ধান, নদী, খাল
এই তিনে বরিশাল!
বরিশাল নিয়ে এই চরণদুটি প্রচলিত মানুষের মুখে মুখে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীমাতৃকতার সর্বোচ্চ উদাহরণটা যেন পাওয়া যায় এই বরিশালেই। কোন এলাকার প্রেমে পড়তে হলে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয় বরং সেই জনপদের মানুষ, খাবার, আচার – অনুষ্ঠান, প্রিয় হতে পারে যে কোন দিক। আর বরিশালের কথা উঠলে প্রকৃতি তো আছেই, ভালো লাগার মত এই জনপদের আছে আরও বিভিন্ন দিক যা বাধ্য করবে আপনাকে এই এলাকার প্রেমে পড়তে। বরিশালের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে সাজানো এই লেখায় দেখে নিন এমনই ৫টি দিক।
ভাষা
ভাষা কীভাবে মানুষের আবেগের সাথে সম্পর্কিত তা একটি আশ্চর্য বিষয়। মনস্তত্ত্ববিদরা ভাষা এবং মানুষের হৃদয়ের আবেগের মাঝে এই সম্পর্ক আবিষ্কার করে হয়েছেন চমৎকৃত। তাঁদের মতে আবেগের একটি মূল উপাদান ভাষা। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বরিশালের মানুষের মুখের ভাষা চিত্তাকর্ষী এবং মনোমুগ্ধকর। একটি আলাদা সারল্য এবং টান রয়েছে এই ভাষায়। বরিশালের মানুষের নিজস্ব ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথোপকথন শোনাটাও একটি আলাদা অভিজ্ঞতা। একটি খাঁটি, শিকড়ের কাছ থেকে উঠে আসা ভাষার উদাহরণ বরিশালের ভাষা। আর এই ন্যাটিভ ভাষা বরিশালের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে করা তালিকার প্রথমেই থাকবে।
খাবার
“ও মনু! ডাইলে লবণ দেছো, না দেবা?”
ডালের জন্য কতটা তা নিশ্চিত না হলেও বাহারী খাবারের জন্য বরিশাল অবশ্যই বিখ্যাত। শুধু আঞ্চলিক খাবারই নয় বরং সকল ধরণের খাবারই হয়ে ওঠে সুস্বাদু বিশেষ আঞ্চলিক রন্ধনপ্রণালীর কারণে। সামান্য সবজির মত নিরামিষ একটি খাবারও শুধুমাত্র রান্নার গুণে হয়ে উঠতে পারে মুখোরোচক! মাছের তরকারি থেক মাংস, সব রান্নাতেই যেন জাদু ঢেলে দেন এলাকার মানুষ। বরিশালের একটি বিখ্যাত খাবার হল “সর্ষে ইলিশ”, যা হয়ত শুধু এই এলাকাতেই হয় এমন না কিন্তু এই এলাকার মত স্বাদ অন্য এলাকায় পাওয়া যায় না!
বরিশালে হয় নানান ধরণের নারিকেল দিয়ে তৈরি খাবার। আছে “বিস্কে” নামক একটি লোকাল ডেজার্ট যা মূলত চাল থেকেই তৈরি হয়। আছে হরেকরকমের মিষ্টি। সবমিলিয়ে বরিশালের খাবার সবার কাছেই বরিশালের প্রিয় বিষয়গুলোর একটি।
নদী আর নৌ-ভ্রমণ
বরিশালের মত নদীর উপর নির্ভরশীল এলাকা বাংলাদেশে আর একটিও নেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশের এক আদর্শ উদাহরণ এই এলাকা। বরিশালে আছে মোট ৪৩৩ নটিক্যাল মেইল নৌপথ যা এখানের মোট এলাকার ৬ শতাংশ। সমুদ্রের কাছে হওয়ায় এখানকার নদীগুলোর দৃশ্য নয়নাভিরাম। যেমন মেঘনা নদী থেকে কোন সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে বরিশালের প্রেমে পড়বে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। মেঘনা ছাড়াও আছে আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা বা কালিজিরার মত নদী। আর এসব নদীর যে কোনটিতে নৌকা নিয়ে ছুটে চলতে পারলে দেখা মেলে বরিশালের সবচেয়ে গাঢ় সৌন্দর্য্যের। তাই নদী আর নৌকাই হয়ে উঠে বরিশালকে ভালোবাসার দুটি প্রধান মাধ্যম।
ভাসমান পেয়ারা বাজার
ঝালকাঠি, পিরোজপুর আর বরগুনার সীমানাঘেরা জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় পেয়ারার বাগান। আর ঝালকাঠির কীর্তিপাশা নদের উপরে গড়ে উঠা ভাসমান পেয়ারা বাজার পৃথিবীর সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর এবং বৃহৎ পেয়ারা বাজার। এই বাজারের শুরু কবে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও এটি যে আছে অনেক বছর ধরে তা সবাই নিশ্চিত। জুলাই মাসে মৌসুম শুরুর সাথে সাথে এই ভাসমান বাজার হয়ে উঠে জমজমাট আর সেপ্টেম্বরে তা হয় এক দেখার মত দৃশ্য। আর শুধু পেয়ারা বাজারই থাকবে বরিশালের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে করা তালিকার উপর দিকে
দীপাবলি উৎসব
বরিশালে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মহাশশ্মান দীপাবলি উৎসব পালন করে আসছে। যে বৃহৎ পরিসরে প্রতিবছর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তা একে করে তোলে অনন্য দেশের সবচেয়ে বড় দীপাবলি উৎসব হিসেবে এর গণ্ডি পেরিয়ে যায় নানান সীমানা, মানুষ আসে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে। ফুল, খাবার, প্রদীপ আর মোমবাতি নিয়ে দেশের আনাচেকাঁনাচে থেকে দর্শনার্থী উপস্থিত হন এই উৎসবে। অন্ধকারকে ছাপিয়ে আলোর বিজয়ের স্বরূপ হিসেবে মানুষের উপস্থিতিতে সমগ্র এলাকা যেন প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে এক নতুন আভায়। বরিশালকে ভালো লাগার এ এক অনবদ্য কারণ বৈকি!
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্যের দিক থেকে আশীর্বাদপুষ্ট বরিশালকে যেন প্রকৃতি মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছে। বরিশালকে ভালো লাগার, বরিশালের প্রিয় বিষয়গুলো পরিব্যাপ্তিতে এতই বৃহৎ যে একে শব্দে বেঁধে ফেলা অসম্ভবেরই নামান্তর। একমাত্র নিজের চোখে ঘুরে দেখলেই তাই বোঝা সম্ভব এই জেলার প্রকৃত সৌন্দর্য।