Reading Time: 4 minutes

জীবিকার প্রয়োজনে এদেশের অধিকাংশ মানুষই ঢাকামুখী। তাই আবাসন সংকট মেটাতে বহুতল ভবনের যে এখানে বিকল্প নেই সেটা সকলেরই অনুমেয়। সবাই চান কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে যে জায়গাটি কেনা হল, তা থেকে তিনি যেন সর্বোচ্চ লাভবান হতে পারেন। বহু আগে থেকেই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশকিছু নিয়ম প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু গত বছরের শেষ দিকে এ নিয়মে পরিবর্তন এনে, বহুতল ভবন নির্মাণের নতুন নিয়ম যুক্ত করা হয়েছে। যে নিয়মে আরোপিত হয়েছে আরো কিছু বিধি নিষেধ। তাই আগামীতে যে সকল ভূমি মালিক কিংবা বিনিয়োগকারীরা ভবন নির্মাণ করতে যাচ্ছেন বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের হতে হবে আরেকটু বেশি সতর্ক। বহুতল ভবন নির্মাণের নতুন নিয়ম এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কী কী বিষয় যুক্ত হল আজকের লেখায় সেসব নিয়েই সহজ ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করব। 

বহুতল ভবন কী? 

 সুউচ্চ ভবন
২০ মিটারের চেয়ে উঁচু (ছয়তলা) ভবনকে বহুতল ভবন বলা হয়

বহুতল ভবন বলতে আমরা সাধারণত একাধিক তলাবিশিষ্ট উঁচু ভবনকে বুঝি। আমাদের ঢাকা শহরের প্রায় পুরোটাই এই বহুতল স্থাপনায় পূর্ণ। যদিও, কাগজে কলমে এর সঠিক সংজ্ঞায়ণটা কিছুটা গোলমেলে লাগতে পারে। তবে নিয়ম যেহেতু কাগজ কলম এর সংজ্ঞাকেই অনুসরণ করবে তাই নতুন এই নিয়মে প্রবেশ করার আগে প্রথমেই জানা দরকার আসলে বহুতল ভবন বলতে কী বুঝায়।
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ এবং জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী ২০ মিটারের চেয়ে উঁচু (ছয়তলা) ভবনকে বহুতল ভবন বলা হয়। এবং এই ৬ তলার অধিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম গুলোয় কী কী পরিবর্তন এসেছে সেটাই আজকে আলোচ্য। 

পরিবর্তনের এপিঠ ওপিঠ

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডিসহ ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় সর্বোচ্চ ১৪ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন নির্মাণের অনুমতি ছিল। তবে এ অনুমোদনই বাড়িয়ে দিচ্ছে জনসংখ্যার ঘনত্ব। জনঘনত্ব-কে গুরুত্ব দিয়ে নতুন পরিকল্পনায়  এসব এলাকায় সর্বোচ্চ আট তলা ভবন নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কেউ যদি মোট জমির ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ উন্মুক্ত রাখতে সম্মত হন, সেক্ষেত্রে এই নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ভবনের উচ্চতা বাড়ানোর সুযোগও তার থাকবে। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে ভবন নির্মাণে নতুন নিয়মটি নিঃসন্দেহে পরিবেশবান্ধব হতে যাচ্ছে। তবে সেইসাথে প্রত্যেকেরই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাড়তি কিছু নিয়ম কানুন মানতেই হবে। অর্থাৎ নির্মাণ পরিকল্পনায় অনেকগুলো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। 

কোন এলাকায় সর্বোচ্চ কত তলা? 

জনসংখ্যার ঘনত্ব, সড়ক অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধা, ইত্যাদির উপর নির্ভর করবে কোন এলাকায় কত তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যাবে

বহুতল ভবন নির্মাণের নতুন নিয়ম-এ পুরো ড্যাপ অঞ্চলকে মোট ৪৬৮টি কমিউনিটি ব্লকে ভাগ করে প্রতিটি ব্লকের জন্য ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা কত হবে তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, ধারণক্ষমতা, সড়ক অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধা, উন্নয়নের মাত্রা এ সবকিছুর উপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করা হয়েছে, ঐ এলাকায় সর্বোচ্চ কত তলা পর্যন্ত আপনি ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। নতুন নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কুড়িল, খিলক্ষেত ও নিকুঞ্জতে ছয়তলা, উত্তরাতে ছয় থেকে সাততলা, গুলশান-বনানী-বারিধারায় ছয় থেকে আট তলা, মিরপুরে চার থেকে সাত তলা এবং মোহাম্মদপুর-লালমাটিয়া এলাকায় পাঁচ থেকে আট তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা যাবে। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পুরান ঢাকায় আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে, চার থেকে ছয় তলা পর্যন্ত। রাজউকের আওতাধীন নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং সাভার পৌর এলাকায় আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ ছয় তলা পর্যন্ত।

