Reading Time: 4 minutes

জনসংখ্যার অধিক চাপ এবং এর ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে ঢাকা মহানগরীর উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। স্বাধীনতার পর পরই যখন জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করে, তখন এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে ঢাকা শহরের উপর। পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যেই এই জনসংখ্যা বেড়ে তিন গুণ হয়ে যায়। এতে করে নতুন করে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বেড়ে যায় বেকারত্বের সংখ্যা। পরিবেশ দূষণ-সহ, খাবারের অপ্রতুলতা ও বিভিন্ন অসুখে জর্জরিত হয়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। 

তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে এসকল বিষয়গুলোতে সরকারের সতর্কতা এবং বিভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনার কারণে পরিবর্তন আসলেও, যানজটের ভয়াবহ অবস্থা শহরবাসীর জন্য রীতিমত দুঃস্বপ্নের  কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই ভয়াবহ এই যানজটের অবস্থায় পরিবর্তন আনতে সরকার গত ১৫ বছরে ঢাকায় উড়ালসেতু নির্মাণ করেছে মোট ৭টি।   

ঢাকা শহরের যানজট কমিয়ে আনতে এই উড়ালসেতু গুলোর প্রভাব এবং এই উড়ালসেতু গুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকছে এই ব্লগে। 

মহাখালী উড়ালসেতু 

মহাখালী উড়ালসেতু বাংলাদেশের প্রথম উড়ালসেতু হিসেবে পরিচিত। ২০০৪ সালে যা চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, গুলশান এবং বনানী যেতে যে মারাত্মক যানজটের সম্মুখীন হতে হয়, তা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ঢাকার সবচেয়ে যানজট পূর্ণ এলাকায় এই উড়ালসেতুটি নির্মাণ করা হয়। যা কিনা মহাখালীর অতিরিক্ত যানজটের চাপকে বেশ উল্লেখযোগ্যভাবেই কমিয়ে দিয়েছে। 

১.১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়ালসেতুটির মোট ১৯টি গার্ডার বক্স স্প্যান রয়েছে। এছাড়া ২.৫ মিটার প্রশস্ত ২টি লেন এবং হাঁটাচলার জন্য সেতুর দুইপাশে ০.৬ মিটারের ফুটপাথ রয়েছে। 

খিলগাঁও উড়ালসেতু 

খিলগাঁও উড়ালসেতু
ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে উড়ালসেতু গুলোর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে

২০০১ সালের ২রা জুন তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম উড়ালসেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে এর নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়েছিল ২০০৫ সালে, যার ফলে এটি ঢাকার দ্বিতীয় উড়ালসেতু হিসেবে পরিচিতি পায়। 

এই উড়ালসেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ১,৮৯৯ কিলোমিটার এবং এর প্রস্থ ১৪ মিটার। আর প্রধান ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ৭৮৮ মিটার। অন্যদিকে রাজারবাগের দিকে ব্রিজটির দৈর্ঘ্য হল ২২২ মিটার, মালিবাগে ২০২ মিটার এবং সায়েদাবাদ অংশে এর দৈর্ঘ্য ২২০ মিটার। 

এই উড়ালসেতুটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সবুজবাগ, মাদারটেক, কদমতলী, বাসাবো, রাজারবাগ, সিপাহীগঞ্জ, মেরাদিয়া এবং গোড়ান এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থাকে আরও সহজ করেছে। এমনকি পুরো ঢাকা শহরের যানজটের উপর এর প্রভাব লক্ষণীয়।  

কুড়িল উড়ালসেতু 

কুড়িল উড়ালসেতু
কুড়িল উড়ালসেতুর কারণে উত্তরা থেকে দ্রুত সময়ে যাতায়াত সম্ভব হচ্ছে

যান চলাচলের জন্য ২০১৩ সালের আগস্টের ৪ তারিখ কুড়িল উড়ালসেতুটি উন্মুক্ত করা হয়। যা অত্র এলাকার যানজট প্রায় শূন্যে কমিয়ে আনে। প্রগতি সরণির লেভেল ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮৭টি ট্রেন পার হয়, যা কিনা এই রাস্তার যানজটের অন্যতম কারণ। 

প্রায় ১২.৭ একর জমির উপর নির্মিত ৩.১ কিলোমিটার উঁচু এই উড়ালসেতুটির রয়েছে ৪টি লুপ। এর মধ্যে ২টি ইংরেজি ‘Y’ and অন্য ২টি ‘U’ এর মতো করে করা। শহরের পশ্চিম অংশ থেকে আসা যাত্রীরা সাধারণত ১ নম্বর লুপটি ব্যবহার করে প্রগতি সরণি এবং পূর্বাচল যাওয়ার জন্য। অন্যদিকে প্রগতি সরণি এবং এর আশেপাশের এলাকার মানুষরা নিকুঞ্জ যাওয়ার জন্য ব্যবহার করেন ২ নম্বর লুপটি। 

বনানী এবং এয়ারপোর্ট রোডের পশ্চিম অংশ থেকে প্রগতি সরণি যাওয়ার জন্য অন্য ২টি লুপ ব্যবহার করা হয়। পূর্বাচলের যাত্রীরা বনানী যাওয়ার জন্যও এই লুপগুলো ব্যবহার করে থাকেন।  

