Reading Time: 4 minutes

কংক্রিটের এই জিবনযাপনে বলাই বাহুল্য যেকোন আর্কিটেকচার কতটা গভীরভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করছে। এমনকি একটি দেশের উন্নয়নের চাকা ঘুরাতেও রাখে মুখ্য ভূমিকা। জীবনে ভারসাম্য তৈরি করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু, যেকোন আর্কিটেকচারকে কোন বিষয়গুলো চমৎকার করে তোলে? আমি মনে করি, স্থায়িত্ব, ইউটিলিটি এবং সৌন্দর্যের পাশাপাশি দেশের সংস্কৃতিকে কিরূপ উপস্থাপন করে সেটাও একটি চমৎকার স্থাপত্য বা আর্কিটেকচারকে অদ্ভুত সুন্দর করে তোলে। যখন এই ৪টি উপাদান যেকোন আর্কিটেকচারে খুঁজে পাওয়া যায় সেটাই হয়ে দাড়ায় একধরনের স্থাপত্য বিস্ময়। আমরা যদি আমাদের দেশের দিকেই তাকাই তাহলে আমরা খুঁজে পাবো চমৎকার কিছু স্থাপত্য যেগুলো এই ৪ উপাদান নিয়েই নির্মিত। যেমন, জাতীয় সংসদ ভবন। এই ভবনের চিত্তাকর্ষক আধুনিক নকশা থেকে শুরু করে এর নির্মাণ শৈলী সবকিছু আপনাকে এই স্থাপত্যের প্রেমে হারিয়ে যেতে বাধ্য করবে। আজকে বাংলাদেশের এই শীর্ষ চারটি স্থাপত্য বিস্ময় তুলে ধরছি। পড়তে থাকুন।

জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকা 

জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকা
জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকা

শুধু ঢাকার বুকে নয় বিশ্বের দ্বারেও একটি বিশেষ ছাপ রয়েছে জাতীয় সংসদ ভবনের। ২০০ একরেরও বেশি জায়গা জুড়ে এটি গড়ে উঠেছে। লুই আই কান নামক বইয়ের লেখক জনাব রবার্ট ম্যাকার্টার এই ভবনকে বিংশ শতাব্দীর অভিনব একটি সৃষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই ভবনটির পরিকল্পনায় এক দল সেরা স্থপতি কাজ করেছেন কিন্তু এর নকশায় স্থপতি লুই আই কানের অবদান সব থেকে বেশি। সর্বোচ্চ ভূমি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলাই তাঁর মূল্য ভাবনা ছিল। নিখুঁত ভাবে তৈরি হওয়া জাতীয় সংসদ ভবনে রয়েছে লন, কৃত্তিম লেক এবং সংসদের মন্ত্রীবৃন্দদের জন্য বাসস্থান। পরবর্তীতে গঠিত সরকার মাননীয় স্পীকার এবং মাননীয় ডেপুটি স্পীকার উভয়পক্ষের জন্য বাসস্থান পরিকল্পনার আওতায় আনেন। জাতীয় সংসদ ভবন দেশের এক অন্যোন্য স্থাপত্য। নান্দনিক সৌন্দর্য এবং লেক সাইড প্রাকৃতিক দৃশ্য হাজারো পর্যটক আকর্ষণ করে থাকে। যদিওবা নিরাপত্তার লক্ষ্যে ভবনের অনেকাংশ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। কমপ্লেক্সের কেন্দ্রে অবস্থিত মূল ভবনটি তিনটি ভাগে বিভক্ত: প্রধান প্লাজা, দক্ষিণ প্লাজা, এবং প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা। বহুতল বিশিষ্ট এই ভবনে রয়েছে নয়টি পৃথক ব্লক। এছাড়াও লিফট, সিঁড়ি, বৃত্তাকার অঞ্চল  ইত্যাদি। 

