Reading Time: 4 minutes

এমন এক শহর, যার বুকে পা বাড়ালেই নাকে লাগে সোঁদা মাটির গন্ধ। কানে বাজে পল্লীকবির গান। যে শহরে মাঠ মানেই নকশীকাঁথার মাঠ, ঘাট মানেই সোঁজনবাদিয়ার ঘাট। শহরের নাম ফরিদপুর। আজকের আলাপচারিতায় কবিতার মতো সুন্দর এই শহরটিকে জানব। জানব সভ্যতার চাকায় ঘুরতে ঘুরতে জঙ্গলাকীকর্ণ একটি স্থান জেলা শহরে রূপান্তরিত হওয়ার গল্প। জানব সংস্কৃতি আর উৎসবের আবর্তে একটি জেলা কী করে যুগের পর যুগ টিকিয়ে রাখে তার নিজস্বতা। সাথে জানব ফরিদপুরের সেইসব প্রিয় বিষয় যা আবহমানকাল ধরে প্রভাব ফেলেছে তার বাসিন্দাদের জীবনাচরণে কিংবা হৃদয়ের খুব গহীনে।  

মানচিত্রের ক্ষুদ্র অংশে  

বাংলাদেশের মানচিত্রের একেবারে মধ্যভাগে তাকালে, সহসাই দেখা মিলবে ফরিদপুর নামের এ জেলা শহরের। মানচিত্রের ২০৭২.৭২ বর্গ কিলোমিটার জায়গা শহরটি বরাদ্দ রেখেছে তার নিজের নামে। অন্তর্গত উপজেলা মোট ৯টি, ফরিদপুর সদর, মধুখালী, বোয়ালমারি, আলফাডাঙ্গা, সালথা, নগরকান্দা, ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন। এখন পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের অধীনে থাকলেও, শীঘ্রই পদ্মা বিভাগের সদর দপ্তর হিসেবে, মানচিত্রে নিজের অস্তিত্বকে আরো জোরালো করতে যাচ্ছে জেলাটি।  

ইতিহাসের পাতা উল্টে

ব্রিটিশ শাসন আমলের অন্যতম প্রাচীন এক জেলা ফরিদপুর। তবে এর আদি নাম ছিল ফতেহাবাদ। প্রবাদ আছে, বহু আগে এটি ছিল জলা ও জঙ্গলাকীর্ণ, যেখানে কারো পক্ষেই আবাদ করা সম্ভব হয়নি।  ফতে আলী নামে এক মুসলমান বহু কষ্টে এই স্থানটিকে মানুষের বসবাস উপযোগী করে তুললে তাঁর নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ হয় ফতেহাবাদ।

তবে এর ফরিদপুর নামকরণের পিছনেও রয়েছে আরেকটি গল্প। ফরিদপুর কালেক্টরেট এলাকা সংলগ্ন যশোর রোডের পাশে পুরনো বট গাছের নীচে ছিল ফরিদ শাহের দরগা বা চিল্লা। জনশ্রুতি আছে একবার পদ্মা নদী তীর ভাঙতে ভাঙতে দরগাটির কাছাকাছি চলে আসে। পদ্মার ভাঙন দেখে হাজার হাজার মানুষ যখন দ্বিধাগ্রস্ত, শাহ ফরিদ আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান দরগাটিকে পদ্মার ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য। এরপরই পদ্মার খরস্রোত স্তিমিত হয়ে নদী চলে যায় দরগা থেকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকেই এ অঞ্চলের নাম হয় ফরিদপুর। তবে কেবল নামের নামকরণেই নয়, ঐতিহাসিক আনন্দ নাথ রায় বলেন “রেনেল ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ দেশের যে মানচিত্র অঙ্কন করেন তাহাতেও ফরিদপুরের স্থান নির্দেশ করা হইয়াছে।” 

