Reading Time: 5 minutes

ক্রীড়ামোদী জাতি হিসেবে আমাদের সুনাম রয়েছে। আমরা বরাবরই খেলা নিয়ে মাতামাতি করতে ভালোবাসি। কয়েকদশক আগের ফুটবল কিংবা ইদানীং হওয়া ক্রিকেট নিয়ে আমাদের উন্মাদনার দিকে লক্ষ্য করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তবে আমাদের দেশটি খুব ছোট একটি দেশ হওয়ায় এবং এত অল্প জায়গায় অসংখ্য মানুষের বসবাস করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের খেলাধুলা করার জায়গার সংকট রয়েছে। এজন্যই এতটা খেলা পাগল একটি জাতি হওয়া সত্যেও আমাদের দেশে স্টেডিয়ামের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটি। কিন্তু যে কয়েকটি স্টেডিয়াম রয়েছে সেগুলোই আমাদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। অতীতে আমরা দেখেছি ২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলবে এমন কয়েকটি ভেন্যুর কথা। চলুন আজ দেখে নেয়া যাক বাংলাদেশের জনপ্রিয় স্টেডিয়াম কোনগুলি যেগুলোর রয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জনপ্রিয় স্টেডিয়াম নিয়ে কথা উঠলে সেখানে অবশ্যই থাকবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের নাম। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে অবস্থিত ১৯৫৪ সালে নির্মিত এই স্টেডিয়ামটি অনেকের কাছে এর পুরাতন নাম এক নম্বর জাতীয় স্টেডিয়াম নামে পরিচিত। তবে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অনুসারে এর দাপ্তরিক নাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। 

এই স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা প্রায় ৩৬ হাজার। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই স্টেডিয়ামটি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিজস্ব মাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এখন এই স্টেডিয়ামটি মূলত একটি ফুটবল স্টেডিয়াম। বিশ্বসেরা ফুটবল প্লেয়ার লিওনেল মেসির পদচিহ্ন পড়েছে এই স্টেডিয়ামটিতে। এছাড়াও অসংখ্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এই স্টেডিয়ামটিতে। স্টেডিয়ামটির চারপাশে আছে রানিং এবং অ্যাটলেটিক্স ট্র্যাক। তবে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট একটি বিশেষ কারণে এই স্টেডিয়ামটি অদ্বিতীয়। এটি পৃথিবীর একমাত্র স্টেডিয়াম যেখানে দুটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের উদ্বোধনী টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমটি ছিল ১৯৫৪-৫৫ সালে যখন তৎকালীন পাকিস্তান ভারতের বিপক্ষে টেস্ট খেলার মাধ্যমে তাদের প্রথম টেস্ট খেলে। এর ৪৬ বছর পরে ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেষ্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর প্রথম টেস্ট খেলে সেই একই প্রতিপক্ষ ভারতের বিপক্ষে। স্টেডিয়ামটি ঢাকার ব্যস্ততম স্থানে অবস্থিত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই এর চারপাশে লেগে থাকে তুমুল যানজট। এছাড়া স্টেডিয়ামের নিচে ইলেকট্রনিক্স মার্কেট থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই স্টেডিয়ামটিকে আশপাশের অন্যান্য স্থাপনা থেকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম

মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়াম
মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়াম

খুব সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টেডিয়াম হল মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে স্টেডিয়ামটি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে ২৬০০০ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেডিয়ামটির অবস্থান। পূর্বে শুধুমাত্র মিরপুর স্টেডিয়াম নামে এটি পরিচিত ছিল এবং মূলত একে একটি ফুটবল এবং অ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়াম হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। তবে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ পাওয়ার পর এই স্টেডিয়ামের আমূল পরিবর্তন করা হয়। এর আয়তক্ষেত্রাকার আকৃতিকে বদলে ক্রিকেটের জন্য উপযুক্ত আকৃতি দেওয়া হয়, তুলে ফেলা হয় প্রায় তিন ফুট মাটি। ক্রিকেট খেলার জন্য উপযুক্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা খুবই প্রয়োজনীয় আর এজন্যই পুনরায় মাটি ভরাট করার পূর্বে এর তলদেশে বসে নেওয়া হয় পিভিসি পাইপ। এছাড়া মাঠের মধ্যভাগ থেকে মাঠের শেষ ভাগকে করা হয় বেশ খানিকটা ঢালু যেন বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের কোন সমস্যা না থাকে। আর এজন্যই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম সমগ্র উপমহাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পন্ন স্টেডিয়ামগুলোর একটি। 

একে বলা হয় হোম অব ক্রিকেট। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্রিকেট ম্যাচ হোক তা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট, মহিলা ক্রিকেট দলের ক্রিকেট, জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের ক্রিকেট ম্যাচ, টেস্ট ম্যাচ, ওয়ানডে ম্যাচ, টি-টোয়েন্টি ম্যাচ, সবই এই মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৫ সালে এই মাঠে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ এবং ২০০৭ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ফ্লাডলাইট ইন্সটল করা হলে এই মাঠে দিবারাত্রির ম্যাচও আয়োজন করা শুরু হয়। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টেডিয়াম ।

