দুর্গাপূজা যতোটা না সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব তার থেকে অনেক বেশি বাঙালির আনন্দ আর উদযাপনের উপলক্ষ্য। অন্তত আমাদের দেশের আবহমানকাল ধরে প্রবাহিত বাঙালি সংস্কৃতি তাই বলে। তবে, দুর্গা পূজা মানেই কেবল রঙিন উৎসব আর ঢাকের আওয়াজ নয়। সনাতন ধর্মমতে, ‘ভালো সবসময় মন্দের উপর বিজয়ী’ এই প্রতিপাদ্যকে স্মরণ করে দিতেই প্রতি শরতে মহালয়ার মধ্য দিয়ে ফিরে আসে শুভ শারদীয়া, আবির্ভাব ঘটে দেবী দুর্গার। ষষ্ঠীর দিন থেকে দেবী দুর্গার এই আবির্ভাবকে ঘিরে মূল উৎসব আর পূজা উদযাপিত হয়। পরবর্তী তিন দিন দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী, এই তিনরূপসহ আরো অসংখ্য রূপে পূজিত হন মহামায়া।
তার আগমন মানেই উদযাপনের সব থেকে বড় উপলক্ষ্য। পরিবেশে তখন যেন নতুন সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি হয়। জীবনে যুক্ত হয় আরো কিছু নতুন রঙ। লাল পাড় সাদা শাড়ি, কপালে সিঁদুর আর দুর্গা প্রতিমার মুখ, মনে করিয়ে দেয় বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতির কথা। তার অনুষঙ্গ হিসেবে আরো যোগ হয় শাঁখের আওয়াজ, দেয়াল ও মেঝেজুড়ে রঙ বেরঙের আল্পনা, কিংবা ঢাকের তালে তালে বাঙালির মন মাতানো ধুনুচি নাচ। বাংলাদেশে এই আচার-অনুষ্ঠান কেবল সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে কিংবা মন্দিরে সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। রাজধানী ঢাকাও তার ব্যতিক্রম নয়। বড় বড় পূজা মন্ডপ আর সাজ সাজ রবে আন্দোলিত হয় ঢাকা আর ঢাকাবাসী। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ ঘুরে বেড়ান মন্ডপ থেকে মন্ডপে। বিস্মিত হন মন্ডপগুলোর মোহময় সৌন্দর্যে। ২০২১ এ এসেও মন্ডপগুলোর সেই আবেগ আর ঐতিহ্য তিল পরিমাণও কমেনি। তাই তো, নানা থিমে ঢাকা শহরের নানা স্থানে এবারেও মহাসমারোহে মন্ডপগুলোতে উদযাপিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। তাহলে, ঢাকার দুর্গা পূজা মন্ডপ গুলোর মধ্য থেকে চলুন আজকে ঘুরে আসি সেরা ৫টি পূজা মন্ডপ থেকে।
ঢাকেশ্বরী পূজা মন্ডপ
ঢাকেশ্বরী রোডের পাশে অবস্থিত, ঢাকেশ্বরী মন্দির বাংলাদেশের প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর মধ্যে একটি। ধারণা করা হয়, “ঢাকার ঈশ্বরী” (যিনি রক্ষা করেন) অর্থ বুঝাতেই এই মন্দিরটির নামকরণ করা হয়েছে “ঢাকেশ্বরী”। রাজা বল্লাল সেন ১২০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে, এই ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মন্দিরও। তাই স্বাভাবিকভাবেই, দুর্গাপূজার সময়ে এই মন্দিরকে ঘিরে মন্ডপ নির্মাণ ও উৎসবের ঘনঘটা থাকে অনেক বেশি। মহালয়া থেকে বিজয়া দশমী, দুর্গা পূজার পুরোটা সময়জুড়ে হিন্দু ধর্মালম্বীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে কাটান। দেবী দুর্গার আগমনের আগে পুরো মন্দির এলাকা প্যান্ডেল এবং অন্যান্য ঐlতিহ্যবাহী সাজসজ্জার উপকরণে চমৎকারভাবে সজ্জিত হয়। এই সময়ে স্বনামধন্য তারকা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ ঢাকার প্রাচীন এই মন্দিরটির পূজা মন্দপ দর্শনে আসেন এবং অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যুক্ত করেন দুর্গা পূজার এক অন্য রকম রোমাঞ্চ।
বনানী পূজা মন্ডপ
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গা পূজাকে ঘিরে ঢাকেশ্বরীর পূজা মন্ডপটিই সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রে থাকে, তবে ঢাকার দুর্গা পূজা মন্ডপ গুলোর মধ্যে সেরার তালিকায় শুরুতেই রাখতে হবে বনানী পূজা মন্ডপকে। কমার্শিয়াল হাব হিসেবে বিখ্যাত এই এলাকাটির পূজা মন্ডপটিও যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল হবে, সেটিই স্বাভাবিক। তাই সব থেকে ব্যয়বহুল এই মন্ডপটিকে ঘিরে মানুষের আগ্রহও সবথেকে বেশি। প্রতি বছর, দুর্গা পূজার আগে থেকেই গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা পরিষদ বনানী খেলার মাঠে এই অস্থায়ী পূজা মন্ডপটি তৈরির উদ্যোগ নেয়। এটি ঢাকার দুর্গা পূজা মন্ডপ গুলোর মধ্যে সব থেকে জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গা পূজা মন্ডপ। এজন্যই সারা দেশ থেকে দর্শনার্থীরা পূজা-অর্চনা করতে আসেন, এর সৌন্দর্য ও আলোকচ্ছটায় উদ্বেলিত হন। সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জার এ ঘনঘটা আরো বেশি নজর কাড়ে। তাই, যদি আপনি এই উৎসবে “মা ষষ্ঠী পূজা” করতে চান, তাহলে বনানীর এ পূজা মন্ডপটি আপনার জন্য আদর্শ।