এ সময় গড়াই, মধুমতি, বারাসিয়া, চন্দনা, কুমার প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী জমিতে নীলচাষ করা হত। ছিল মোট ৫২টি নীলকুঠি।  নীলচাষের বিরুদ্ধে হাজী শরীয়তুল্লাহর যে ফরায়েজী আন্দোলনের কথা আমরা বইয়ের পাতায় পড়ি, তা কিন্তু প্রসার লাভ করেছিল আজকের এই ফরিদপুর জেলা থেকেই। 

সংস্কৃতির পরিবৃত্তে

সুপ্রাচীন জনপদ বলেই ফরিদপুর এখনো জিইয়ে রাখতে পেরেছে তার নিজস্ব সংস্কৃতি। লোকগীতি, লোকসংগীত, পল্লীগীতি, বাউল গানের বিখ্যাত মরমী লোক কবি ও চারণ কবিদের লালন ক্ষেত্র এই ফরিদপুর। এ জেলার অনুকুল আবহাওয়া ও পরিবেশ যুগে যুগে সংস্কৃতির উপাদান ও উপকরণ সরবরাহ করেছে। পল্লী কবি জসীম উদদীন, ঔপন্যাসিক রাজিয়া মজিদ , হাজেরা বিবি , আ ন ম বজলুর রশীদ , নাট্যকার নুরুল মোমেন , নরেন্দ্র নাথ মিত্র , হালিম বয়াতি, মৃনাল সেন, ফকির আলমগীসহ প্রমুখের অনবদ্য সৃষ্টিগুলো সে প্রমাণই বহন করে।

ভোজনে-আপ্যায়নে 

ভোজনবিলাসী ফরিদপুরবাসী খেতে যেমন ভালবাসে, ভালবাসে খাওয়াতেও। খাদ্যগ্রহণকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা বরাবরই রয়েছে তাদের চিন্তা ও রুচিতে। এখানকার খেজুরের গুড় দেশজুড়ে বিখ্যাত। গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা,  দুধ চিতই, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান পিঠাসহ হরেক রকম পিঠা বানানোর চল আছে। তবে, ঘরে বানানো মিষ্টান্নর বাইরেও এ অঞ্চলে আলাদা খ্যাতি আছে তেতুলতলার খোকা মিয়ার মিষ্টির। এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী বাগাট ঘোষ মিষ্টান্নের দই, চর কমলাপুর ব্রিজ সংলগ্ন কবুতরের মাংসের চপ, ইউসুফ স্টোরের মালাই চা ইত্যাদি অসংখ্য খাবার ভোজনে ও আপ্যায়নে প্রশংসা কুড়িয়েছে মানুষের। 

ভ্রমণে ও দর্শনে

প্রাচীন জেলা ফরিদপুরে দেখার মত রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। তবে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য কুমার নদীর দক্ষিণে গোবিন্দপুর গ্রামে অবস্থিত পল্লী কবি জসীম উদদীনের বাড়ি ও সমাধি। সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিতভাবে আপনার মনে পড়ে যাবে কবির লেখা “কবর” কবিতার দু, তিন লাইন।  আর বাড়ির ঠিক উল্টোপাশেই দিগন্ত বিস্তৃত বিখ্যাত সেই “নকশীকাঁথার মাঠ’। তবে, প্রাচীন ইতিহাসের নিদর্শন দেখতে চাইলে যেতে হবে ফরিদপুরের মধুখালী থানার মথুরাপুর গ্রামে। ষোড়শ শতাব্দীর স্থাপনা মথুরাপুর দেউল এর দেখা মিলবে এখানে। ৯০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দেউলটির গায়ে মাটির ফলকের তৈরি নৃত্যরত নর-নারী, হনুমান, পেঁচা, মস্তকবিহীন মানুষের প্রতিকৃতিসহ অসংখ্য ছোট ছোট মুর্তি। এছাড়াও, রয়েছে নদী গবেষনা ইনস্টিটিউট, হযরত শাহ ফরিদ মসজিদ, জগদ্বন্ধু সুন্দর এর আশ্রম, আটরশি বিশ্ব জাকের মঞ্জিল, বাইশ রশি জমিদার বাড়ি, সদরপুর সাতৈর মসজিদ, পাতরাইল মসজিদ কাঠিয়া কালীবাড়ি, শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনসহ অসংখ্য নিদর্শন, যা দেখতে চলে আসতে পারেন প্রিয় জেলা ফরিদপুরে। 

