Reading Time: 5 minutes

কারো ভীষণ পছন্দ দ্য বিটলস বা বব মার্লে, কারো আবার সকাল শুরু হয় রবিশংকরের সেতারে। খাবার টেবিলেও কারো হাতে থাকে ডিসির কমিক্স, কেউ মুখ গুঁজে রাখে ফেলুদার গল্পে। কোনো কোনো আড্ডা জমে ওঠে স্টুডিও ঘিবলির প্রশস্তিতে, আবার কোথাও আড্ডার মূল সুর এখনো সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালি’। রুচি ও পছন্দের এমন ভিন্নতার মাঝেই বোধহয় পৃথিবীর সত্যিকারের সৌন্দর্য নিহিত! তবে নিজের ঘরটি নিশ্চয়ই আপনি যা কিছু প্রিয় তা দিয়েই সাজাতে চাইবেন। ‘ফ্যান্ডম কর্নার’ এর মূল কথাও ঠিক তাই! ফ্যান্ডম কর্নার আসলে কী ও কীভাবে এটি সাজানো যায় তার খুঁটিনাটি জানতে পড়তে থাকুন আমাদের আজকের ব্লগ। 

ফ্যান্ডম কর্নারঃ কী ও কেন 

পোস্টার
মনকে সতেজ ও চাঙা রাখতে যে ফ্যান্ডম কর্নার এর জুড়ি নেই সে তো বুঝতেই পারছেন!

ফ্যান্ডম শব্দটি দিয়ে আসলে কোনো একটি বিষয়ে প্রচন্ড আগ্রহ বা কোনো কিছুকে ভীষণ পছন্দ করাকেই বোঝানো হয়। সে বিষয়টি হতে পারে কোনো লেখকের লেখা, কোনো টিভি সিরিজ, কোনো ফিকশনাল চরিত্র, কোনো মিউজিক্যাল ব্যান্ড, শিল্পী বা যেকোনো কিছু! ইদানিং পপ কালচারে ‘ফ্যান্ডম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনো বিষয়ে দারুণ উৎসাহী কিছু মানুষের আলোচনা-আগ্রহকে বোঝাতে। হ্যারি পটার ফ্যান্ডমের কথাই ধরা যাক। হ্যারি পটারের রয়েছে বিশ্বব্যাপী ভক্তের দল; যাদের মাঝে কেউ হ্যারি পটারের চরিত্রগুলো আঁকতে ভালোবাসে, কেউ লেখে ফ্যান ফিকশন, আবার কেউ কেউ শুধু এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা করতেই পছন্দ করে। এ পুরো ব্যাপারটিই আসলে হ্যারি পটার ফ্যান্ডম! 

এবার তবে বলি, ফ্যান্ডম কর্নার ব্যাপারটি কী। মনে করুন, ঘুম ভাঙতেই ঘরের যে কোণটায় প্রথম চোখ পড়ে আপনার, সেখানেই আছে আপনার প্রিয় ফিকশনাল চরিত্র শার্লক হোমসের রঙ্গিন একটি পোস্টার। ঠিক পাশের ঘড়িতে লেখা দুর্দান্ত এ গোয়েন্দার বিখ্যাত ডায়লগ ‘দ্য গেম ইজ অন!’ ভেবে দেখুন তো কেমন ফুরফুরে মেজাজে দিনটি শুরু হবে আপনার! এই যে ঘরের এক কোণায় প্রিয় চরিত্রের নাম, ছবি, ডায়লগ অঙ্কিত সামগ্রী রাখা, ঘরের সে কোণটিই হলো আপনার ফ্যান্ডম কর্নার। সোজা কথায়, নিজের মনমতো বই-সিনেমা-টিভি সিরিজ-গান বা প্রিয় যেকোনো কিছুর রেফারেন্সে সাজানো কর্নারের নামই ফ্যান্ডম কর্নার। 

