Reading Time: 4 minutes

বাহারি নকশা আর বুননের বিশেষত্বের কারণে জামদানি শাড়ি অন্য যেকোন শাড়ির চাইতে বেশি প্রিয় এবং আলাদা। বাঙালী নারী যেমন শাড়ি ভালোবাসে তেমনি ঢাকাই শাড়ি জামদানিও তাদের বেশ প্রিয়। শুধু যে বাঙালী এই শাড়ির প্রেমে মগ্ন তা কিন্তু নয়! বিশ্বের দরবারেও আছে এর ব্যাপক চাহিদা। তাই হয়তো দেশ বিদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকাই শাড়ি জামদানি। আমাদের বস্ত্র শিল্পের গর্ব এই জামদানি শাড়ি। সবার কাছে শাড়ির রানী মসলিন হলেও, মসলিন শাড়ির হাত ধরে আসা জামদানি শাড়িকেও কেউ একবার দেখলে ভুলতে পারে না। জামদানি বলতে সাধারণত আমরা জামদানি শাড়িকেই বুঝি। জামদানি কবে কখন তৈরি শুরু হয় তা সঠিকভাবে না জানা গেলেও অনেকে মনে করেন আজকের এই জামদানি শাড়ি এই বিশ্ব বিখ্যাত মসলিনেরই উত্তরাধিকার। চলুন তবে আরও কিছু তথ্য জানা যাক!   

জামদানির আদিকথা 

“জামদানি বুনা হচ্ছে
“জামদানি” শব্দের অর্থ “বুটিদার কাপড়

ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, “জামদানি” শব্দের অর্থ “বুটিদার কাপড়”। ফরাসি শব্দ জামা মানে কাপড় আর দানা মানে বুটি। মিহি ও সাদা রঙের মসলিনের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। এমনকি আগের সময়ে ঢাকা সোনারগাঁ, ধামরাই এই সমস্ত জায়গায় তৈরি করা হত মসলিন। তখনকার সময়ে মসলিনের দাম ঘুচানোর জন্য মসলিনের হাত ধরেই আনা হয় জামদানি। ব্যস কম সময়ে সকলের মনে জায়গা করে নিতে থাকল এই বাহারি শাড়ি। জামদানির আদি অঞ্চল এই সোনারগাঁ। আমাদের আজকের অলিগলি ভ্লগের আয়োজন এই সোনারগাঁ নিয়েই। প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা, মোগল আমলের সময়ে জন্ম হয় এই ঐতিহ্যবাহী শাড়ির। শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জের নুয়াপাড়া গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাটলেই চোখে পরবে ছোট বড় জামদানি শাড়ি তৈরির কারখানা। কেন শুধু এই নদীর তীরেই তৈরি হয় জামদানি শাড়ি? ভালো জামদানি তৈরির জন্য ভালো সুতো, দক্ষ কারিগর, ঐতিহ্যবাহী নকশা যেমন দরকার তেমনি প্রয়োজন আর্দ্রতা। শীতলক্ষ্যা নদীপাড়ের আর্দ্র আবহাওয়া জামদানি তৈরির জন্য উপযোগী। ভোরবেলা সুতো প্রস্তুতের সবচেয়ে ভালো সময়। কেননা, এসময় বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকে। এ কারণে দেশের অন্য কোথাও জামদানি তৈরি সম্ভব হয় না। তাইতো অতীতের মসলিন এবং আজকের জামদানি শিল্প দুটোই শীতলক্ষ্যাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে।

জামদানি পল্লী ঘুরে 

জামদানি
জামাদানি বুনন

এই পল্লীর তাঁতিরা একেটি শাড়ি নকশা করতে কাটিয়ে দেন দিনের পর দিন। নিজ হাতে নিজের মনের মত করে ফুটিয়ে তোলেন একটার পর একটা নকশা। ঘাম ঝড়িয়ে করে যাচ্ছেন শাড়ির নকশা কখনো বা ঝরে রক্তও। তবুও থেমে নেই তাদের হাত! বেশ কয়েকটি ধাপ পার করে তবেই তৈরি হয় শাড়ি। অর্থাৎ, শুধু তাঁতিরা নয় বরং অসংখ্য কারিগররাও যুক্ত থাকেন এই শাড়ি বুনার কাজে। যদিও এখনকার সময়ে অর্ধেক কাজ করা হয়ে থাকে মেশিনে আর বাকী অর্ধেক হাতে। কিন্তু, একটা সময় সম্পূর্ণ শাড়ির কাজই করা হতো নিজ হাতে। শাড়ি তৈরির আগে তৈরি করতে হয় সুতাও। কিন্তু, এখন বাজার থেকেও সুতা কিনে আনে অনেকে। সুতি বা পলেস্টার সুতা কেজি দরে কেনা হয়। সুতা সাদা রঙেই কিনে আনে এবং অন্য রঙ প্রয়োজন হলে কৃত্তিম উপায়ে বিভিন্ন রঙ করে নেয়া হয়। তাঁতিরা জামদানি শাড়ি তৈরির সময় সাথে সাথে শাড়ির সুতা থেকে খানিকটা মোটা সুতা দিয়ে করতে থাকেন বাহারি নকশা। আর তাঁতিরা এই নকশার দীক্ষাটা পেয়ে থাকে নিজ পরিবারে।

