Reading Time: 4 minutes

সালটা ১৯৭১। সময়টা শঙ্কার, আবার সাহসেরও। অসংখ্য র্নিযাতন-নিপীড়ন সয়ে, অজস্র আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিজয়ের মন্ত্রে ঘুরে দাঁড়ালো একটি গোটা জাতি। প্রথমে একটি-দুটি মুক্তাঞ্চল, তারপর ছিনিয়ে আনলো ৫৫ হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন ভূ-খণ্ড। বাংলাদেশি হিসেবে জাতিগত পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করলো বিশ্বমঞ্চে। মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এর মধ্য দিয়ে এই যে অর্জন তাকে স্মরণ করিয়ে দিতেই নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। কিন্তু এই জাতীয় স্মৃতিসৌধ শুধু মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি স্মরণের জন্যই নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের আরও ইতিহাস। যে ইতিহাস, আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে গেছে স্বাধীনতার পথে, বুনে দিয়েছে মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করার এক অপ্রতিরোধ্য মনোবল। তাই জাতীয় স্মৃতিসৌধ এর নানা দিক ও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়েই আজকের লেখা।  

জাতীয় স্মৃতিসৌধ শুধু মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি স্মরণের জন্যই নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের আরও ইতিহাস

যেভাবে দেখেছি স্মৃতিসৌধকে 

লাল ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা চারদিক। প্রবেশের পর প্রথমেই চোখ চলে যায় শ্বেত পাথরে খোদাই করা লাইনগুলোতে- “বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা/এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলোয় হবে হারা”। এর ডানদিকে রয়েছে বিশাল উন্মুক্ত মঞ্চ। আর সোজা হেঁটে গেলে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে এই সৌধটি আলাদা আলাদাভাবে ধরা দেয়। সৌধের মূল কাঠামোটি কংক্রিটের এবং কমপ্লেক্সের অন্যান্য স্থাপনা লাল ইটের তৈরি। মূল সৌধের গাম্ভীর্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্যই এই পার্থক্য। 

তবে স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের প্রধান ফটক থেকে সৌধ পর্যন্ত পৌঁছাতে দর্শনার্থীদের হাঁটতে হয় দীর্ঘ পথ। এই পথের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো উঁচু-নিচু চত্বর। চত্বরগুলো পার হতে হলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েকবার ওঠা-নামা করতে হয়। তারপর পার হতে হয় বড় একটি কৃত্রিম জলাশয়। এই জলাশয়টি পার হওয়ার জন্য রয়েছে দৃষ্টিনন্দন একটি সেতু। আর পথের দুপাশে রয়েছে গণকবর। স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য জাতিকে যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে, অনেকগুলো সংগ্রাম আর চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে  স্মৃতিসৌধের এই দীর্ঘ হাঁটা পথ সেই তাৎপর্যই বহন করে। সেইসাথে চত্বরের প্রতিটি লাল ইট বহন করে রক্তস্নাত যুদ্ধের ইতিহাস। জলাশয়টি অশ্রুর প্রতীক। আর গণকবর স্মরণ করিয়ে দেয় শহীদদের আত্মদানের কথা। 

পুরো এলাকাটি নির্মিত হয়েছে ৩৪ হেক্টর জমি জুড়ে। এর চারপাশে আরো ১০ হেক্টর জায়গা জুড়ে রয়েছে সবুজ ঘাসের বেষ্টনী। এই সবুজ বেষ্টনী সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের প্রতীক। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সহ বিশেষ জাতীয় দিবসগুলোতে এখানে অসংখ্য মানুষ আসেন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। বাংলাদেশি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে অবলোকন করেন একটু কাছ থেকে।  

জাতীয় দিবসগুলোতে এখানে অসংখ্য মানুষ আসেন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে

কী আছে স্মৃতিসৌধের ৭টি স্তম্ভে  

দূর থেকে একটি ত্রিভুজ এর মত মনে হলেও, কাছ থেকে ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায় স্মৃতিসৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজ নিয়ে গঠিত। আসলে, প্রতিটি স্তম্ভ ত্রিকোণ আকৃতির এবং আলাদা আলদা উচ্চতা বিশিষ্ট হওয়ায়, একেক দৃষ্টিকোণ থেকে ৪৫ মিটার উচ্চতার এ সৌধটি দেখতে একেক রকম লাগে। প্রতিটি স্তম্ভ কংক্রিটের ঢালাই করা যা বাকি চত্বরের লাল ইটের নকশার মাঝে সৌধটিকে আলাদা করেছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধের এই সাত জোড়া দেয়াল মূলত আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ভিন্ন পর্যায়কে নির্দেশ করে। ইতিহাসের এই ৭টি প্রেক্ষাপটের প্রথমটি হচ্ছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং অতঃপর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয়। এই সাতটি ঘটনাকে এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল পরিক্রমা হিসেবে স্মরণীয় করে রাখতেই ৭টি ফলকে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।

একেক দৃষ্টিকোণ থেকে ৪৫ মিটার উচ্চতার এ সৌধটি দেখতে একেক রকম লাগে

তবে, একটু অন্যরকম করে ভাবলে এই ৭টি স্তম্ভ বা ৭ সংখ্যাটির আরো কিছু তাৎপর্য খুঁজে পাই আমরা। যেমন, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এই সালটির দুটি সংখ্যার যোগফল ৫+২= ৭। আবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ০৭ তারিখেই। আমাদের বিজয় দিবস হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। এই তারিখের দুটি সংখ্যার যোগফলও কিন্তু ১+৬= ৭। আবার এই সাতটি স্তম্ভই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ এর অসামান্য অবদানের স্বকৃতি স্মারক।

নির্মাণের ইতিহাস 

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরপর নকশা আহ্বান করা হয়। তখন ২৬ বছরের তরুণ স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন স্মৃতিসৌধের নকশা জমা দেন। প্রায় ১৭-১৮ জন প্রতিযোগীর মধ্যে তিনি প্রথম হন এবং তার করা নকশা অনুসারে ঢাকার অদূরে সাভারে নির্মিত হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

তবে, জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজটি শুরু হয়েছিল এরও আগে, ১৯৭২ সালে। সে সময় ২৬ লাখ টাকা খরচ করে ভূমি অধিগ্রহণ ও সড়ক নির্মাণের কাজ করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কাজ চলে। এ সময় ৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে গণকবরের এলাকা, হেলিপ্যাড, গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান, চত্বর ইত্যাদি নির্মিত হয়। ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে শুরু হয় মূল স্মৃতিসৌধ তৈরির কাজ। এরপর এখানে তৈরি হয় কৃত্রিম লেক, সবুজ বেষ্টনী, ক্যাফেটেরিয়া, রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা ইত্যাদি।

সাভারে নির্মিত এই সৌধটি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ, যা আমাদের অস্তিত্ব আর জাতীয়তাবোধের প্রতীক। আমাদের ইতিহাসের স্মারক। আর এজন্যই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই স্মৃতিসৌধ দেখতে যান এবং শহীদদের প্রতি নিবেদন করেন শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিশেষ করে, জাতীয় দিবসগুলোতে পুষ্পবেদী আর মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এটি। যদি এখনো না যাওয়া হয়ে থাকে, তবে শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে আর এর অসাধারণ নির্মাণশৈলী অবলোকন করতে, বিজয়ের এই মাসেই ঘুরে আসুন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে। 

Write A Comment

Author