মিরপুর এয়ারপোর্ট রোড উড়ালসেতু 

ঢাকার উড়ালসেতু এর মধ্যে এই উড়ালসেতুটি নির্মাণের আগে মিরপুরবাসীদের মহাখালী এবং বনানীর ভয়ংকর যানজট পাড়ি দিয়ে এয়ারপোর্টে এবং শহরের উত্তর প্রান্তে যাতায়াত করতে হতো। তবে ২০১৩ সালের মার্চের ২৭ তারিখ এর নির্মাণ শেষে, এই উড়ালসেতুটি এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য বিজয় সরণি হয়ে ঘুরে ৮ কিলোমিটারের রাস্তার দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটারে কমিয়ে দিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া সহজ করে দেয়। 

গুলশান-বানানীতে যারা বসবাস করেন তাদের জন্য মিরপুর যাওয়া এখন সুবিধাজনক হয়েছে এই উড়ালসেতুর কারণে। এমনকি এয়ারপোর্ট থেকে মিরপুর বা পল্লবী যাওয়াও বেশ সহজ হয়েছে এই উড়ালসেতুটির কারণে। মাটিকাটা থেকে জিয়া কলোনির এয়ারপোর্ট রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ১.৮ কিলোমিটারের এই উড়ালসেতুটি মিরপুর, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, উত্তরা, বনানী, গুলশান এবং মহাখালীর মধ্যকার যান চলাচল সহজ করার লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। 

মেয়র হানিফ উড়ালসেতু 

২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতুটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেয়া হয়। ৫.৫ কিলোমিটারের প্রধান উড়ালসেতুটি মূলত ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) থেকে নিমতলী পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কাপ্তানবাজার এবং গুলিস্তান হয়ে বিস্তৃত। যা কিনা ঢাকার সবচেয়ে দীর্ঘতম উড়ালসেতু হিসেবে পরিচিত। 

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নামানুসারে এই সেতুর নামকরণ করা হয়েছে। এই উড়ালসেতুটি রাজধানীর সাথে দক্ষিণপূর্বের ৩২টি জেলার দ্রুত এবং সহজ সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এমনকি সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, টিকাটুলি, গুলিস্তান এবং ফুলবাড়িয়া এলাকার যানজট নিরসনে এই উড়ালসেতুর বেশ ভূমিকা রয়েছে। এটিই দেশের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ স্কিমে নির্মাণ করা সেতু, যা যাতায়াতের জন্য ব্যবহারে নির্দিষ্ট পরিমাণ টোল পরিশোধ করতে হয়।   

মগবাজার-মৌচাক উড়ালসেতু 

মগবাজার-মৌচাক উড়ালসেতু
মগবাজার রোডের উপর দিয়ে গেছে মগবাজার-মৌচাক উড়ালসেতুটি

এই উড়ালসেতুর কাজ সম্পূর্ণভাবে শেষ করতে প্রায় ৬ বছর সময় লেগেছিল। তবে নির্মাণ কাজ শেষে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ যখন যাতায়াতের জন্য উড়ালসেতুটি খুলে দেয়া হয়, তখন দেখা গেল সেতুর নকশায় বেশ বড় ধরনের ত্রুটি রয়ে গেছে। পরবর্তীতে ঢাকার উড়ালসেতু এর মধ্যে এই সেতুটিতে  যাতায়াত ১ বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং অবশেষে ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর একেবারে খুলে দেয়া হয়।  

৮.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়ালসেতুটির বিভিন্ন লুপগুলো ঢাকার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যেমন- তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, সোনারগাঁও হোটেল, মগবাজার, রমনা, বাংলামটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও শান্তিনগর মোড়ের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। যে কারণে এই এরিয়া সমূহের ট্রাফিক জ্যাম তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। 

বিজয় সরণি – তেজগাঁও লিংক রোড উড়ালসেতু 

বিজয় সরণি - তেজগাঁও উড়ালসেতু
এই উড়ালসেতুটি তেজগাঁওকে সরাসরি বিজয় সরণির সাথে সংযুক্ত করেছে

১,১১৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৬০ মিটার প্রস্থের এই ফ্লাইওভারটি ঢাকার উড়ালসেতু গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোট। নাম শুনলে যেমনটা মনে হতে পারে যে এটি একটা রাস্তা যা কিনা বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও এর মাঝে সংযোগ স্থাপন করেছে, তবে এটি মূলত একটি উড়ালসেতু। এই উড়ালসেতুটি চালু হওয়ার আগে এ পথ ব্যবহারকারীদের মূলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহাখালী অথবা কারওয়ান বাজারের জ্যাম পার করে তেজগাঁ শিল্পাঞ্চল এলাকায় পৌঁছাতে হতো। 

উড়ালসেতুর কারণে আমাদের ট্রাফিক সিস্টেমে বেশ কিছুটা পরিবর্তন আসলেও, শহরের রাস্তার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে এই ঢাকার উড়ালসেতু গুলো আসলে যথেষ্ট নয়। প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে শহরের বিভিন্ন পথের জ্যামের এই চিত্র ক্রমেই আরও বেড়ে যাচ্ছে। আর তাই এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনতে বা আরও উন্নত ব্যবস্থা করতে অতি শীঘ্রই পুনঃনির্মানের ব্যবস্থা করা উচিত।    

Write A Comment

Author