Reading Time: 4 minutes

নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি

ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি 

অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা

তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা 

জসীম উদদীনের “নকশী কাঁথার মাঠ” এর এমন আখ্যান কোনো ভিনদেশী রূপকথা নয়। আবহমান কাল ধরে বাঙালি নারীরা এভাবেই প্রিয়জনের বিরহে নকশীকাঁথা বুনেছে। বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বজনের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাদের কাঁথার বুননে। সেই কাঁথা কেউ হয়তো পৌঁছে দিয়েছে প্রিয়জনের কাছে। কারো হয়তো “নকশীকাঁথার মাঠ” এর সাজুর মতো রুপাইয়ের হাতে কাঁথা তুলে দেয়ার সাধ অপূর্ণই রয়ে গেছে। নকশার নান্দনিকতা, নাকি এইসব আবেগ নকশীকাঁথাকে বাংলার লোকশিল্পের অনন্য অংশ করে তুলেছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু, সেলাইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে, কাঁথার শরীরে গ্রামবাংলার যাপিত জীবনের যে চিত্র, সেই শৈল্পিকতাকেও অগ্রাহ্য করবার উপায় নেই!  হারাতে হারাতেও, ফের কেন নানা রূপে, নানা ঢঙে ফিরে এসেছে নকশীকাঁথা? কী করে তা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার? আজকের ধারাপাত সেসব নিয়েই। 

প্রতি অঞ্চলের নকশীকাঁথারই রয়েছে আলাদা স্বকীয়তা

নকশীকাঁথার অঞ্চলকথন

সংস্কৃত শব্দ ‘কন্থা’ ও প্রাকৃত শব্দ ‘কথ্থা’ থেকে ‘কাঁথা’ শব্দের উৎপত্তি। এর আভিধানিক অর্থ ‘জীর্ণ বস্ত্রে প্রস্তুত শোয়ার সময়ে গায়ে দেয়ার মোটা শীতবস্ত্র বিশেষ’। অঞ্চলভেদে এদেশে কাঁথাকে খাতা, খেতা, কেথা বা কেতা নামেও ডাকা হয়। রংপুরে কাঁথাকে বলা হয় ‘দাগলা’। ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে বলা হয় ‘গুদুরি’। যে নামেই ডাকা হোক, এই কাঁথায় যখন সুনিপুণ হাতে সুঁই আর রঙ্গিন সুতার নকশা চড়ে, তখনই তা হয়ে যায় নকশীকাঁথা।  অনেক জায়গায় নকশীকাঁথাকে “সাজের কাঁথা” বা “নকশী খেতা” ও বলা হয়ে থাকে।কাঁথার প্রচলন দুই বাংলা জুড়েই আছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনাসহ প্রায় সব অঞ্চলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁথা বানানোর সংস্কৃতি। তবে প্রতি অঞ্চলের নকশীকাঁথারই রয়েছে আলাদা স্বকীয়তা। কাঁথার ফোঁড়, সেলাইয়ের কৌশল ও নকশার ব্যবহারই বলে দেয় কাঁথাটি কোন অঞ্চলের। রাজশাহী, বগুড়া ও কুষ্টিয়ার নকশীকাঁথা আকারে বড় ও পুরু, সেলাই তেমন সূক্ষ্ম নয়। এতে জ্যামিতিক নকশা ও ফুল, লতাপাতার নকশার ব্যবহারই বেশি। অন্যদিকে যশোর, ফরিদপুর ও খুলনা অঞ্চলের কাঁথা আকারে তেমন বড় নয় এবং পাতলা। সূক্ষ্ম সেলাইয়ে মানুষ ও পশুপাখির মোটিফ বেশি ব্যবহার করা হয় এ অঞ্চলে। অন্যদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে জনপ্রিয় পাঁচ রকমের কাঁথা- লহরী কাঁথা, সুজনী কাঁথা, লীক কাঁথা, কার্পেট কাঁথা ও ছোপটানা কাঁথা।