নদীর বাঁকে বাঁকে 

নদীমাতৃক বাংলাদেশ এর নদীবিধৌত জেলা এটি। এর সীমান্তেও রয়েছে দুইটি বড় নদী, পদ্মা আর মেঘনা। এছাড়াও অভ্যন্তর দিয়ে বয়ে গেছে মধুমতি, কুমার, ভুবনেশ্বর, আড়িয়াল খাঁ, বারাশিয়া, কুমার নদী, মধুমতী নদী, বারাশিয়া নদী ও চন্দনা নদী। রয়েছে হাওড়, বাওড়, বিল। এ সকল নদী ও হাওড়ে সারা বছর প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ ধরা পরে। 

সোনালি আঁশের শহর

ফরিদপুর জেলার ব্রান্ডিং পন্য পাট। স্বাধীনতার আগেও বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট পাটের সিংহভাগ ফলন হতো বৃহত্তর ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে। তবে দেশের সর্বোৎকৃষ্ট মানের পাট হিসেবে বৃহত্তর ফরিদপুরের পাটই ছিল সারা বিশ্বে সমাদৃত। এখনো পর্যন্ত সোনালি আঁশের এই সুখ্যাতি ধরে রেখেছে অঞ্চলটি।

উৎসবের শহর 

প্রিয় শহর ফরিদপুরের সাথে তার বাসিন্দাদের রয়েছে এক পুরাতন প্রানের টান। কাজের প্রয়োজনে যে যেখানেই থাকুক ঈদ, বৈশাখ কিংবা যে কোনো উৎসব যেন তাদের প্রানের 

শহরে ফিরে আসার বিশেষ উপলক্ষ্য। সেদিক থেকে ফরিদপুরকে বলা চলে উৎসবের শহর। সারা বছর জুড়ে চলে অনেকগুলো মেলা- বৈশাখী মেলা, আঙিনার মেলা, জসীম মেলা, কিংবা বইমেলা। সেইসাথে থাকে আরো অসংখ্য সাংস্কৃতিক আয়োজন। কেবল ঈদ এবং পূজা নয়, ফরিদপুরে ক্রিসমাসও উদযাপন করা হয় মহাসমারোহে। সব ধর্মের মানুষ আসেন আলোকচ্ছটায় সাজানো ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ ও গ্রীক আদলে নির্মিত বাড়িগুলো দেখতে।  এছাড়াও, ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন ফরিদপুরে পদ্মার চরে দেখা মেলে এক ভিন্ন রকম উৎসব। কয়েকশ ঘুড়ি আর রঙ্গিন ফাঁনুস উড়িয়ে পদ্মার বালুচর মুখর করে তোলে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের মানুষ। , প্রিয় শহর ফরিদপুর ঠিক এতোটাই উৎসবমুখর। 

ফরিদপুরের ছায়া সুনিবিড় পথ, ঘাট, নদীর বালুচর, সবুজ প্রকৃতি এ সবই মুগ্ধ করার মতো। তবে  এখানকার মানুষের সারল্য, আতিথেয়তা, অসাম্প্রদায়িকতা আর উৎসবমুখরতাই এ জেলার আসল সৌন্দর্য। তাইতো এই শহরের প্রেমে পড়ে যান অসংখ্য মানুষ। ফিরে ফিরে আসেন। আপনিও কি তাদের মতোই একজন? তাহলে কমেন্টে জানান প্রিয় জেলা ফরিদপুর নিয়ে আপনার প্রিয় কোনো স্মৃতি।  

Write A Comment

Author