মনকে সতেজ ও চাঙা রাখতে যে ফ্যান্ডম কর্নার এর জুড়ি নেই সে তো বুঝতেই পারছেন! সেইসাথে নিজের সংবেদনশীলতা, রুচি ও পছন্দের দিকটি গৃহসজ্জায় তুলে ধরতে চাইলেও কিন্তু এটি দারুণ এক মাধ্যম। কথায় বলে, আপনার ঘর আপনার পারসোনাল স্টেটমেন্ট! আর ফ্যান্ডম কর্নার সেই স্টেটমেন্ট তুলে ধরতে পারে একদম নিখুঁত ভাবে। এছাড়া পরিবারের সদস্য ও অভ্যাগত অতিথিকে অনুপ্রাণিত করতেও এটি ভূমিকা রাখে। কেননা যখন কেউ আপনার বাড়িতে এসে দেখবে ড্রয়িং রুমের একটি কোণা আপনি খুবই নান্দনিকভাবে সত্যজিতের আঁকা ছবি, বই ও সিনেমার পোস্টার দিয়ে সাজিয়েছেন, তার মনে স্বভাবতই কৌতূহলের উদ্রেক হবে। হয়তো এসব দেখেই একদিন তিনিও হাতে তুলে নিবেন শঙ্কু সমগ্র! 

যেভাবে সাজাবেন ফ্যান্ডম কর্নার 

যেহেতু প্রিয় জিনিসগুলোর প্রতি ভালোলাগা বা অনুরাগ প্রকাশেরই একটি মাধ্যম এই ফ্যান্ডম কর্নার, তাই এ নিয়ে আমাদের অনেক কল্পনা ও পরিকল্পনা তো থাকেই। তবে কিছু ব্যাপার মাথায় রেখে সেগুলোর বাস্তবায়ন করলে তা নিজের কাছেও যেমন ভালো লাগবে, তেমনি বাড়াবে ঘরের সৌন্দর্যও। 

বেছে নিন যথার্থ জায়গা 

ফ্যান্ডম কর্নার
নিজের শোবার ঘরে যেমন অনেক টুকু জায়গা নিয়ে ফ্যান্ডম কর্নার সাজাতে পারবেন আপনি, ততখানি জায়গা কিন্তু বসার ঘরে পাবেন না

ঘরের ঠিক কোন জায়গায় ফ্যান্ডম কর্নার করতে চান সেটি ঠিক করে নিন সবার আগে। নিজের শোবার ঘরে যেমন অনেক টুকু জায়গা নিয়ে ফ্যান্ডম কর্নার সাজাতে পারবেন আপনি, ততখানি জায়গা কিন্তু বসার ঘরে পাবেন না। কারণ বসার ঘরের জন্য পরিবারের সব সদস্যের মতামতই জরুরি। এছাড়া অনেকে ফ্যান্ডম কর্নার বানান শুধু নিজের জন্য, আবার কেউ চান অতিথিদের সামনে নিজের পরিশীলিত বোধের পরিচয় তুলে ধরতে। সে উদ্দেশ্যটিও তাই স্থান নির্বাচনের সময় মাথায় রাখা জরুরি। 

দেয়ালে আঁকিবুকি 

ফ্যান্ডম কর্নার
ফ্যান্ডম কর্নার সাজানোর জন্য ওয়াল পেইন্টের এই রীতি বিশ্বব্যাপী প্রচলিত

আজকাল ইন্টারনেট ঘাটলে দেখা যায়, আফ্রিকার এক কিশোর নিজের শোবার ঘরের দেয়ালে এঁকেছে বিটিএস আর্মির লোগো। আবার বাংলাদেশী তরুণী তার লিভিং রুম সাজিয়েছেন বব ডিলানের প্রতিকৃতি এঁকে। ফ্যান্ডম কর্নার সাজানোর জন্য ওয়াল পেইন্টের এই রীতি বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। কিশোর-তরুণেরা অ্যাক্রিলিক বা স্প্রে পেইন্ট দিয়ে দেয়ালে লেখেন পছন্দের বইয়ের উক্তি বা প্রিয় সিনেমার সংলাপ। কেউ কেউ আবার আঁকেন প্রিয় চরিত্র, প্রিয় গায়ক বা শিল্পীর প্রতিকৃতি। দেয়ালে আঁকিবুঁকি জনপ্রিয় হওয়ার আরো একটি কারণ হলো, শিল্প মাধ্যমের প্রতি ভালোলাগা আর নিজের শিল্পীসত্তার প্রকাশ দুটোই যেন কিছুটা একই সুরে বাঁধা। 

