Reading Time: 3 minutes

ঢাকা, দেশের রাজধানী এবং মেগাসিটি। বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশিষ্ট শহরের একটি ঢাকা। চারিদিকে নদীবেষ্টিত প্রায় ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে ২ কোটির অধিক মানুষের বাস। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা তীরের এই তল্লাটে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বাস। এমন জনবহুল শহর থাকবে নানান নাগরিক সমস্যায় জর্জরিত তা সহজেই অনুমেয়। আর তেমনই একটি সাধারণ সমস্যা হল চিত্তবিনোদনের স্থান এবং খেলার মাঠের অভাব। ঢাকায় খেলার মাঠ খুঁজে পাওয়া যেন অসম্ভবেরই নামান্তর। চলুন দেখে নেয়া যাক ঢাকা শহরে খেলার মাঠের হালহকীকত এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা কী ভাবছেন ঢাকায় খেলার মাঠ বা চিত্তবিনোদনের স্থানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। 

ঢাকা শহরে খেলার মাঠঃ আদর্শ বনাম বাস্তবতা

পার্ক
ঢাকায় আছে অল্প কিছু পার্ক ও খেলার মাঠ

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বসবাসের জন্য আদর্শ একটি শহরের প্রতিটি বাসিন্দার জন্য কমপক্ষে ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা থাকা দরকার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০ হাজার মানুষের বাস করা ঢাকা শহরে সেই সংখ্যাটি আশংকাজনকভাবে কম, মাত্র ১ বর্গমিটার। এ থেকেই অনুমান করা যায় ঢাকা শহরে খেলার মাঠের কেমন অবস্থা। জনসংখ্যার হিসেবে যে শহরে থাকার কথা ১৩০০ খেলার মাঠ, কাগজে কলমে সে শহরের দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে আছে কমবেশি ২৫০টির মত খেলার মাঠ! অর্থাৎ সকল শ্রেণী-পেশা, লিঙ্গ ও বয়সের মানুষ যে খেলাধুলা, হাঁটাহাঁটি করবে এমন জায়গার রয়েছে তীব্র সংকট এই ঢাকা শহরে। এই শহরে অপরিকল্পিত ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠেছে একাধিক ওয়ার্ড যেখানে একটিও মাঠ নেই।  

ঢাকায় খেলার মাঠ – আসলেই কি সবাই খেলতে পারছে সেখানে?

বেড়া
মাঠ থাকলেও সেখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত

যদিও কাগজে কলমে ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছে ২৫০টির মত মাঠ আছে তবে বাস্তবতা হলে এর সিংহভাগেই প্রবেশের অনুমতি নেই জনসাধারণের। বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা কলোনীর তত্ত্বাবধানে থাকায় সেগুলোর ব্যবহারের অনুমতি পায় হাতেগোনা কিছু নাগরিক। বাস্তবিকভাবে জনসাধারণের প্রবেশ এবং খেলাধুলার অনুমতি আছে, সিটি কর্পোরেশনের হাতে ঢাকায় এমন উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা কমবেশি মাত্র ৫০টির মত। ২ কোটি মানুষের জন্য ৫০টি মাঠ, অসামাঞ্জস্য তো বটেই! আর এর বাইরে আছে মাঠ দখলের ব্যাপারটি। ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশানে একসময় প্রতিটি রোডে আলাদা আলাদা মাঠ ছিল যার অস্তিত্ব এখন আর নেই। বিভিন্ন সময় এই মাঠগুলো দখল হয়েছে, বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আবাসিক ভবনের। 

কংক্রিটের শহরে খেলার মাঠের সংকট – ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শঙ্কা

মোবাইল আসক্তি
নতুন প্রজন্মের মোবাইল আসক্তি অনেকের জন্যই মাথাব্যাথার কারণ।

এ যুগের অনেক বাবা-মায়েরই খুব কমন একটি অভিযোগ হল, তাদের সন্তান হয় মাত্রাতিরিক্ত দুরন্ত অথবা প্রচন্ড অন্তর্মুখী। ঘরকে অগোছালো করে তছনছ করে রাখতে তাদের জুড়ি মেলা ভার, অথচ বাসায় নতুন মেহমান আসলে তাদের সাথে পরিচিত হতে বাচ্চাদের রাজ্যের অনীহা। অনেক বাচ্চা বা কিশোর আছে যারা কোনদিকেই তেমন মনোযোগী না। অনেক বাচ্চার ধ্যানজ্ঞান এবং পুরোদুনিয়াটা মোবাইলের স্ক্রিনে আবদ্ধ। মোবাইলে গেমস খেলা এবং ইউটিউব দেখেই কেটে যাচ্ছে তাদের শৈশব। টিকটক, ফ্রি ফায়ার, পাবজির নেশায় পরে অনেক কিশোর বিপথগামী হয়েছে এমন উদাহরণও চোখের সামনে আসছে।
অভিভাবকেরা এসকল বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন, কী হতে পারে সমধান তা ভেবে ভেবে হয়রান। অথচ পর্যাপ্ত খেলার মাঠ থাকলে এসকল সমস্যার উদ্ভবই হত না বলে ধারণা অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের। খেলার মাঠ যে শুধু শারীরিক কসরতের জায়গা তাই নয় বরং মানসিক বিকাশের একটি বড় ক্ষেত্রও বটে! খেলাধুলার সাথে সাথে অন্যদের সাথে ভাববিনিময় এবং জীবনমুখী অনেক কিছু শেখা যায় খেলার মাঠ থেকে, যা কোনদিনও মোবাইলের স্ক্রিন কিংবা চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে শেখা সম্ভব নয়।    

কী ভাবছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা?

খেলার মাঠ মানেই কি দিগন্তবিস্তৃত উন্মুক্ত প্রান্তর হতে হবে? বিশেষজ্ঞদের উত্তর – না। আর শহরকেন্দ্রিক জীবনে তা হওয়াটাও বাস্তবসম্মত না। নগর-পরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকায় খেলার মাঠ যেগুলো তা খুব বড় মাঠ হতে হবে, এমনটা আবশ্যক নয়। এলাকার মধ্যে ছোট ছোট খোলা জায়গা থাকলেই হবে। এমন জায়গা যা কোন নির্দিষ্ট কয়েকজন মানুষের জন্য সংরক্ষিত থাকবে না। বরং, সেখানে সব বয়সের, সব লিঙ্গের ও শ্রেণীপেশার মানুষ খেলাধুলা, হাঁটাহাঁটি করতে পারবেন।

বর্তমানে অনেক আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন হাউজিং প্রকল্পেও এ ধরনের পর্যাপ্ত মাঠ না থাকলেও আশার কথা হল, স্থপতিরা এই বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। তারা এখন এমনভাবে প্রকল্পের নকশা করছেন যেন বরাদ্দকৃত স্থানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। নকশায় তারা প্রথমেই একটি খেলার মাঠ আঁটানোর চেষ্টা করছেন। এরপর বাকি জায়গায় বিভিন্ন বয়সীদের জন্য বসার জায়গা, খেলার জায়গার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

নানান নাগরিক সমস্যায় জর্জরিত আমাদের এই ঢাকা। এই শহরকে বাসযোগ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। প্রয়োজন ইতোমধ্যেই দখল হয়ে যাওয়া সব মাঠ পুনোরুদ্ধার এবং আসছে নতুন প্রকল্পগুলোয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাঠের বরাদ্দ করা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মনে রাখার মত একটি শৈশব উপহার দিতে চাইলে এর বিকল্প নেই।

Write A Comment