। বাঙালি নারীর রূপ নিয়ে কবিতা, গান উপন্যাসে উপমার যেন শেষ নেই। আর নারীর শোভা বর্ধনে যে , গহনার জুড়ি নেই। আজ এমনই এক গহনার গ্রাম ভাকুর্তা নিয়ে এসেছি আপনাদের জন্য। শোনাবো গহনার আদিগল্প।
যেভাবে যাবেন
কিভাবে যাবেন সেটা আগেই বলে দেই, কেননা যত ভাবনা যেন এই যাতায়াত নিয়েই। যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তাদের কোন ভাবনাই নেই। কিন্তু যাদের আসতে হবে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে তাদের জন্য যাতায়াত অবস্থা কেমন তা জানা জরুরী। খুব বেশি ঝামেলা নেই যাতায়াতে। গাড়ি বা বাসযোগে, ঢাকার গাবতলি থেকে আমিনবাজার পার হলেই, হাতের বাম দিকে একটি পুরাতন ব্রিজটি পার হয়ে সামনে এগুলে, তারপরই ভাকুর্তা- ‘গহনার গ্রাম’। এখানে পোঁছানো মাত্রই হাতুড়ির ঠুকঠাক শব্দ বেজে উঠবে তখনই বুঝে যেতে হবে আপনি চলে এসেছেন আপনার গন্তব্যে। বেশিরভাগ বাড়ির সামনে বারান্দায়, আগুনের ফুলকি উঁকি দিচ্ছে, চলছে গহনা তৈরির কাজ।
আদিকথা
ভাকুর্তার গল্প বেশ পুরনো। এখানকার কারিগররা প্রায় ৩০০ বছর ধরে গহনা তৈরি করে আসছে। নবাবী আমলের শেষের দিকে ও ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে অনেক কারিগর নাকি জীবন বাঁচানোর জন্য কলকাতা থেকে নানা জায়গায় চলে যায়। এরপর বেশ সময় পার হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমল শেষ হয়ে গেলে যখন বাংলাদেশের উৎপত্তি হয় তার ঠিক পরেই, ১৯৮০ সালের দিকে কারিগররা স্থায়ীভাবে তাঁতী বাজারে গহনা তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে স্বর্ণের চাহিদা পড়ে যাওয়ায় লোকসানে পড়তে হয় তাদের। কিন্তু, তারা থেমে থাকেনি রূপার গহনা তৈরির কাজ করতে থাকে। কিন্তু, ভাগ্যে যেন আরও খারাপ কিছু ছিল তাদের, রূপার বাজারেও পড়ে ভাটা। ২০১০ সালের সেই সময়ে রূপা ছেড়ে শুরু করতে হয় কপার ধাতুর গহনা। স্বর্ণ বা রূপার দাম চড়া থাকলেও, কপার সবসময়ই কম দামের। যার ফলে মানুষ কপারের গহনা সবসময়ই কিনতে পারে। এছাড়া ভাকুর্তা গ্রাম থেকে চুড়ির বেস, তাঁতিবাজার ও বাবুবাজার থেকে ছোট ছোট কাঁচামাল এনে গ্রাহকের মনমতো নকশা বানিয়ে স্বর্ণ বা রূপার রঙে গড়িয়ে নিলেই কাজ শেষ। তাই হয়তো ভাকুর্তার দোকানগুলোতে দেখা মেলে অনেক ধরনের গহনার।
ভাকুর্তা গ্রাম
ছেলে-বুড়ো, মা-মেয়ে-বউ সবাই ব্যস্ত গলার হার, হাতের চুড়ি, কানের দুল, ঝুমকা, চেন, পায়েল ও নূপুর তৈরিতে। রাস্তার পাশে, বাজারে বাজারে গড়ে উঠেছে গয়নার কারখানা ও দোকান। শিক্ষিতের হার এই গ্রামে বেশ কম দেখেই সবারই পেশা গহনা তৈরি করা। এখানের সবাই গহনা তৈরির পেশায় নিয়োজিত। এই পেশায় থেকে অনেকেই সংসারে ফিরে এনেছে সচ্ছলতা। এ ইউনিয়নের ২৭ গ্রামের ১২টিতেই ঘরে ঘরে তৈরি হয় গয়না। গয়না তৈরির গ্রামগুলো ভাকুর্তা, কান্দিভাকুর্তা, হিন্দুভাকুর্তা, মোগরাকান্দা, মুশুরিখোলা, ডোমরাকান্দা, বাহেরচর, ঝাউচর, লুটের চর, চুনার চর, চাপড়া ও চাইরা। এসব গ্রামের প্রায় ১০ হাজার লোক গয়না তৈরির কাজে যুক্ত। এই গয়না তৈরি করে যেমন অন্যকে সাজতে সহায়তা করছেন, তেমনি একে অবলম্বন করে নিজেদের জীবনকেও সাজাচ্ছেন এখানকার মানুষ। বছরে গড়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকার গয়না তৈরি হয় এ গ্রামে।
একসময় চিকন পাইপ দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে গহনা তৈরির কাজ করা হতো। এখন কিন্তু সে পদ্ধতিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চলে এসেছে গ্যাস সিলিন্ডার। দোকানগুলোতে কানের দুল, চুরি, মনিপুরি বালা, নেকলেসসহ কত রকমের যে গয়না, তার হিসেব মেলা ভার। চাইলে নিজের পছন্দমতও গহনা ডিজাইন করে নিতে পারবেন।
গহনাগুলোর গন্তব্য নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়াসহ রাজধানীর প্রায় সব মার্কেট। এছাড়া গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চল গহনার বৃহত্তর বাজার। পাইকাররা এসে গয়না কিনে নিয়ে যান।
দরদাম
ডিজাইন ও আকারের ওপর নির্ভর করে দাম। যেমন নেকলেস ১০০ থেকে ১ হাজার টাকায়, চুড়ি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা জোড়া, সীতাহার ৬০০ থেকে ১১০০ টাকা, নূপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাথার ঝাপটা ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, হাতের মানতাশা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, খোঁপার কাঁটা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, টায়রা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়, মালা ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা, নাকের ফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা, টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যখন মার্কেটে খুচরা বিক্রি করেন, তখন এর দাম দেড় থেকে দুইগুণ হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
একটা নিরব বিপ্লব ঘটে গেছে, সেখানে জেগে উঠেছে গ্রামের মানুষরা। একটি, দুটি গ্রাম নয় এতগুলো গ্রামের ছোটবড় নারীপুরুষ, ছেলেবুড়ো সবাই এখন ব্যস্ত অলঙ্কার তৈরিতে। সেই গ্রাম চারপাশের মানুষের কাছে উদাহরণ। গহনার গ্রাম ভাকুর্তা অতি সাধারণ গ্রামের গন্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে স্বপ্ন জাগানিয়া এক নাম। এমন আরও গল্প জানতে চোখ রাখুন অলিগলির প্লে লিস্টে।