ফ্রেমে-পোস্টারে ভালোলাগা 

ছবির ফ্রেম
সাদামাটা দেয়ালও রঙ্গিন করতে পারেন ছবির ফ্রেমে কিংবা পোস্টারে

দেয়ালে আঁকার সুযোগ না থাকলেও নিরাশ হবার কিচ্ছু নেই। সাদামাটা দেয়ালও রঙ্গিন করতে পারেন ছবির ফ্রেমে কিংবা পোস্টারে। সাদা দেয়ালের ঠিক মাঝখানে দুটো ছবির ফ্রেম, আর ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে হলুদ ছাতা ও নীল ফ্রেঞ্চ হর্ন! বুঝতেই পারছেন যিনি এভাবে ঘর সাজিয়েছেন তিনি আসলে ভীষণ জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘হাউ আই মেট ইয়োর মাদার’ এর পাড় ভক্ত। তবে এগুলো শুনে ফ্রেন্ডস ভক্তদের নিরাশ হবার কিছু নেই। ঘরে ফ্যান্ডম কর্নার করার একেবারে কোনো জায়গা না থাকলে দরজাই সই! চটজলদি দরজাটি রাঙিয়ে নিন পার্পল রংয়ে, তারপর শুধু পিপহোলের আশেপাশে বসিয়ে দিন হলুদ ফ্রেমের কারসাজি। ব্যাস, হুবহু মনিকার ফ্ল্যাটের দরজার মতোই হয়ে গেলো আপনার দরজাটিও! এত হিসেব-নিকেশ বা ডিআইওয়াই না করতে চাইলেও ফ্যান্ডম কর্নার সাজানো যায়। সেক্ষেত্রে প্রিয় চরিত্রের ঝকঝকে পোস্টার প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে ঝটপট লাগিয়ে ফেলুন দেয়ালে। চাইলে ফেয়ারি লাইটস বা পেনডেন্ট লাইট জায়গা মতো বসিয়ে ঘরের ‘সেন্টার অফ অ্যাটেনশন’ করে নিতে পারেন এ পোস্টারগুলোকেই। 

ছবি ও পোস্টার ছাড়াও হাতে আঁকা সাইনেজ, হোর্ডিংও হতে পারে ফ্যান্ডম কর্নার সাজানোর উপাদান। সাহিত্য অনুরাগীদের অনেকেই ফিকশনাল বিভিন্ন স্থানের নাম দিয়ে তৈরি করেন সাইনেজ বোর্ড। তীর চিহ্ন দিয়ে তাতে লেখা থাকে গোথাম সিটি, জুরাসিক পার্ক, ডায়াগন অ্যালে, পুলিস টার্ডিস বক্স, সেরেনিটি ইত্যাদি। 

ফ্যান্ডম শেলফ 

শেলফে ফ্যান্ডম কর্নার
শেলফে ফ্যান্ডম কর্নার সাজানোর সুবিধা হলো কম জায়গায়ও অনেকগুলো প্রিয় বিষয়ের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশের সুযোগ থাকে।