এম এ আজিজ স্টেডিয়াম

 এম এ আজিজ স্টেডিয়াম
এম এ আজিজ স্টেডিয়াম

ঢাকার বিখ্যাত দুটো জনপ্রিয় স্টেডিয়াম নিয়ে কথা তো হল, চলুন এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক ঢাকার বাইরে। আর ঢাকার বাইরে যদি কোন স্টেডিয়ামের কথা আসে সেখানে প্রথমে আসবে বিখ্যাত চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের কথা। এটি স্থানীয়ভাবে চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম নামে অনেকের কাছে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রাচীনতম স্টেডিয়ামের একটি। জানা যায় ১৯৫৫ সালে এই স্টেডিয়ামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের জাতীয় দল খেলতে আসে, স্টেডিয়ামের নাম তখন ছিল নিয়াজ স্টেডিয়াম। তবে ২০ হাজার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেডিয়ামটিকে সঠিকভাবে আজকের মত করে নির্মাণ করা হয় ১৯৭৭ সালে। 

বিভিন্ন কারণেই এই স্টেডিয়ামটি বিখ্যাত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে একটি সদরদপ্তর তৈরি করা হয়েছিল। স্টেডিয়ামে প্রথম ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালে যে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ভারত এবং পাকিস্তান খেলেছিল। যদিও বর্তমানে এটি একটি পুরোদস্তুর ফুটবল স্টেডিয়াম তবুও এটি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি টেস্ট ক্রিকেট স্টেডিয়ামও বটে। আর বাংলাদেশ তাদের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল এই স্টেডিয়ামেই, জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে ২০০৫ সালে।

জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম

জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম

এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের পর চট্টগ্রামে ক্রিকেটের জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্দ পায় যে স্টেডিয়ামটি তার নাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম। এই জনপ্রিয় স্টেডিয়াম পূর্বে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম নামেও পরিচিত ছিল। অনেকেই একে ভালোবেসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্টেডিয়াম নামেও ডেকে থাকেন। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাগরিকায় একপাশে পাহাড় এবং অন্যপাশে সমুদ্রের কোলঘেঁষে দৃষ্টিনন্দন এই স্টেডিয়ামটি অবস্থিত। ২০০৪ সালে আইসিসি অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামটির বড়োসড় সংস্কার করা হয় এবং একে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ক্রিকেটদলের বহু সুখস্মৃতির সাথে এই স্টেডিয়ামের নাম জড়িত আছে। ২০১১ বিশ্বকাপ এবং ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ও বেশকিছু ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এই ভেন্যুতে। ২০১১ সালের আইসিসি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্মরণীয় জয়টি এই চৌধুরী জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামেই আসে।

শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম

শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম
শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম

চট্টগ্রাম থেকে চোখ সরিয়ে আমরা যদি আরেক বিভাগীয় শহর খুলনার দিকে তাকাই, তাহলে সেখানে পাব আরেকটি জনপ্রিয় স্টেডিয়াম যার নাম শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাই শেখ আবু নাসেরের এর নামে নামকরণ করা হয়। এটি দেশের সপ্তম টেস্ট ভেন্যু, টেস্ট ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি সহ সবধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচই এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। চৌধুরী জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামের মতই ২০০৪ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়ামের প্রথম সংস্করণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে এটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করার অনুমতি পায়। ২০০৬ সালেই প্রথম একদিনের ম্যাচ এবং টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেও ২০১২ সালে এসে এই স্টেডিয়ামে প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।

সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম

সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম

আগে নাম ছিল সিলেট বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে, সেটিকে উন্নত করে, সংস্কার করে বর্তমানে নাম হয়েছে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। চমৎকার টিলা এবং চা বাগানে ঘেরা এই স্টেডিয়ামটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে নয়নাভিরাম স্টেডিয়ামগুলোর একটি। দেশ এবং দেশের বাইরের অনেকেই এই স্টেডিয়ামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। সিলেট বিমানবন্দর থেকে সিলেট শহরে যাওয়ার মাঝপথেই হাতের ডানপাশে পড়ে এই স্টেডিয়ামটি। স্টেডিয়ামের প্রবেশপথ, স্টেডিয়ামের চারপাশ তো বটেই স্টেডিয়ামের ভেতরটিও যেন সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বিভিন্ন স্থাপনা মিলে স্টেডিয়ামটি দেখতেও অনেকটা বিদেশি স্টেডিয়ামের মতো, যা একে করে তুলেছে অনন্য। আর দেশের একমাত্র ওপেন গ্যালারি কিংবা গ্রিন গ্যালারি সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামেই রয়েছে। ২২০০০ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেডিয়ামটি বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্রিকেটের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৪ সালে এখানে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। 

এই ছিল বাংলাদেশের কয়েকটি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম নিয়ে আমাদের আজকের লেখা। কেমন লাগলো এই লেখাটি? আমাদেরকে জানাতে ভুলবেন না। আর আপনার জন্যই আমরা প্রতিদিন পাবলিশ করি নতুন নতুন লেখা, বিভিন্ন ধরনের, রিয়েল এস্টেট এবং লাইফ স্টাইল সম্পর্কিত। সেসব লেখা পড়তে চোখ রাখুন বিপ্রপার্টি ব্লগে

Write A Comment