Reading Time: 3 minutes

তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ড কিংবা রানা প্লাজার ভবন ধ্বস, বাংলাদেশ সাক্ষী হয়েছে স্মরণকালের ভয়াবহতম কিছু শিল্প কারখানায় ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার। এতে যে শুধু দেশের মানুষেরই ক্ষতি হয়েছে তাই না, বহিঃবিশ্বের কাছে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের ইমেজ। এরপর ছিল পুরান ঢাকার অগ্নিকান্ড। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এখানে ভয়াবহ দুটি অগ্নিকান্ডে পুরে মারা যান শত শত মানুষ। অনেকের ধারণা ছিল, পুরান ঢাকার অপ্রশস্থ রাস্তাঘাট আর মানুষের অসচেতনতার কারণেই বুঝি অগ্নিকান্ডের এত ব্যাপকতা। ঢাকার তুলনামূলক নতুন স্থানে এমন অগ্নিকান্ড হয়ত ততটা ক্ষতি করতে পারবে না, খুব সহজেই হয়ত তা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। কিন্তু এ ধারণা যে বিরাট ভ্রান্ত ধারণা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ঢাকা শহরের অন্যতম নতুন এলাকা হিসাবে পরিচিত বনানীর এফ-আর টাওয়ারে আগুন। সবাই এখন এক বাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছে, এসব ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে একমাত্র উপায় হল নিরাপদ ভবন নির্মাণ ।

এজন্যই সব ডেভেলপার প্রাথমিকভাবে গুরুত্বারোপ করছেন নিরাপদ ও টেকসই ভবন নির্মাণের দিকে। বর্তমানে তাই যে কোন স্থপতি, প্রকৌশলী বা প্রকল্প পরিচালকেরা ভবনের নিরাপত্তার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন যখন নির্মাণ শুরু হয় একদম তখন থেকেই। এসময়, নতুন বা পুরাতন, উভয় রকমের ভবনেই থাকে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে থাকে বাজেট এবং সময়সীমার সীমাববদ্ধতা আর পুরাতন ভবনের ক্ষেত্রে রয়েছে বর্তমান মালিকদের সম্মতি অথবা অসম্মতির বিষয়টি। ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গেলে অনেকসময়ই খরচ হয় প্রচুর অর্থ। বেশিরভাগ মালিকই রাজি থাকেন না এই অর্থ খরচের জন্য।

তবে এ সবকিছু মাথায় রেখেই বর্তমানে কঠোর নিরাপদ ভবন নির্মাণ আইন করা হয়েছে। ভবনের সৌন্দর্য, দীর্ঘস্থায়ীত্ব এবং নির্মাণ খরচ, সবদিক মাথায় রেখেই স্থপতিরা ভবনের নকশা করছেন, প্রকৌশলীরা নিরাপদ ভবন নির্মাণ করছেন। তাদের সবার মতেই, সেফ বিল্ডিং নির্মাণ করতে হলে তা একদম কন্সট্রাকশনের সময় থেকে করাই সবচেয়ে উত্তম। আর, টেকসই ও নিরাপদ ভবন নির্মাণ করতে হলে মাথায় রাখতে হবে নিচের বিষয়গুলি

  • অ্যাক্সেস কন্ট্রোল: কোন ভবনে বসবাসরত বা কর্মরত মানুষদের প্রবেশপথ এবং বহির্গমন পথে সহজে অ্যাক্সেস আছে কী না তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও ডাটা সেন্টার, জরুরী প্রয়োজনের জন্য রাখা সরঞ্জামাদির কক্ষেও যে সবাই দরকার মত যাতায়াত করতে পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • অগ্নি নিরাপত্তাঃ সকল নির্মাতার জন্যই অগ্নি নিরাপত্তা হল সবচাইতে ইম্পরট্যান্ট ইস্যু। ভবন নির্মাণের আগেই একটি ফুল-প্রুফ ফায়ার সেফটি প্ল্যান রাখতে হবে। নির্মাণের সময় প্রতিটা ধাপে মেনে চলতে হবে সেই প্ল্যান। পর্যাপ্ত ফায়ার সেফটি অ্যালার্ম ইন্সটল, জরুরী বর্হিগমন পথের ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখা, সময় সময় সেফটি ড্রিল বা রিহার্সালের আয়োজন করা, সবকিছুই থাকে ফায়ার সেফটির আন্ডারে। আধুনিক ভবনে ফায়ার সেফটি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
  • অভ্যন্তরীণ পাওয়ার সাপ্লাইঃ ভবনের ভেতরের হিটিং বা কুলিং সিস্টেম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, পানির পাম্প, বৈদ্যুতিক পাওয়ার সিস্টেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে হবে। নিয়মিত এদের সেফটি চেক করতে হবে। ইন্সটল করার আগেই রক্ষণাবেক্ষণের সকল উপায় ঠিকভাবে সেট করে নিতে হবে।
  • ভূমিকম্প প্রতিরোধী স্থাপনাঃ বিল্ডিং যতটা লোড নিতে পারে তারচেয়ে বেশি লোড এর উপরে দিলে স্ট্রেসের কারণে ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক বা মানুষসৃষ্ট যে কোন দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখেই নিরাপদ ভবন নির্মাণ করতে হবে। হাই-রাইজড  বিল্ডিং বা উঁচু স্থাপনাগুলো যেগুলো নির্মাণের সময় নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখা হয়নি সেগুলোই সাধারণত অধিক ঝুঁকিতে থাকে। এমন দুর্বল নির্মাণ কাঠামো এবং অসচেতনতার কারণেই ২০১৩ সালে রানা প্লাজার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
নিরাপদ ভবন নির্মাণ
আগুন থেকে বাঁচতে হলে সচেতনতাই সমাধান!

এছাড়াও প্রাত্যহিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আর যে সব জিনিসের দিকে লক্ষ্য রাখলে ভাল সেগুলো হল

  • প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার
  • কঠোরভাবে প্রবেশ এবং বর্হিগমন পথ মনিটর করা যাতে শুধুমাত্র অনুমতিপ্রাপ্ত মানুষ ছাড়া আর কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।
  • যানবাহনের তলদেশ এবং নাম্বারপ্লেট মনিটরিং সিস্টেম
  • সম্পূর্ণ ভবনের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস ডিটেক্টর ইন্সটল করা যাতে যে কোন জায়গায় গ্যাস লিক হলে তা সঙ্গে সঙ্গে জানা যায়
  • সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
  • আগুন প্রতিরোধে ফায়ার ফাইটিং পাম্প, স্মোক ও হিট ডিটেক্টর, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা। অগ্নি প্রতিরোধক বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করার শর্ট সার্কিটের সম্ভাবনা কমিয়ে আনার জন্য।

এদিকগুলো মাথায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে পারলে তা যে শুধুমাত্র নিরাপদ হয় তাই নাই, পানি বিদ্যুৎ বা এরূপ অত্যাবশ্যকীয় উপাদান সাশ্রয়ও হয় অনেক। এছাড়া রিখটার স্কেলে কমপক্ষে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে সেরূপ ভবন নির্মাণ করা উচিত। এমন নিরাপদ ভবন নির্মাণের জন্য একজন নির্মাতাকে অবশ্যই গভীর জ্ঞান রাখতে হবে সম্ভাব্য বিপদগুলো সম্পর্কে। তাহলেই সম্ভব হবে ভবিষ্যতের অনেক ঝুঁকি এড়ানো। 

Write A Comment