Reading Time: 5 minutes

সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গু মশার বিস্তার নিধন খুবই জরুরী একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গু মহামারীর আকার ধারণ করার আগেই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এই ভাইরাস নিধনে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে, যেগুলো এই ডেঙ্গু মশার ভয়াবহতা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারবে।

ভাইরাসের উৎস এবং বর্তমান অবস্থা 

”বিগত জুলাই মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১,৯২০ জনের বেশি, পুরুষ, মহিলা এবং শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে”–

থার্মোমিটার
এখনই উত্তম সময় ডেঙ্গু ভাইরাস দমনের ও ডেঙ্গু নিধনের

এই ভাইরাসের মূল বাহক হচ্ছে এডিস মশা। এই মশা কামড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। সচরাচর ভোরবেলা ও সূর্য ডোবার আগে এই মশাগুলোর প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই এই সময়টি বেশ ঝুঁকির। সাধারণ মশাগুলো যদিও এই ভাইরাস বহন করতে পারে। স্যাঁতস্যাঁতে জলবায়ুতে ও জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এই মশা প্রতিনিয়ত ডিম ছাড়ে।                                                                         

বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর পূর্বাভাস পাওয়া যায় ২০০০ সালের দিকে। যদিও ডেঙ্গুর প্রকোপ এমন তীব্র এর আগে কখনোই হয়নি। বিগত জানুয়ারি মাসে ৬,৬৫০ জনের বেশি, পুরুষ, মহিলা এবং শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এমনকি দেশের প্রায় সকল হাসপাতালই এমন অবস্থা মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশে সম্ভবত এমন জেলা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাই এখনই উত্তম সময় ডেঙ্গু ভাইরাস দমনের ও ডেঙ্গু নিধনের। চলুন তবে জেনে নেই কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, আমরা ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ করতে পারব। 

পরিবেশগত ব্যবস্থা গ্রহণ 

ড্রেনের পাইপ
সাধারণ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলেই এই ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ সম্ভব

ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আমাদের আশেপাশে পরিবেশের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। আমাদের সামান্য অবহেলা এই মশার বংশ বৃদ্ধি ঘটাতে পারে বহুগুণে। বাসার আশেপাশে সাধারণ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলেই এই ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ সম্ভব। 

  • জমিয়ে রাখা পানি পরিষ্কার করুনঃ  আগেই বলা হয়েছে স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জমে থাকা পানিতেই ডেঙ্গু মশার জন্ম হয়। তাই বাসার আশেপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে অতিদ্রুত। ড্রেনের পানি, বৃষ্টির পানি কিংবা যে কোন ধরনের জমে থাকা পানি যত দ্রুত সম্ভব পরিষ্কার করে ফেলুন। আপনি চাইলে নিজে কিংবা বিল্ডিং কমিউনিটির সাহায্য নিতে পারবেন। 
  • ঢাকনাযুক্ত পাত্র ব্যবহার করুনঃ আমরা সাধারণত কন্টেইনার, ড্রাম, ট্যাংকে ও ঝুড়িতে পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য পানি জমিয়ে রাখি। অনেক সময় এই জমিয়ে রাখা পানিতেই জন্ম নেয় ভয়াবহ এডিস মশা। তাই, ঢাকনাযুক্ত পাত্র ব্যবহার করুন এবং ঢাকনা শক্ত করে লাগিয়ে রাখুন। 
  • পানি জমিয়ে রাখার পাত্র পরিষ্কার করুনঃ পানি জমিয়ে রাখার পাত্রে কেবল শক্ত করে ঢাকনা দিয়ে রাখলেই যে ডেঙ্গু মশার বিস্তার ও প্রতিরোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে নিয়েছেন তা কিন্তু নয়! যে পাত্রে পানি জমিয়ে রাখছেন সেটি নিয়মিত পরিষ্কার করুন! দেখা গেল, পাত্রের ভেতরের জমে থাকা ময়লায় এডিস মশা বেড়ে উঠছে।  শুধু পানির পাত্র নয়, গাছের টব, পট সবকিছুই অন্তত একবার পরিষ্কার করে রাখুন। 
  • জানালায় নেট ব্যবহার করুনঃ  ঢাকায় এডিস মশার উপদ্রব এতটা বেশি বাড়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হল, জানালায় নেট ব্যবহার না করা! জানালার বাইরে কিংবা ভেতরে নেট ব্যবহার করলে হয়তো তেমন খরচ হবার কথা না কিন্তু, এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এটি অনেক বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে। এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করলে আপনি বাসার ভেতরেও নিরাপদ থাকতে পারছেন।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তা 

ছবিতে স্প্রে করা হচ্ছে
মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা আপনার দায়িত্ব

আপনার আশপাশ তো পরিষ্কার করলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা! এটা নিশ্চিত না করলে যান সব শ্রমই বৃথা! প্রাথমিকভাবে নিজের নিরাপত্তা গ্রহণ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা আপনার দায়িত্ব। 

  • মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করুনঃ বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই মশা বিতাড়ক ক্রিম সম্বন্ধে জানে না। বলা চলে, অতিসম্প্রতি এই ক্রিম সম্বন্ধে সকলে জানতে শুরু করেছে। বাজারের অন্যান্য ক্রিমের মতই এটি আপনি আপনার স্কিনে ব্যবহার করতে পারবেন। ডেঙ্গু জ্বরের জন্য অডোমস ক্রিমটা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, চাইলে সেটি ব্যবহার করতে পারেন। ক্রিম ছাড়াও অডোমস কোম্পানির আরও বেশ কিছু উপকরণ রয়েছে যেমন, লোশন, জেল এবং বডি স্প্রে  ইত্যাদি ব্যবহার করেও মশা থেকে দূরে থাকতে পারেন। 
  • এরোসল স্প্রে ব্যবহার করুনঃ মশা তাড়ানোর জন্য এরোসলের থেকে কার্যকরী বাজারে আর কিছু নেই। অনেকেই মনে করেন এরোসল স্প্রে মশা একবারে মেরে ফেলে, ব্যাপারটা আসলে এমন নয়! এরোসল স্প্রে ব্যবহার হয়ে থাকে মশা তাড়ানোর জন্য।  দরজা জানালা বন্ধ করে এটি ব্যবহার করলে ফলাফল ভালই পাওয়া যায়। খেয়াল রাখবেন ঘরে কেউ  আছে এমন অবস্থায় স্প্রে করা থেকে বিরত থাকবেন।·         ·         
  • হাত-পা ঢাকা পোশাক পরিধান করুনঃ এটি যদিও খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। হাত-পা ঢাকা পোশাক পরিধান করাটা এই সময়ে খুব বেশি প্রয়োজনীয়। যতটা সম্ভব সতর্কতা মেনে হাত পা ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করুন। নিজস্ব সতর্কতা অবলম্বন করলে ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। 

অপ্রচলিত পদ্ধতি 

ফলের কাটা অংশ
কিছু উপায় আছে যেগুলো অবলম্বন করেও ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ করা সম্ভব

এতক্ষণ ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ সম্বন্ধে যে উপায়গুলো বলা হল সেগুলো কম বেশি সবাই জানে। কিন্তু এগুলোর বাইরেও কিছু উপায় আছে যেগুলো অবলম্বন করেও ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ করা সম্ভব। 

  • কফি ছিটিয়ে রাখুনঃ এই উপায়টি সহজ হলেও সবার কাছে বেশ অজানা। আশেপাশের জমানো পানিতে কফি ছিটিয়ে রাখুন। এটি পানিতে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ করে। পানিতে এই কফি ছিটিয়ে রাখলে, মশার লার্ভাকে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে মশার বংশ বৃদ্ধি ধ্বংস করে থাকে। আপনি চাইলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। 
  • রসুন নির্যাস স্প্রেঃ মশার প্রকোপ থেকে বাঁচতে এই রসুনের নির্যাস খুবই কার্যকরী। কয়েকটি রসুন গুঁড়ো করুন, তারপর এক কাপ পানি যোগ করুন। এরপর রস তৈরি করে নিন। একটি বোতলে ঢেলে ঘরের চারদিকে বা যেখানে পানি জমে আছে সেখানে ব্যবহার করতে পারেন। আপনি চাইলে রসুনের পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করতে পারেন, তবে খেয়াল রাখতে হবে সেটারও যেন রসুনের মতই তীব্র গন্ধ থাকে।  
  • লেবুতে লবঙ্গ গাঁথুনঃ অপ্রচলিত পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে ‘লেবুতে লবঙ্গ গেঁথে রাখা’। লেবু এবং লবঙ্গের সংমিশ্রণ নিঃসন্দেহে ডেঙ্গু মশাকে আপনার থেকে দূরে রাখবে! একটি লেবুর অর্ধেক নিয়ে সেখানে, কয়েকটি লবঙ্গ গেঁথে রাখুন! এরপর বাসায় মশা যে পথ দিয়ে বেশি প্রবেশ করে সেখানে রেখে দিন, যেমন- দরজা, জানালা, ভেন্টিলেটর ও বারান্দা। দেখবেন মশা আর কোনভাবেই ঢুকতে পারছে না।
  • অ্যালোভেরা নির্যাস ব্যবহার করুনঃ অ্যালোভেরা নির্যাসটি বেশ উপকারী, মশার ক্রিম হিসেবেও এর জুড়ি নেই। এছাড়া এটি স্কিনের জন্যও বেশ ভালো। এটা স্কিনে মাখার পর থেকে আপনি নিজেই খেয়াল করবেন মশার উপদ্রব অনেকটাই কমে গেছে! একবার ব্যবহার করলেই সারাদিনের সুরক্ষা আপনি পেয়ে যাচ্ছেন। 

দ্রুত বাড়তে থাকা ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। যদি এই হারেই ডেঙ্গু ভাইরাস বেড়ে উঠতে থাকে তা আমাদের সকলের জন্যই বেশ ভয়ানক এবং ক্ষতিকর। সুতরাং, ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ করতে এই উপায়গুলো প্রয়োগ করতে পারেন। 

Write A Comment