Reading Time: 4 minutes

বাংলার এ অববহিকায়, হাজার বছরের পুরানো শিল্প টেরাকোটা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও, টেরাকোটার ইতিহাস বহু বছরের পুরনো। লাতিন শব্দ টেরা ও কোটা থেকেই এসেছে টেরাকোটা শব্দটি, যার অর্থ যথাক্রমে মাটি ও পোড়ানো। অর্থাৎ, মাটি পুড়িয়ে যা তৈরি হয়, তার সবই আসলে টেরাকোটা। পৃথিবীর বিভিন্ন আদি সভ্যতায় তো বটেই, বাংলা অঞ্চলেও মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন আমলের নানা নিদর্শনেও দেখা মেলে টেরাকোটা। এমনকি  মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির সৌন্দর্য দেখে মধ্যযুগের মুসলিম শাসকেরাও তা গ্রহণ করেছিলেন, নিজেদের মতন করে। ঐতিহ্যময় সেই টেরাকোটার ইতিহাস আর এর বিবর্তনকে, আপনার সামনে তুলে ধরতেই আজকের লেখা।

টেরাকোটা
হাজার বছরের পুরানো শিল্প টেরাকোটা

টেরাকোটার জন্ম

কীভাবে এসেছে টেরাকোটা, এই প্রশ্নের উত্তরে ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে আমাদেরকে চলে যেতে হবে সভ্যতার একদম শুরুতে, যখন চাকা এবং আগুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানবজাতি তার শিল্পের পথকে প্রসারিত করেছিল। কারণ, এ আবিষ্কার কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থাতেই পরিবর্তন আনেনি, পরিবর্তন এনেছিল খাদ্যাভ্যাসেও। পোড়া মাংস, ভাত বা অন্যান্য খাদ্য প্রস্তুত ও সংরক্ষণে প্রয়োজন ছিল পাত্র। সেই প্রয়োজন থেকেই, চাকার মাধ্যমে পোড়ামাটির পাত্র প্রথম তৈরি করা হয়। তারপর সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে স্থায়ী রূপ দেয়া হয়। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় পোড়ামাটির শিল্প। শুরু হয় টেরাকোটার ইতিহাস।

পোড়ামাটির শিল্প
খাবার রাখার জন্য মাটির পাত্রের প্রয়োজন থেকেই জন্ম নেয় পোড়ামাটির শিল্প

প্রাচীন বাংলায় টেরাকোটা

বিশ্বের বৃহত্তম এই ব-দ্বীপে, মাটি সহজলভ্য বলেই এখানে মৃৎ শিল্পের চর্চার শুরুটা সেই প্রাচীনকাল থেকেই।  সেসময়ে,  বিভিন্ন সাংসরিক পণ্য যেমন: মাটির ফলক, পুতুল, কলসি-হাঁড়ি ইত্যাদি তৈরি হতো পোড়ামাটিতে। কেবল তৈজসপত্রই নয়, এই অঞ্চলে পাথরের স্বল্পতার কারণে ইট পুড়িয়ে ভবন, মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। টেরাকোটার ইতিহাস থেকে বাংলা ভূখন্ডে পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শনটি রয়েছে উয়ারী-বটেশ্বর ও মহাস্থানগড়সহ তার আশপাশের এলাকায়। যা নির্র্মিত হয়েছে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। পাহাড়পুরেও পাল-পূর্ব যুগের বেশ কিছু টেরাকোটার নিদর্শন পাওয়া গেছে যা কিনা আলাদা আলাদা সময়কালের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে চলছে। যেমনঃ উয়ারী-বটেশ্বর এলাকার আদি মাতৃদেবীর যে প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে, তাতে পশ্চিম এশিয়া ও সিন্ধু সভ্যতার মাতৃদেবীর মিল রয়েছে।

মুখাবয়ব
ছাঁচ থেকে বেরোনোর পর সেই মুখাবয়বকে দক্ষ হাতের স্পর্শে আরো নিখুঁত করে তুলতো কুমারেরা

মৌর্যযুগের টেরাকোটার ইতিহাস ঘাটলেও দেখা যায়, এদেশীয় পোড়ামাটির শিল্পে ছিল গ্রিক-পারস্য প্রভাব। তবে এই সময়ে হাতের পাশাপাশি ছাঁচের ব্যবহার শুরু হয়। ছাঁচে মুখাবয়ব তৈরি হতো, আর শারীরিক গড়ন দেওয়া হতো হাতে। তবে ছাঁচ থেকে বেরোনোর পর সেই মুখাবয়বকে দক্ষ হাতের স্পর্শে আরো নিখুঁত করে তুলতো কুমারেরা। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর শালবন বিহারের চিত্রফলকগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। টেরাকোটার ইতিহাসে, পাল আমলের সবচেয়ে বড় কীর্তিটি হচ্ছে সোমপুর মহাবিহার। সেখানকার কেন্দ্রীয় মন্দিরের গায়ে প্রায় দুই হাজার টেরাকোটা ছিল। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল আরও ৮০০ টেরাকোটা। সেন আমলেও অসংখ্য মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার আস্তর পড়েছে, ইট হয়েছে কারুকার্যময়। মোট কথা, লৌকিক ধর্ম কিংবা আচার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কালে কালে এই বাংলাতেই টেরাকোটা শিল্প বিবর্তিত হয়েছে নানাভাবে।

মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা
সেন আমলেও অসংখ্য মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার আস্তর পড়েছে

মধ্যযুগে টেরাকোটা

মধ্যযুগের একদম শুরুতে বাংলার মসজিদগুলো ছিল একদমই সাদামাটা। তবে পরবর্তীতে মসজিদের মিহরাব ও বাইরের দেয়ালে এবং কবরের আচ্ছাদনে টেরাকোটার নকশার আদলে পাথরে খোদাই করা নকশার দেখা মেলে। তবে, পাথরের অপর্যাপ্ততার কারণে এই বাংলায় মসজিদের গায়েও তখন পোড়ামাটির শিল্পের বহুল ব্যবহার শুরু হয়।  ইসলাম ধর্মে যেহেতু জীবজন্তু আঁকা মানা, তাই গাছ, লতাপাতা, ঘণ্টা, শিকল, পদ্ম, গোলাপের নকশা হতে থাকে মসজিদের মিহরাবে ও দেয়ালে। স্বাধীন সুলতানি আমলের (১৩৩৮-১৫৭৬) বেশির ভাগ মসজিদেই দেখা যায় এসব পোড়ামাটির কারুকাজ আর নকশা করা ইট। কিন্তু মুঘল আমলে লাইম-প্লাস্টারের আগমন টেরাকোটার শিল্পকে কিছুটা স্তিমিত করে দেয়। 

মসজিদের মিহরাব ও বাইরের দেয়ালে দেখা যায় পোড়ামাটির ফুলেল নকশা

অষ্টাদশ শতকে টেরাকোটা

অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবারও টেরাকোটার আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশের মন্দিরগুলোতে। অষ্টাদশ শতকের বাংলার দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনাসহ গোটা উত্তরবঙ্গজুড়ে তখন চলছে টেরাকোটার শিল্পচর্চা। এ সময়ের সেরাগুলো কাজ দেখা যায় দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির এবং রাজশাহী জেলায় অবস্থিত পুঠিয়ার মন্দিরগুলোতে।  ১৭৫২ সাল নাগাদ তৈরি দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের মতো এত সূক্ষ্ম ও জটিল কাজ সে সময়ের আর কোনো মন্দিরে দেখা যায় না। রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণের উল্লেখযোগ্য কাহিনি এখানে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। নিচ থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত, পুরো মন্দিরটি প্রায় ১৫ হাজার টেরাকোটার ফলকে মোড়া।  

Kantajew Temple, Dinajpur
বাংলাতে টেরাকোটার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির

আধুনিক যুগে টেরাকোটা

টেরাকোটার ইতিহাস সমৃদ্ধ হলেও, এতে ফাটল ধরেছিল ইংরেজ শাসনামলে। জমিদার ও অভিজাতরা তখন ইউরোপীয় সংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট হতে থয়। ফলে, সেসময়ে বেশিরভাগ ঘরবাড়ি ও ইমারত নির্মাণেও দেখা যায় পাশ্চাত্য ডিজাইনের প্রভাব এবং হারিয়ে যেতে শুরু করে পোড়ামাটির ফলকের ব্যবহার। তবে, আধুনিক যুগে, আদির সেই টেরাকোটাই ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে ফিরে এসেছে নতুন আঙ্গিকে। ভবন নির্মাণে ইটের ব্যবহার তো আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। এইবার, ভবন নির্মাণ কাজে যুক্ত হয় পোড়ামাটির তৈরি আধুনিক উপকরণ টাইলস। মেঝে থেকে শুরু করে বাহারি দেয়াল, সর্বত্র বৃদ্ধি পায়  টাইলসের ব্যবহার। আর আধুনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইন তো টেরাকোটা কে গ্রহণ করেছে আলাদা একটি থিম হিসেবে। 

টেরাকোটা
আধুনিক ইন্টেরিয়রে দেখা মেলে টেরাকোটার বিচিত্র ব্যবহার

আধুনিক সময়ে আবাসিক ভবন থেকে কমার্শিয়াল স্পেস, বাসনপত্র থেকে অন্দরসজ্জা, প্রতিটি ক্ষেত্রে টেরাকোটা ঢেলে সাজিয়েছে তার ঐতিহ্যকে।  আর তাই, বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের ঘ্রাণ নিতে, টেরাকোটাকে রাখতে পারেন আপনার অন্দরসজ্জার চমৎকার উপকরণ হিসেবে। আজকের টেরাকোটার ইতিহাস, আপনাকে কতোটা প্রভাবিত করতে পারলো, জানিয়ে দিন মন্তব্যের ঘরে। 

 

Write A Comment

Author