নকশীকাঁথার নকশা কথন

রাজশাহীতে বহুল প্রচলিত একটি নকশা হল পান পাতার লহরি

বাংলাদেশের প্রত্যেক অঞ্চলের নকশীকাঁথায় রয়েছে ফুল, ফল, লতাপাতা, বৃক্ষ ও জ্যামিতিক নকশার সমাহার। বেশির ভাগ কাঁথায় একটি মূল নকশা থাকে এবং এটাকে ঘিরে বাকি নকশাগুলো কখনো চারকোনায়, কখনো আটভাগে, বৃত্তাকারে থাকে। মূল মোটিফকে উজ্জ্বল করার জন্যই এমনটা করা হয়। এমন অনেক নকশা রয়েছে যা বাংলার ঘরে ঘরে হাজার বছর ধরে জড়িয়ে আছে। এর দার্শনিক উৎস ভারতীয় হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা ইসলাম ধর্মে। নকশীকাঁথার এমন কিছু নকশার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 

পদ্ম নকশা

নকশীকাঁথায় এই নকশাটি সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ে। সনাতন ধর্মে পদ্মফুল মানে স্বর্গীয় আসন। শাশ্বত আদেশ এবং আকাশ, মাটি ও পানির ঐক্য হিসেবেও মূর্ত এটি। একদিকে দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক, অন্যদিকে পবিত্রতারও প্রতীক। অষ্টদল থেকে শুরু করে শতদল বিভিন্ন ধরণের পদ্ম নকশা হয় পদ্মফুলের। পুরাতন প্রায় প্রতিটি কাঁথার কেন্দ্রে দেখা মেলে ফুটন্ত পদ্মফুলের নকশা।  

সূর্য নকশা

এই নকশাটি খানিকটা পদ্ম নকশার মতোই। অনেক নকশীকাঁথার মাঝখানে এই দুই নকশা একসাথে দেখা যায়। সূর্যের জীবনদায়ক ক্ষমতার প্রকাশ পায় সূর্য নকশায়।

চন্দ্র নকশা

চন্দ্র নকশায় ইসলাম ধর্মের প্রভাব বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অনেকগুলো নক্ষত্রযুক্ত একটি অর্ধচন্দ্রাকার নকশা। জায়নামাজ কাঁথায় এই নকশার দেখা মেলে।  

চাকা নকশা

চাকা নকশা ভারতীয় কলার প্রতীক। এটি বিশ্বকেও প্রতিনিধিত্ব করে। গ্রাম বাংলায় এটি বেশ জনপ্রিয় নকশা।

স্বস্তিকা নকশা

প্রাণী, মাছ, প্রজাপতি, গাছ ও মানুষের মোটিফ থাকে এতে। আধুনিক সময়ের হোম ডেকোরে দেয়ালিকা হিসেবে এই নকশার বাড়তি কদর আছে।  

জীবনবৃক্ষ নকশা 

সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে ভারতীয় শিল্পকলায় এই নকশার প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে এই নকশার পরিপূরক হিসেবেই আঙ্গুরগাছ ও লতাপাতার নকশা দেখা যায়। এছাড়াও রাজশাহীতে বহুল প্রচলিত এরকম আরেকটি নকশা হল পান পাতার লহরি।

কালকা নকশা

মুঘল আমল থেকে আজ পর্যন্ত এই নকশা ব্যবহার করা হয়। কালকা নকশার উৎপত্তি পারস্য ও কাশ্মীরে। বর্তমানে এটি উপমহাদেশের অবিচ্ছেদ্য নকশা।

সব ক্ষেত্রে নকশাকাররা সেই দার্শনিক তত্ত্ব কিংবা চিহ্নের গুরুত্বের দিকে নজর দিয়েই নকশা আঁকেন এমনটা নয়।  বেশিরভাগ সময়েই নকশাটি সুন্দর বলে পারিবারিকভাবে অনুকরণ করা হয়। আবার অনেক সময় নকশা সংরক্ষণে ছোট রুমালের আকারের কাপড়ে সেই নকশার ছাঁচটি তুলে রাখা হয়।

