Reading Time: 5 minutes

খুব বেশি আগের কথা নয় এইতো সেদিনও ঢাকা শহরটা ছিল বেশ ছোট আর নির্মলতায় পরিপূর্ণ। সুবিশাল সবুজে ঘেরা রাস্তাঘাটগুলো ছিল অবাক করা। আজকের মতই কিছুই ছিল না তখন। দেশের রাজধানী হওয়ার কারণে অধিকাংশ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এখানেই হয়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ঢাকা বাংলাদেশের হৃদয় কিংবা মধ্যমণি। রিয়েল এস্টেট সেক্টর সেই একই সাথে বড় হচ্ছে যার কারণে ঢাকার সীমানা বেড়ে গেছে আরও বহুগুণে।  

আজকের এই ঢাকার প্রাথমিক পরিকল্পনাটা কিন্তু এমন ছিল না। চারদিক খোলামেলা এবং সুবুজে ঘেরা একটি আবেশ থাকবে, যেখানে মানুষ প্রকৃতির মাঝে একটু শান্তির প্রশ্বাস নিবে। বেড়ে ওঠা জনসংখ্যা এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো একটু একটু করে আবাসিক ঢাকার পরিকল্পনাটি বদলে দিয়েছে। আবাসিক পরিকল্পনাতেও এসেছে নানান পরিবর্তন। খেলার মাঠ এবং পার্কগুলো আর তেমন দেখা যায় না। পার্ক আর খেলার মাঠের সংরক্ষিত জায়গায় গড়ে উঠছে বহুতল ভবন কিংবা বাণিজ্যিক কোন ভবন। এমনকি বাড়ির সামনের বারান্দাগুলো এখন আর তেমনভাবে নেই। অসংখ্য আকাশচুম্বী বহুতল ভবনের ভীড়ে এমন খোলামেলা বাড়িগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। একটি দেয়ালের সাথে ঘেঁষে আর একটি দেয়াল যেখানে জায়গা করে নিচ্ছে সেখানে এক ইঞ্চি জায়গা আশা করাও যেন বিলাসিতা। রোজকার আবাসন চাহিদা মেটানোয়, ব্যবসা বাণিজ্য বাড়ছিল, নতুন সব রেস্তোরা ও ক্যাফে খলা হচ্ছিল। একে একে সে সময়ের ঢাকা আজকের ঢাকা হয়ে উঠছিল। এবং ভুলতে বসেছিল নিজের খোলামেলা প্রাণখোলা পরিবেশ। ফুলে ভরা বাগান, বাতাস ছুঁয়ে যাওয়া বারান্দা এবং আকাশ দেখে গল্প করা যায় এমন ছাদ সকলেই হারিয়ে ফেলেন। কতই না মধুর সময়ে সেখানে কেটেছে আমাদের, বন্ধুদের সাথে চায়ের আড্ডা কিংবা শীতের দুপুর কতশত স্মৃতি সেখানে রয়েছে। সেই স্মৃতির পথ ধরেই আজকে কথা হবে ঢাকার ছাদ নিয়ে, ছাদের সব গল্প নিয়ে! 

ঢাকার যত ছাদ 

ছাদ
রাতের ঢাকার ছাদ

ঢাকার বাসিন্দারা রোদ পোহাতে কিংবা বাতাসা খেতে বা নিজের মত করে সময় কাটাতে বাইরে কোথাও ছোটার আগে যেখানে গিয়ে পাড়ি জমাবেন সেটা হচ্ছে “ছাদ”।  ঢাকার ছাদ গুলো বেশিরভাগ সময় ব্যবহৃত হয় কাপড় শুকানো, মশলা বা আচার শুকানো কিংবা ছোট ছোট গাছের বাগান করার জন্য। মানুষ বাড়ার সাথে সাথে ঢাকার ছাদগুলো আমাদের ব্যক্তি জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীবন থেকে একটু সময় নিয়ে নিজের মত করে ফ্রেশ হতে পার্ক আর খেলার মাঠের চাহিদাও বেড়ে উঠছিল। কিন্তু আমরা আমাদের ছোট খাটো বাসাতেই বেড়ে উঠি। খোলামেলা পরিবেশ না পেয়ে আপন করতে থাকি বহুতল ভবনের ছাদগুলোকে। এই ছাদগুলোই আমাদের জীবনের এক  জরুরী অংশ হয়ে ওঠে। সেই ছোট থেকেই এই বন্ধন টা শুরু হয় কিভাবে আমি বলছি… 