ফ্যান্ডম কর্নারে ফ্যান্ডম শেলফ সাজানোর এ রীতিও দারুণ কার্যকরী। শেলফের এক তাকে রাখতে পারেন প্রিয় বই। আরেক তাকে জায়গা করে নিতে পারে সেই একই বইয়ের চরিত্রের প্রতিকৃতি বা কোনো অ্যাকশন ফিগার। আজকাল পপ কালচারে জনপ্রিয় চরিত্র, বই, শিল্পীদের নিয়ে তৈরি নানা পণ্যও অনলাইন ও অফলাইনে কিনতে পাওয়া যায়। সেসবও রাখতে পারেন এই ফ্যান্ডম শেলফে। শেলফে ফ্যান্ডম কর্নার সাজানোর সুবিধা হলো কম জায়গায়ও অনেকগুলো প্রিয় বিষয়ের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশের সুযোগ থাকে। 

ফ্যান্ডম শেলফ সাজানোর তেমন নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। যদি অনেকগুলো প্রিয় বিষয়কে এক শেলফে জায়গা দিতে চান তবে একেক তাকে একেক ফ্যান্ডম সম্পর্কিত সামগ্রী রাখতে পারেন। যেমন এক তাকে রাখলেন রবীন্দ্র রচনাবলীর পুরো সেট, পাশেই থাকলো শান্তিনিকেতন থেকে কেনা টেরাকোটার তৈরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতি আর স্কুলের অনুষ্ঠানে আপনি যেবার চারুলতা সেজেছিলেন তার একটি নান্দনিক ফটোগ্রাফ। রবীন্দ্রনাথে সমৃদ্ধ এ তাকের ঠিক নিচের তাকেই কিন্তু সানন্দে জায়গা করে নিতে পারে বিটলস। ফ্রেমবন্দী অ্যাবে রোডের পোস্টার, পাশেই তাদের জনপ্রিয় কোনো গানের লিরিক লেখা মগ, ছাত্রজীবনে জমানো কয়েকটি পুরোনো ক্যাসেট! ব্যাস, বিটলসের ফ্যান্ডম কর্নারে এর চেয়ে বেশি আর কী চাই! 

ফ্যান্ডম কর্নার নিয়ে আরো কিছু টিপস 

  • ফ্যান্ডম কর্নার তৈরির জন্য সব যে আপনাকে কিনতেই হবে তা কিন্তু নয়। টিশার্টে সেন্ট্রাল পার্কের নেমোনিক এঁকে, ফ্রেম করে আপনি রঙিন কর‍তে পারেন ফ্যান্ডম কর্নার। আবার চাইলে অ্যামাজন বা কোনো আন্তর্জাতিক অনলাইন সেলারের কাছ থেকে কিনতে পারেন ফ্রেন্ডসের অফিশিয়াল মার্চেন্ডাইজার।
  • ফ্যান্ডম কর্নার সাজানোর জন্য অনেক জায়গার প্রয়োজন নেই। পাপোষে রং দিয়ে বা সুতার বুননে লিখে ফেলতে পারেন হ্যারি পটার সিরিজের বিখ্যাত উক্তি ‘ইউ আর আপটু নো গুড!’, তারপর তা দরজার সামনে রেখে দরজায় লাগিয়ে দিন হগওয়ার্টসের ছবি। ব্যস! আপনার দরজাটিই হয়ে গেলো দুর্দান্ত ফ্যান্ডম কর্নার!
  • প্রিয় বই, প্রিয় সিডিগুলো পাশাপাশি গুছিয়ে রাখলেও কিন্তু সেটি একটি ফ্যান্ডম কর্নার। কেননা সব শেষে ফ্যান্ডম কর্নার তো ভালোলাগার বিষয়টির প্রতি নিজের অনুরাগ প্রকাশের জায়গাই!

ঘর মানেই নিজের পৃথিবী, নিজের সবচেয়ে প্রিয় স্থান। তাই সেখানে যে ফ্যান্ডমের মতো প্রিয় বিষয়গুলো জায়গা করে নিবে তা তো স্বাভাবিকই। আশা করছি আমাদের আজকের ব্লগ থেকে আপনি আপনার পছন্দ অনুযায়ী ফ্যান্ডম কর্নার সাজানোর বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। কমেন্টে জানিয়ে দিন কেমন লাগলো আমাদের এ আয়োজন! 

Write A Comment