তোমারেই যেন দেখিয়াছি প্রিয়া শত রুপে শতবার  

সেকালের সেই নকশীকাঁথার চল আজও আছে, তবে একটু অন্যরকমভাবে

“তোমারেই যেন দেখিয়াছি প্রিয়া শত রুপে শতবার” – এই কথাটি বোধ হয় নকশীকাঁথার সাথেই সবচেয়ে বেশি খাপ খায়। একে তো সে প্রেয়সীর মতোই উষ্ণতা দেয়, পরম যত্নে জড়িয়ে রাখে, অন্যদিকে রূপেও সে প্রেমিকার চেয়ে কম নয় কোনো অংশে। নানান রূপে, নানান আঙ্গিকে সে ফিরে ফিরে আসে কালের বিবর্তনে। নকশীকাঁথার নকশা গ্রাম বাংলার জীবনাচরণের সাথে খাপ খাইয়ে  অভিযোজিত হয়েছে নানাভাবে। এক সময় কেবল কাঁথা হিসেবেই নয়, নকশীকাঁথার নকশাশিল্প প্রচলিত ছিল নানা আঙ্গিকে- 

লেপকাঁথা

এটি অন্যান্য কাঁথার তুলনায় পুরু ও ভারী। তাই শীতকালে লেপের পরিবর্তে এই কাঁথা ব্যবহার করা হত। 

দস্তরখান 

নকশা করা, তুলনামূলক ছোট এই কাঁথা অতিথিকে খাবার সেয়ার সময় বাসনের নিচে পেতে দেয়া হত। 

সুজনী কাঁথা

বিছানার চাদর হিসেবে এ কাঁথার চাহিদা এখনো রয়েছে। নওগাঁ, কুষ্টিয়া ও যশোর এলাকায় এই কাঁথাকে পাড়নী কাঁথা বা নাছনী কাঁথা বলে। অতিথি এলে বসার জন্যও এই কাঁথা বিছিয়ে দেয়া হয়।

নকশী থলে

বিশেষ অনুষ্ঠানে পান-সুপারি বহনের জন্য ব্যবহার করা হত।

আরশীলতা

এক সময় এটি আয়না ও চিরুনি জড়িয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হত।

বর্তন ঢাকনা

অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের খাবার দেয়ার সময় বাসনের আচ্ছাদন বা ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করা হত।

গিলাফ 

আল-কুরআন ও অন্যান্য ধর্মীয় কিতাবের খোল হিসেবে ব্যবহৃত হত।

আসন কাঁথা

সনাতন ধর্মে পূজা-অর্চনা বা বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনেকে বসতে দেয়া হয় আসন হিসেবে।

রুমাল কাঁথা

এক সময় রুমাল হিসেবে এর প্রচলন ছিল।

চাদর কাঁথা 

শীতকালে গায়ের চাদর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সেকালের সেই নকশীকাঁথার চল আজও আছে, তবে একটু অন্যরকমভাবে। ব্যক্তিগত শখের গন্ডি পেরিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে নকশীকাঁথা। পুরাতন কাপড় ও সুতার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে নতুন মার্কিন লালসালু কিংবা সাদা-কালো ও রঙিন কাপড় এবং বিদেশী সিল্কি পেটি সুতা। পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের এই রকমফেরে দস্তরখানের জায়গা নিয়ে নিয়েছে নকশা করা টেবিল ম্যাট। সুজনী কাঁথার জায়গা দখল করেছে নকশা করা বেড কাভার।  এছাড়াও কুশনের কভার, ওয়্যারম্যাট, বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, কিংবা পোশাক! কোথায় নেই নকশীকাঁথার ব্যবহার? যুগে যুগে প্রিয়ার মতোই তার দেখা মেলে শত রূপে শত বার!  

আপনার ঘরে পরম যত্নে তৈরি এই নকশীকাঁথার শত রূপের মাঝে কোন রূপটি শোভা পাচ্ছে? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। 

 

Write A Comment

Author