শৈশব যেখানে কেটেছে 

ছাদে ক্রিকেট খেলা
ছেলেবেলার সেই সময়

আমাদের বাবা-মা রা হয়তো গল্পের ছলে অনেক সময় বলে উঠেন, যে তারা ছোটবেলায় অনেক খেলাধুলা করতেন। খোলামেলা পরিসরে সময় কাটাতেন। খেলতেন ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল কিংবা কাবাডি। এই সমস্ত খেলাগুলো  এলাকার সবাই মিলে খেলতেন। তাদের সময়ের মাধুর্য্যই ছিল ভিন্ন। কিন্তু আমাদের ছোট বেলার দৃশ্যটা এমন ছিল না। খেলার জন্য বড় কেন ছোট মাঠও ছিল না। সবুজের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য ছিল না পার্ক। ছোটবেলায় যারা চমৎকার সময় কাটিয়েছিলেন সেই আমাদের বাবা মায়েরাই পাশের মাঠে খেলতে দেবে এমন ভাবনায় ও ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু শিশুমন খেলতে তো চাইবেই। প্রতিবেশি বন্ধুদের নিয়ে সবাই তখন এই ছাদে উঠেই খেলতে যেত। 

বাচ্চারা তাদের বেশিরভাগ খেলাই ছাদে খেলতে পারত। ক্রিকেটের মত বড় খেলার জন্য প্রয়োজন বড় জায়গার। অস্ট্রেলিয়া বাড়ির পেছনে উঠান থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে সব দেশেই শিশুরা শর্ট পিচে বাড়ির আশেপাশে ক্রিকেট খেলা শুরু করে। এই বুদ্ধিটি অনেকে অনুসরণ করে ঢাকার ছাদ এ ক্রিকেট খেলা শুরু করে। শুধু ক্রিকেট খেলায় আবদ্ধ নয়, শীতের রাতে খেলা হত ব্যাডমিন্টন। এভবেই ছাদ বাচ্চাদের জীবনে হয়ে ওঠে এক অনন্য খেলার মাঠ। 

কৈশোর যেখানে কেটেছে

বন্ধুদের সাথে ছাদে
বন্ধুদের সাথে কাটানো কিছু সময়

ঢাকার ছাদগুলোতে যাদের শৈশব কেটেছে তারাই জানবে কৈশোর তাদেরকে কিভাবে আপন করে নিয়েছিল। কৈশোরে পা রাখার স্মৃতির সাথে ছাদের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। বড় হবার এই সময়টি পার হতো মন ভাঙ্গা এবং গড়ার মধ্য দিয়ে।  যেন হুট করে সব কিছু খুব বেশি অনুভব হতে লাগে। মনের ভেতর অচিরেই আনাগোনা করে বিদ্রোহ। নিজের অজান্তে প্রতিনিয়ত আমরা মুক্ত হতে চাইতাম। তখন এই ছাদগুলোই আমাদের পালিয়ে বেড়ানোর একমাত্র অস্ত্র ছিল। বাসার ছাদ তখন হয়ে উঠত নিজের একান্ত আপন ভুবন। সমাজের নজরদারী থেকে একটু আঁড়ালে গিয়ে একদম নিরিবিলি নিজের মত করে সময় কাটানো। কৈশোর এমন একটা সময় যেখানে কিশোর কিশোরী তাদের সৃজনশীলতায় এই পৃথিবীকে নতুন করে আবিস্কার করবে। নিজের মত করে আকাশ দেখে, গুনগুন করে গাইবে একই সুর। যেখানে থাকবে শুধুই আকাশের মত বিশালতা।  

