Reading Time: 5 minutes

‘আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে- কিছুই কি নেই বাকি?’ 

রবি ঠাকুর এ পংক্তিটি লিখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন ভাবনা থেকে। অথচ এই ২০২০ এ’ও কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এমন শব্দগুচ্ছ! না, প্রাক্তনের স্মৃতিচারণ করছি না, করছি প্রাক্তন স্মৃতির স্মৃতিচারণ। সেইসাথে বলছি কেমন যাচ্ছে আমাদের বর্তমান। বদলে যাওয়া এ বর্তমানে অদ্ভূত নিও (Neo) নরমালের মুখোমুখি আমরা। গত বছরের শেষের দিকে কোভিড-১৯ নামের এক অধরা-অচেনা-অনাহূত অতিথির আগমনে বদলে গেছে জীবনযাত্রা। সারা পৃথিবী ব্যাপী চলছে এর তাণ্ডব। কারো কারো জীবনে নেমে এসেছে মৃত্যুর নিষ্ঠুরতা, কেউ কেউ আবার চোখে চোখ রেখে লড়াই করছে এ ভাইরাসের সাথে। প্রতিনিয়ত অদৃশ্য এ ভাইরাসের সাথে লড়াই করতে থাকা জীবনে কেমন আছি আমরা তা নিয়েই এই ব্লগ। 

স্বেচ্ছাবন্দিত্বের প্রহর 

কোয়ারেন্টাইন
ঘরে থাকার এ সময়ে নিজস্বতা খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ

বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় এ বছরের ৮ মার্চে। সংক্রমণ এড়াতে ২৬ মার্চ থেকে দেয়া হলো লকডাউন, শুরু হলো স্বেচ্ছাবন্দিত্বের প্রহর। দীর্ঘদিন পর অফিস লাঞ্চের বদলে বাড়ির খাবার টেবিলে জমে উঠলো আহার পর্ব। অনলাইন মিটিং, হোম অফিস হয়ে গেলো নিত্যদিনের সঙ্গী। করোনাকালের এ পর্ব নিয়ে অনেকেই বলেন নানা ইতিবাচক কথা। ঘরে থাকার এ সময়ে নিজস্বতা খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ, আবার কারো কাছে এ সময়ের সংজ্ঞা প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কাটানো মূল্যবান মূহুর্ত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাড়নার ব্যাপারটিও হয়েছে দারুণ প্রশংসনীয়। অনলাইন শপিংয়ের ওপর নির্ভরতাও বেড়েছে নিও  নরমাল এই সময়ে। 

তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, অর্থনৈতিক বিপর্যয় নানা রূপে-নানা মাত্রায় আঘাত হেনেছে বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ স্টিফেন কার্লটনের ভাষায়, ‘অর্থনীতির জন্য এ যেন এক অচেনা অভাবিত বিস্ফোরণ। টুকরোগুলো পড়ে আছে সর্বত্র। ছোট–মাঝারি ব্যবসাগুলোও টিকছে না, চাকরি হারাচ্ছেন অনেকেই।’ ভ্রমণ,পর্যটন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, খুচরো ব্যবসা কিছুই রক্ষা পায়নি করোনার প্রকোপ থেকে। কাজের অভাবে শহর থেকে গ্রামে ফিরে গেছেন শ্রমজীবী মানুষেরা, বেড়েছে রিভার্স মাইগ্রেশন। অনিশ্চিত অন্ধকার নেমে এসেছে তাদের জীবন ও জীবিকায়। 

আবার ফিরে এলে 

অফিস
সামাজিক দূরত্বের ঘেরাটোপ, মাস্ক-গ্লাভসের আবরণ আর স্যানিটাইজারের মোড়কে মোড়া এ ফিরে আসার সুর বড় ভিন্ন

আধুনিক গীতিকবির দল ‘ফিরে আসা’ কে যতই রোমান্টিকতার আবরণে মোড়াক না কেন, মহামারীর অনিশ্চয়তা কাঁধে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফেরার অভিজ্ঞতা অবিমিশ্র আনন্দের ছিলো না। হ্যাঁ, দীর্ঘদিন পর নিজের অফিস ডেস্কে ফেরা, সহকর্মীদের সাথে দেখা হওয়ার অনুভূতি নিশ্চয়ই সুখকর। তবে সামাজিক দূরত্বের ঘেরাটোপ, মাস্ক-গ্লাভসের আবরণ আর স্যানিটাইজারের মোড়কে মোড়া এ ফিরে আসার সুর বড় ভিন্ন। 