নতুন নিয়মে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের উপায়

নিয়ম মেনেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার আরো কিছু বিকল্প উপায় রয়েছে

নতুন নিয়মের কড়া শসনে ভয় পাবার কিছু নেই। কারণ নতুন নিয়ম যেমন তৈরি হয়েছে, সেই সাথে তৈরি হয়েছে নিয়ম মেনেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার আরো কিছু বিকল্প উপায়। যে উপায় অনুসরণ করে সুউচ্চ ভবন তৈরির সুযোগ থাকছে আপনার। বহুতল ভবন নির্মাণের নতুন নিয়ম এ বলা হয়েছে, ন্যূনতম ০.৬৬ একর আয়তনের ব্লক বা জমির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ জায়গা খোলা রাখলে সর্বোচ্চ ১০ তলা ভবন এর অনুমোদন দেয়া হবে। দুই থেকে পাঁচ একর জমির ৫০ শতাংশ জায়গা রাখলে অনুমোদন পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ১৫ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হল, আপনার জমির পরিমাণ যদি হয় পাঁচ একরের বেশি , এবং আপনি সেখানে ৬০ শতাংশ জায়গা খালি রাখেন, তাহলে সেখানে যত তলা ইচ্ছা, তত তলা ভবনই আপনি নির্মাণ করতে পারবেন। অর্থাৎ, আপনার জন্য  উচ্চতা উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে এক্ষেত্রে। তবে ভবন নির্মাণের নতুন নিয়ম এ শর্ত দেওয়া হয়েছে, এসব খালি জায়গা উন্মুক্ত স্থান, মাঠ বা পার্কের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। সেখানে কোনো আচ্ছাদন রাখা যাবে না। উন্মুক্ত স্থান ছাড়াও সেটব্যাক হিসেবে ভবনের সামনে দেড় মিটার, পেছনে তিন মিটার এবং উভয় পাশে তিন মিটার জায়গা রাখতে হবে।

আরও কিছু নিয়মের পরিবর্তন 

নতুন আইনে ভবন নির্মাণের  নিয়মগুলো কেবল কঠিনতর করা হয়েছে, এমনটা ভাবলে ভুল করবেন। উঁচু ভবন নির্মাণের কিছু কিছু নিয়ম কিছুটা সহজও করা হয়েছে।  অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ এবং  জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালায়, ভবনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধোঁয়া বা তাপমাত্রা শনাক্তকরণ ব্যবস্থা, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা(স্প্রিংকলার), ন্যূনতম ১৭ হাজার গ্যালন পানি ধারণক্ষম জলাধার এবং জলাধার থেকে যেন পানি নেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা, ফায়ার ফাইটিং পাম্পহাউস, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি ও ফ্লোরে আলোর ব্যবস্থা, বিকল্প সিঁড়ি, ফায়ার লিফট এবং রিফিউজ এরিয়া-  এসব রাখা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু নতুন নিয়মে ১০ তলা পর্যন্ত এই ব্যবস্থাগুলো থাকার বাধ্যবাধকতা আর নেই। আগে যেখানে ১০ তলা পর্যন্ত ভবনের ক্ষেত্রেও স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা (অ্যালার্ম) রাখা বাধ্যতামূলক ছিল, সেখানে নতুন নিয়মে হাতে চালিত ঘণ্টি রাখলেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হবে। এছাড়াও এই নিয়মে ২৪ তলা বিশিষ্ট কমার্শিয়াল ভবনের ক্ষেত্রে ,বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (পোর্টেবল ফায়ার এক্সটিংগুইশার) এবং হাইড্রেন্ট (যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়), ২ টির যে কোনো একটি ব্যবহার করলেই চলবে। সুতরাং এই নতুন নিয়মের ফলে, আপনি চাইলেই এখন আরেকটু স্বস্তিতে এবং কিছুটা ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। তবে বাধ্যতামূলক না হলেও, অগ্নি নিরাপত্তার এই জরুরি ব্যবস্থাগুলো রাখতে চেষ্টা করুন। তাতে আপনার ভবন হবে ঝুঁকিমুক্ত ও ভবনের বাসিন্দারাই সব থেকে বেশি নিরাপদ থাকবে। 

ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে আবাসিক ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। সে উদ্দেশ্যেই যুক্ত করা হয়েছে বহুতল ভবন নির্মাণের নতুন নিয়ম গুলো। এ পরিবর্তন আপনাকে কিছুটা ভাবিয়ে তুললেও, প্রিয় ঢাকা এবং আগামী প্রজন্মের জন্য আপনার ভবন নির্মাণ পরিকল্পনার এটুকু হেরফের নিঃসন্দেহে অনেক বড় অবদান। 

বহুতল ভবন নির্মাণের নতুন নিয়ম গুলোকে আপনি কীভাবে দেখছেন? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। 

Write A Comment

Author