ছোটবেলা থেকেই নানারকম নকশা তৈরির হাতেখড়ি হয়ে যায়। বংশপরম্পরায় সকলেই নিজ পরিবার থেকে এই নকশার কাজটা শিখে নেয়। তাঁতে একবার জমিনটা তৈরি করে নেয়, তারপর নকশার জন্য সুতো ঢুকানো হয়। একবার বুনে আবার নকশা করে। এভাবেই চলতে থাকে শাড়ির বুনন। এভাবে জমিন বোনার সঙ্গেসঙ্গে নকশা তোলার কাজও হয়। তারপর শাড়িটিকে আারেকবার মাড় দিয়ে পলিশ করা হয়। নকশা যত সূক্ষ্ম হবে শাড়ি তৈরি করতে ততই বেশি সময় লাগবে। সাধারণত একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে তাঁতিদের সাতদিন থেকে কয়েক মাস এমনকি বছরও লাগতে পারে। জামদানি শাড়িতে রং দিয়ে কোন নকশা করা হয় না। সুতায় ফুটিয়ে তোলা হয় নানা নকশা। যেহেতু, তাঁতিরা নিজেরাই নকশা করে সেহেতু নকশায় ফুল, লতা ও পাতার চিত্রই বেশি ফুটে উঠে। তবে, জামদানিতে জ্যামিতিক নকশাও করা হয়েছে। পানান হাজার, দুবলি জাল, বুটিদার, তেরছা, ডুরিয়া, ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, পুঁইলতা, কচুপাতা, কালকা পাড়, শামুক বুটি এরকম নানা নামের নকশায় তৈরি হয়ে থাকে জামদানি শাড়ি।

জামদানির হাট বা আড়ত 

জামদানির হাট
জামদানি শাড়ির বিরাট হাট

জামদানি প্রেমীদের জন্য সুখবর। ডেমরায় শীতলক্ষ্যার তীরেই ভোর ৫ টা থেকে বসে জামদানি শাড়ির বিরাট হাট। যেখানে চলতে থাকে জামদানি কেনাবেচা। কিন্তু, বর্তমানে মেশিনে বোনা জামদানির জন্য হাতে বোনা জামদানি শিল্প পড়েছে হুমকির মুখে। কিন্তু এতে হাতে বোনা জামদানির চাহিদা একটুও কমেনি। আর্থিক মূল্যায়নে জামদানি শাড়ির দাম ঠিক করে বলা মুশকিল, তা নির্ভর করে সুতা এবং নকশার উপর। তবে দামী জামদানি সেটাই যেটা কিনা, হাতে সুতা দিয়ে বোনা ভারী নকশার।  দাম যেমনই হোক না কেন! এই শাড়ি অমূল্য। 

জামদানির রঙ, বুনন, নকশা সময়ের সাথে আধুনিক হয়েছে। কিন্তু তাঁতির হাতে বোনা শাড়ি এখনো সুন্দর আর অভিজাত। আমাদের সকলের আলমারিতে লুকিয়ে আছে কোন না কোন এক ঢাকাই জামদানি শাড়ি। একেকটি জামদানি শাড়ি একেকটি গল্পে গাঁথা। আপনার কোন গল্পটা আমাদের জানাতে চান? কমেন্টে জানিয়ে দিন এখনই। এই অলিগলি ভ্লগের মত আরও নতুন গল্প দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন বিপ্রপার্টি ইউটিউব চ্যানেলটি

2 Comments

  1. স্যার, জামদানীর এই হাটটি প্রতি শুক্রবার ভোর ৫ টায় বসে।

Write A Comment