যৌবন কেটেছে যেখানে 

সন্ধ্যার আকাশে
যৌবনের এই সময়ে

জীবনের আনন্দের সকল পর্যায় আমরা পেরিয়ে পৌঁছে গেছি জীবনের এক অদম্য প্রান্তে। যেখানে সবকিছুর সমীকরণ এসে মিলে যায় স্বাধীনতায়। তারুণ্য এমনই। সাহস থাকবে, এগিয়ে যাওয়ার উদ্যম থাকবে। জীবন নিয়ন্ত্রণে চলুন আর নাই বা চলুক তাকে নিজের মত করে এগিয়ে নিতে সকলের যুদ্ধ। জীবনের এই সময়টাতে আপনি অনেক স্ট্রেসে থাকেন। নিজের ক্যারিয়ার নিজের ভবিষ্যৎ সবকিছু নিয়েই এক প্রকারের অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। এমন অস্থিতিকর পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য আমরা ছুটে যাই খলা আকাশের নিচে। কিংবা আমাদের বাসার ছাদে। যেখানে নিরিবিলিতে বসে জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমরা নিয়ে নেই। দিনের বেলার ছাদ মুখরিত থাকে ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে, তারা খেলাধুলায় মগ্ন হয়ে থাকে। দিনের আলো পরতে শুরু করলে একটু একটু করে বাড়তে থাকে বড়দের ভিড়। যার যার কাজ শেষ করে একটু বাতাস আর আকাশ দেখতে সকলে এসে বসে। এই সুযোগে প্রতিবেশিদের সাথে সাক্ষাতের একটা সুযোগ যেমন হয় তেমনি আড্ডায় মেতেও ওঠা হয়। ছাদে গিয়ে হাতে এক কাপ কফি নিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন ভাবলেই যেন সব প্রশ্ন তার উত্তর খুঁজে পায়। নতুন বন্ধু বানানোর সাথে সাথে পুরনো বন্ধুদের মিলনমেলা সবকিছুই হয় এই ছাদে। নতুন বছরকে আগলে নেওয়ার উৎসবে যখন আতসবাজি ফুটানো হয় তখন সকল বয়স ভেদে সকলের জন্য এ এক অদ্ভুত সময়ের তৈরি হয়। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদের মানুষেরা প্রতিনিয়ত করে যায় আতশবাজির প্রতিযোগিতা। ছাদের এক কোণায় এত জীবন ও থাকে! ভাবা যায়?  

বার্ধক্য কেটেছে যেখানে

সকালের ছাদ
আনন্দের যে সময়টা এখানে কাটে

বার্ধক্য না বলে যদি বলি গোধূলি সময়! দ্রুত ছুটে চলা পৃথিবী একটা সময় আপনার কাছে থেমে আসবে। তখন নিজেকে বেশ একা লাগবে। আর এমন সময়ে আপনার বাসার ছাদটি হয়ে উঠতে পারে আপনার একান্ত বন্ধু। যেখানে আপনি নিজের সকল শখগুলোকে পেলে পুষে বড় করবেন। নিজের সময় থেকে এই শখগুলোতে সময় দিবেন। আগেই বলা হয়েছে যে ঢাকার পার্ক এবং খেলার মাঠগুলো বিলীন হয়ে আসছে। সুতরাং, বার্ধক্য সময়ে হাঁটা চলা কিংবা ব্যায়াম সবকিছু বাইরে গিয়ে করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। অনেকের বাসার কাছে পার্কও থাকে না, তারা আবার রাস্তায় হাটাহাটি করেন। অনেকে আছে বাসার ছাদে গিয়ে হাটতে পছন্দ করেন। নিজের মত করে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। এই একই সুযোগে সকলের সাথে গল্প কিংবা নতুন করে বন্ধুত্ব করাও হয়। ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খেলাও হয়। মানে আপনার একা একা কাটানো বিকেলটা আর একার থাকে না। হয়ে যায় সকলের। 

আপনি যে বয়সেরই হোন না কেন! ঢাকার ছাদগুলো আপনাকে আপন করে নেবে। সব বয়সী মানুষেরই কমবেশি স্মৃতি আছে ঢাকার ছাদগুলোর সাথে। আপনার কোন বিশেষ স্মৃতি থেকে থাকলে অবশ্যই তা আমাদের সাথে শেয়ার করুন। কমেন্টে জানিয়ে দিন।

Write A Comment