খামারবাড়ি পূজা মন্ডপ
প্রতি শরতে, ঢাকার বাকি সব আলোচিত মন্দিরগুলোর মতো, খামারবাড়ি মন্দিরও দুর্গা পূজার সময় নতুন রূপে সজ্জিত হয়। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (কেআইবি) ঠিক পাশেই অবস্থিত এটি। মন্দিরটির সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হচ্ছে, এর অসাধারণ আলোকসজ্জা এবং প্রতিমা স্থাপন। এ বছরেও, মন্দিরের প্রবেশদ্বার থেকে প্রতিমা এবং মন্দিরের অভ্যন্তরীণ সবকিছু অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, যাতে মণ্ডপে আসা-যাওয়ার সময়ে জনসাধারণের অসুবিধা না হয়। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে, ৬ষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সাথে পালিত হয় এবং অসংখ্য সনাতন ধর্মের মানুষ এই আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে মন্ডপে উপস্থিত হন।
উত্তরা পূজা মন্ডপ
সম্ভবত উত্তরার সবচেয়ে বড় মন্ডপটি সেক্টর ৩ এ অবস্থিত ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠে নির্মিত হয়। ঢাকার দুর্গা পূজা মন্ডপ দর্শনে, উত্তরাবাসীদের জন্য সেরা চমক এটি। রাস্তা এবং আশেপাশের সবকিছু রঙিন মূর্তি, ব্যানার এবং নিয়ন লাইটে পরিপূর্ণ থাকে। মন্দিরের চারপাশে সজ্জিত থাকে ছোট ছোট অস্থায়ী খাবারের স্টল। মন্ডপের ভিতরে দেবী দুর্গার বিশাল প্রতিমার পাশাপাশি গণেশ এবং অন্যান্য অবতারের বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হয়। দুর্গা পূজার সময়ে, আপনি যদি ঢাকার কাছাকাছি ঘুরতে যাওয়ার জায়গা খোঁজেন, তাহলে নিঃসন্দেহে এই মন্ডপে চলে আসতে পারেন। দেবী দর্শন এবং চমৎকার কিছু মূহুর্ত উদযাপন করতে এই মন্ডপটি আপনাকে হতাশ করবে না, কথা দিচ্ছি।
শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির
বাজেটের মধ্যে কেনাকাটা করতে জনপ্রিয় মৌচাক মার্কেট। যার খুব কাছেই সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় অবস্থিত শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, যা কিনা ঢাকার দূর্গা পূজা মন্ডপ গুলোর মধ্যে অন্যতম দৃষ্টিনন্দন দর্শনীয় স্থান। এটি যেহেতু কালী মন্দির, তাই প্রতি বছর দেবী দুর্গার অস্থায়ী মন্দিরের জন্য এই এলাকাটিকে বরাদ্দ করা হয়। তবে, এই মন্ডপে দুর্গা প্রতিমাকে ঘিরে যে সাজসজ্জা, তা অবধারিতভাবেই আপনাকে বিস্মিত করবে। এমনকি সিদ্ধেশ্বরীর এই রাস্তাটি ধরে যাবার সময়য়, যে কোনো পথচারী দুর্দান্ত এই মন্ডপটির দিকে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও ঘুরে তাকাতে বাধ্য হবেন, এর নয়ানাভিরাম সাজসজ্জার জন্য। বাকি বছরগুলোর মত এবারেও টানা পাঁচ দিনব্যাপী পুজো-অর্চনার আয়োজন চলছে এই মন্ডপে যাকে ঘিরে মানুষের উত্তেজনারও কমতি নেই। ভিড়ের মাঝে থেকেও ঢাকের তালে আর বর্ণিল রঙে সবাই যে যার মতো করে, বরণ করেন শক্তির দেবী দুর্গাকে। তাই আপনিও যদি চান, দেবী দুর্গার সেই শক্তিকে নিজের মাঝে ধারণ করতে, তাহলে পূজোর ৫দিনের যে কোনো একদিন আপনাকে ঘুরে আসতে হবে সিদ্ধেশ্বরীর দুর্গা পূজা মন্ডপ থেকে।
বাঙালি হিসেবে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে এই উৎসবগুলোকে লালন করি। এটি কেবল ধর্মীয় উদযাপনই নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতিরও মূল্যবান এক অংশ। যার প্রভাব রয়েছে আমাদের লোকসংস্কৃতি থেকে শুরু করে নাগরিক সংস্কৃতির নানা দিকে। তাই বাঙালি সংস্কৃতির অসাধারণ এই উৎসবকে আপনি যদি এড়িয়ে যেতে না চান, তাহলে এ বছরেই ঘুরে আসুন ঢাকার দুর্গা পূজা মন্ডপ গুলো থেকে আর শুভ শারদীয়াকে উপভোগ করুন নিংড়ে নিংড়ে।