শুরুর দিকে সপ্তাহের কিছুদিন হোম অফিস’ করার ব্যবস্থাও করেছিলো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। তবে এখন প্রায় সব অফিসই ফিরে গিয়েছে করোনা পূর্ববর্তী রুটিনে। স্বাস্থ্যবিধির চোখরাঙানি এখনও অফিস চত্ত্বরে বিরাজমান। প্রবেশপথে রাখা হচ্ছে স্যানিটাইজার, তাপমাত্রা যাচাইয়ের যন্ত্র। আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন পালন বাধ্যতামূলক করেছে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই। নিজস্ব অবস্থান থেকেও চলছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা। তবু মার্চ-জুন যেমন বিধিনিষেধ আর সতর্কতার কড়াকড়ি দেখেছি, সেটি এখন আর নেই। অফিসপাড়ায় সবাই নিও নরমালের সাথে যেন এক রকম বন্ধুত্বই পাতিয়ে ফেলেছে। 

পায়ের তলায় সর্ষে 

বাস
প্রায় অর্ধেক বছর লকডাউনে থাকার পর স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণের নেশা পেয়ে বসেছে মানুষকে

করোনাকালের জীবন-এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভ্রমণকাহিনীর নামটি বড় মানিয়ে যায়। প্রায় অর্ধেক বছর লকডাউনে থাকার পর স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণের নেশা পেয়ে বসেছে মানুষকে। কেউ ছুটছে সমুদ্রে, কেউ শান্তি খুঁজে নিচ্ছে পাহাড়ে। তবে ঢাকার বাইরে স্বাস্থ্যবিধি মানার তোড়জোড় নেই একেবারেই। ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে জনসমাগম বাড়ছেই। আন্তর্জাতিক সীমানায়ও চলছে কড়াকড়ি। ফলে দেশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোয় যেন উপচে পড়ছে ভিড়। যাত্রাপথেও যেহেতু অনেক যাত্রী একসাথে ভ্রমণ করছেন, বাড়ছে সংক্রমণের হারও। রাজধানীতে তাও মানুষ বিধিনিষেধের কারণে সতর্ক থাকছে, কিন্তু অন্যান্য জেলার চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। বিশেষ করে গ্রাম বা মফস্বলে অনেকে করোনার অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান।  

করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইন্ডাস্ট্রির তালিকায় ভ্রমণ খাত থাকবে শুরুর দিকেই। আশার কথা হলো, মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, চৌদ্দ দিন কোয়ারেন্টিন- এর নিয়মনীতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এ ইন্ডাস্ট্রি। তবে করোনাকালের জীবন-এ পরিবর্তনের পালা চলছেই। ভ্রমণপিপাসুরা ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছেন ঠিকই, তবে গন্তব্যস্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বাড়ির কাছের নিরাপদ স্থান। বুকিং সাইট ট্রাভেলোসিটির তথ্যানুসারে, এই সময়ে তারা যতগুলো ভ্রমণের বুকিং পেয়েছে, তার বেশিরভাগই ভ্রমণকারীদের বাড়ির একশো মাইলের মধ্যে। ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স কম্প্যারিসন সাইট ‘স্কয়ারমাউথ’-এর পরিসংখ্যানে এপ্রিল ১ থেকে মে ১০-এর মধ্যে যতগুলো ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স পলিসি কেনা হয়েছে, তার প্রায় ৪৮ শতাংশই অভ্যন্তরীণ ট্রিপের জন্য; যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ভ্রমণের চেয়ে বাড়ির কাছের রোড ট্রিপ, ট্রেকিং বা ব্যাকপ্যাকিংয়ের আকর্ষণ এখন তুলনামূলক বেশি। আর নিও নরমাল-এ ‘ব্যাকপ্যাক’-এর অনেকখানি জায়গাই হয়তো দখল করে নেবে সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লাভস। 

বাক্সে বাক্সে বন্দী বাক্স

ভিডিও কল
নিও নরমাল জীবনে আমাদের অনেক কিছুই চলছে চারকোণা ডিজিটাল স্ক্রিনে

করোনাকালের জীবন-এ আমাদের অনেক কিছুই চলছে চারকোণা ডিজিটাল স্ক্রিনে। সংক্রমণের আশংকায় স্কুল বন্ধ। তাই তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইন শ্রেণিকক্ষে পড়ছে বিশ্বের লাখো শিক্ষার্থী। ধীরে ধীরে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে স্কুলের পোশাক পরে, ল্যাপটপের সামনে বসে ক্লাস করার দৃশ্য। প্রবীণ শিক্ষকেরাও ফোনের ক্যামেরার সামনে, ফেসবুক লাইভে এসে পড়াচ্ছেন ক্যালকুলাস বা জৈবযোগের মতো জটিল বিষয়গুলো। দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিকল্প ধারা নিয়ে আসার চেষ্টা চলছিল আধুনিক দেশগুলোতে। নিও নরমালে এখন সেই বিকল্প ব্যবস্থাই শিক্ষাকাঠামোর প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠেছে। 