লালবাগ কেল্লা, পুরান ঢাকা 

লালবাগ কেল্লা, পুরান ঢাকা
লালবাগ কেল্লা, পুরান ঢাকা

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রাচীনতম স্থাপত্য এই লালবাগ কেল্লা। মুঘল স্থাপত্যশৈলীর আকর্ষণ হিসেবে খ্যাত এই কেল্লাটির জনপ্রিয়তা আর অব্দি একটুও কমেনি। এখনো সমান ভাবেই সকলে অবাক করে যাচ্ছে। মুঘল স্থাপত্যের একটি অনবদ্য সৃষ্টি হয়ে আজও সে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের একটি গর্বিত নির্মাণ শৈলী হয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। মূল্যবান সাদা মার্বেল এবং লাল বেলেপাথরের নৈপুণ্যময় ব্যবহার এই ইমারতকে করেছে আরও আকর্ষণীয়। যা এই ইমারত জুড়ে দেখা যায়। যেহেতু কিছু অংশ অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তাই কেল্লার আসল অঞ্চলটি আজও রয়েছে অজানা। দীর্ঘ সময় ধরে,অনেকে জানতেন কেল্লার কেবল, তিনটি প্রধান ভবন রয়েছে: মসজিদ, বিবি পরীর সমাধি এবং দিওয়ান-ই-আম। তবে সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে আরও বেশ কয়েকটি কাঠামোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এই ভবনগুলোর মধ্যে, দিওয়ান-ই-আম একাধিক কারণে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান এখানেই থাকতেন। এই ভবনে সকল দৈনন্দিন সুযোগ সুবিধা ছিল যেমন, হাম্মামখানা (বাথরুম)। যেখানে গরম করার জন্য ছিল পোড়ামাটির পাইপ। এছাড়াও বলা হতো সেখানে ছিল এক রহস্যময়ী সুরঙ্গ যেখানেও কেউ ঢুকলে কখনো ফিরে আসতে দেখা যেত না। এমন অনেক গল্পই খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও কাছে থেকে দেখতে এই কেল্লাটি ঘুরে আসুন। 

ষাট গম্বুজ মসজিদ, বাগেরহাট

ষাট গম্বুজ মসজিদ, বাগেরহাট
ষাট গম্বুজ মসজিদ, বাগেরহাট

পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এর স্থাপনাটি খুঁজে পাওয়া হয়।  বলা হয় লালাবাগ কেল্লার থেকেও পুরনো এটা। শুধু ইউনেস্কোর সেরা তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে নয়, সুলতানি আমল থেকেই এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এই মসজিদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল, মোট ৮১ টি গম্বুজ থাকা সত্ত্বেও এটাকে ষাট গম্বুজ মসজিদ বলা হয়। মসজিদটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এ বিশাল মসজিদের চতুর্দিকে প্রাচীর ৮ফুট চওড়া, এর চার কোনে চারটি মিনার রয়েছে। দক্ষিণ দিকের মিনারের শীর্ষে কুঠিরের নাম রোশনাই কুঠির এবং এ মিনারে উপরে উঠার সিড়ি আছে। মসজিদটি ছোট ইট দিয়ে তৈরী, এর দৈর্ঘ্য ১৬০ফুট, প্রস্থ ১০৮ ফুট, উচ্চতা ২২ফুট। মসজিদের সম্মুখ দিকের মধ্যস্থলে একটি বড় খিলান এবং তার দুই পাশে পাঁচটি করে ছোট খিলান আছে। মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রধান মেহরাবের পাশে একটি দরজাসহ মোট ২৬টি দরজা আছে। ইউনেস্কো এ মসজিদটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের অন্যতম একটি স্থাপত্য বিস্ময় এটি। 

কান্তানগর (কান্তজীর) মন্দির, দিনাজপুর 

কান্তানগর (কান্তজীর) মন্দির, দিনাজপুর
কান্তানগর (কান্তজীর) মন্দির, দিনাজপুর

রাধা-কৃষ্ণের গল্প এবং তাদের চিরসবুজ প্রেমের চেয়ে আর কিছুই জনপ্রিয় ও মন্ত্রমুগ্ধকর হতে পারে না।  তবে কেউ যদি তাদের স্মরণীয় প্রেমের স্মৃতিতে কিছু তৈরি করে তবে তা দেখতে কেমন হবে? দিনাজপুরের কান্তানগর মন্দির এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আঠারো শতকে মহারাজা প্রাণ নাথ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন যা দেশের অন্যতম দর্শনীয় একটি কাঠামো এবং এটি বাংলাদেশের ভাস্কর্যপূর্ণ একটি স্থাপত্য বিস্ময়। আগে এই মন্দিরে নয়টি চূড়া ছিল কিন্তু  দুর্ভাগ্যক্রমে এক ভূমিকম্পে এগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এই মন্দিরকে আরও বিশেষ করে তোলে এর দেয়ালে আঁকা টেরাকোটাগুলো। কান্তজীর মন্দিরের দেওয়ালের ওপর পোড়ামাটির এ বিশাল অলঙ্করণ সে সময়ের জীবন ও প্রাণশক্তিরই প্রকাশ ছিল এবং হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের পলিময় মাটির  শক্তির ভেতর থেকেই এ শিল্প বেড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের এই আকর্ষণীয় স্থাপত্য দেখতে অবশ্যই এই মন্দির ঘুরে আসুন। 

বাংলাদেশের বুকে গড়ে ওঠা এই স্থাপত্য বিস্ময় গুলো একদিনে হয়ে ওঠেনি কালের বিবর্তনে এগুলো আজ বিশ্ব সেরা হয়েছে। সংস্কৃতির উপর এই স্থাপত্যগুলোর প্রভাব অনেক। এমন আরও স্থাপত্য বিস্ময় সম্বন্ধে জানতে পড়তে থাকুন বিপ্রপার্টির ব্লগ।

Write A Comment