তবে এ পরিবর্তিত ব্যবস্থায় কিছু ঘাটতিও রয়েছে। করোনার কারণে বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রভাব নিয়ে মার্কিন বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার ডটকমে প্রকাশিত হয়েছে একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, অনলাইন ক্লাসের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধের নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলো। ইন্টারনেট সংযোগ সমস্যাসহ নানা কারণেই এমনটা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের তথ্যমতে, বিশ্বের ৩৬ কোটি শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট সংযোগ নেই। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অনেক দেশের সরকার এ কারণে ব্রডব্যান্ডের পাশাপাশি টেলিভিশন ও রেডিওতে বিকল্প ক্লাস বা পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে।

শুধু যে শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল স্ক্রিনের প্রভাব বেড়েছে তা কিন্তু নয়। ট্রেনিং, সেমিনার এসব কিছুই এখন হচ্ছে ভিডিও কলে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জনপ্রিয় ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ জুমের গ্রাহক বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৫৮ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি নানা সেবার অনেকাংশই হচ্ছে অনলাইনে। এছাড়া, অনলাইন ব্যাংকিং, ই-পাসপোর্টের আবেদনের মতো ব্যাপারগুলো নিও  নরমাল এর সাথে তাল মেলাতে সাহায্য করছে মানুষকে।

ই-কমার্স ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নিও  নরমাল এর জীবনযাত্রায়। করোনাকালের জীবন-এ শুরুর দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, ঔষধের চাহিদাই বেশি ছিলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। তবে ধীরে ধীরে উৎসবের কেনাকাটা, বিলাসবহুল সামগ্রী কেনার জন্যও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে অনলাইন শপিং। উন্নত বিশ্বে হয়তো এ রীতি আগেই জনপ্রিয় ছিলো কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নিও  নরমাল এ এই জনপ্রিয়তা হয়েছে আকাশচুম্বী। পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে রিয়েল এস্টেট খাতেও। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের একমাত্র রিয়েল এস্টেট সলিউশন প্রোভাইডার বিপ্রপার্টির কথাই বলা যাক। নিও  নরমাল এর সাথে খাপ খাইয়ে তারা আয়োজন করেছে দেশের সর্ববৃহৎ অনলাইন প্রপার্টি ফেয়ার। নিয়মিত সেবার তালিকায় যোগ করেছে ভার্চুয়াল ট্যুরের মাধ্যমে প্রপার্টি ভিউয়িং এর ব্যবস্থা।  

আনন্দময়ীর আগমনে

উৎসব
নিও নরমালে উদযাপনের ভঙ্গিতে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন

 

এই করোনাকালের জীবন-এ স্বাভাবিক সময়ের মতো অনেক আয়োজনই করা যাচ্ছে না, মানতে হচ্ছে অসংখ্য বিধিনিষেধ। তবু প্রাণের টানে উদযাপিত হচ্ছে উৎসব। তবে উদযাপনের ভঙ্গিতে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। বাইরের জনসমাগমের বদলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ঘরোয়া পরিবেশে উদযাপনের রীতি। আর উৎসবের এ ঘরমুখিতায় ইতিবাচকতা দেখছেন অনেকেই।

করোনাকালে বহুদিন পর আবার জোরেশোরে ফিরে এসেছে ঘরোয়া বিয়ের আয়োজন। কমিউনিটি সেন্টারের ঝলমলে আলোকসজ্জা এড়িয়ে চলছেন অনেকেই। আবার অতিথি তালিকা বড় হলেও অনেকে চেষ্টা করছেন বিয়ের ভেন্যুতে সামাজিক দূরত্ব মানতে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে। খাবার টেবিল হয়তো ইদানিং আট জনের বদলে সাজানো হচ্ছে ছয় জনের জন্য। অতিথি বরণ করার সময় ট্রেতে মিষ্টির পাশাপাশি জায়গা করে নিচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। 

জীবন সদা বহমান। সুখ-দুঃখ, রোগ-অরোগের সাথে সহাবস্থানই এর চিরাচরিত ধর্ম। তাই করোনাকালের জীবন-এ অদৃশ্য মারণ ভাইরাসের সাথে তাল মিলিয়েই চলছি আমরা। এই নিও নরমাল এ আমাদের সাথে নেই টিএসসির কনসার্ট, বৈশাখী মেলার ভিড় বা ব্ল্যাকবোর্ড-সাদা চকের ক্লাসরুম। হাত ধুতে ধুতে যেন ভাগ্যরেখাকেই বদলে ফেলেছি আমরা! তবু ইতিবাচকতাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের পথচলা। তাই ধরে নেয়া যাক, আমরা আছি এক ট্রানজিট লাউঞ্জে। অতীত আর আগামী দিনের যোগ তৈরি হচ্ছে এ নিও নরমালে। আমাদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমানেরা এখন কাজ করছে এ অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে, চলছে টিকার আশায় অপেক্ষা। আর আমাদের সহমর্মিতা, মনের শক্তি নিয়ে আমরা টিকে আছি নিও নরমাল এ পৃথিবীতে। 

Write A Comment