Reading Time: 6 minutes

ঘুরতে আমরা কে না ভালবাসি? ঘুরাঘুরি কারও জন্য শুধুই অবসর সময় কাটানোর উপায়। আবার কারো কারো জন্য ঘুরাঘুরি হল ক্লান্ত জীবনকে পিছে ফেলে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবার পন্থা। দিনের পর দিন কাজ আর দায়িত্বের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে ঘুরতে গিয়েই যেন মানুষ রিচার্জড হয়ে আসে, পায় নতুন করে শুরু করার উদ্যমঢাকার মধ্যে এবং আশেপাশে আছে বেশকিছু ঘুরাঘুরির জায়গা। আবার দেশের আনাচে কানাচেও আছে অনেক টুরিস্ট স্পট । এই লেখা এমন কিছু টুরিস্ট স্পট নিয়েই, যা আছে বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে।

রাতারগুল

রাতারগুল
রাতারগুলে গাছের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে নৌকা

শুধু দেশ নয়, রাতারগুল গোটা বিশ্বেরই হাতে গোনা কয়েকটি স্বাদুপানির সোয়াম্প ফরেস্টের একটি। সোয়াম্প ফরেস্ট হল এমন একটি বন যা সারা বছর অথবা বছরের নির্দিষ্ট সময় জলমগ্ন থাকে। সিলেট শহরের খুব কাছেই অবস্থিত এই আশ্চর্য জায়গাটি বহুদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে ছিল। তবে সাম্প্রতিক কালে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। গোয়াইন নদী এবং চেংগেরখাল ক্যানালের সাথে সংযুক্ত গোয়াইনঘাট উপজেলার এই জায়গায় মানুষ সবচেয়ে পছন্দ করে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। পানিতে নৌকায় তো কতজনই চড়েছে কিন্তু গাছের শাখা-প্রশাখা আর ডালপালার মধ্য দিয়ে নৌকা ভাসানোর অনুভূতি পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে রাতারগুল, অবশ্যই বৃষ্টির সময়ে। কারণ শুকনা মৌসুমে এখানকার প্রায় সবটুকু পানিই শুকিয়ে যায়।

পানতুমাই/বড়হিল ঝর্ণা

পানতুমাই
পানতুমাই থেকে দেখা বড়হিল ঝর্ণা

রাতারগুলের পর আমাদের লিস্টে আছে যে গন্তব্যের কথা সেটিও গোয়াইনঘাট উপজেলারই অংশ। তবে এই  টুরিস্ট স্পট অবস্থিত একদম বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা পানতুমাই গ্রামে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বড়হিল ঝর্ণার সবচেয়ে সুন্দর ভিউ যে এখানেই পাওয়া যায়! সীমান্তে নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারণে হয়ত আপনি ঝর্ণার একদম কাছে যেতে পারবেন না কিন্তু কিছু কিছু জিনিসের সৌন্দর্য আসলে দূর থেকেই বেশি উপলব্ধি করা যায়! গ্রামের চমৎকার মানুষ আপনাকে স্বাগত জানাবে একবুক ভালবাসা নিয়ে, চাইলে ঝর্ণা থেকে গড়িয়ে আসা বরফগলা হিমশীতল পানিতে দাপাদাপি করে নিতে পারবেন আপনি। স্পটের সাথেই থাকা বিশাল মাঠে দাঁড়িয়ে আছে দুটো গোলপোস্ট, যেন আপনাকে ডাকছে ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে! আর কিছু না হলে শুধু ঘাসের উপর বসে ঝর্ণা দেখেই কাটিয়ে দেয়া যায় ঘন্টার পর ঘণ্টা।  

বিছানাকান্দি

বিছানাকান্দি
মৌসুমের আগে বিছানাকান্দি

কিছু কিছু জিনিসের বিশালত্ব বুঝতে আর সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে তা দূর থেকে দেখা প্রয়োজন। সিলেটের একদম সীমান্তঘেঁষা বিছানাকান্দি তেমনই একটি জায়গা। মেঘালয়ের সুউচ্চ “সেভেন সিস্টারস” সারিবদ্ধভাবে একে একে নেমে এসে চুমু খেয়েছে মাটিকে। তাদের ঠিক মাঝখান দিয়ে বিশাল এক ঝর্ণা থেকে আছড়ে পড়ছে জলধারা। এতই উঁচু সে ঝর্ণার উৎস যে মাঝে মাঝেই দেখা যায় মেঘ ভেসে যাচ্ছে তার নিচ দিয়ে। মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্যের দেখা মিলবে বিছানাকান্দিতেই। পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা বরফশীতল পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে শুয়ে থাকতে গিয়ে যেন মুহুর্তের জন্য ভুলে যেতে হয় জীবনের সব সফলতা ব্যর্থতা, হার জিত বা দেনা পাওনার হিসাব নিকাশ! সিলেট বিভাগের অধিকাংশ টুরিস্ট স্পট বর্ষাকালেই বেশি সুন্দর, বিছানাকান্দিও তার ব্যতিক্রম নয়। কিছুটা সড়কপথ আর কিছুটা নদীপথ মিলিয়েই যেতে হয় এই অনিন্দ্যসুন্দর যায়গাটিতে।

লাল শাপলার টুরিস্ট স্পট, ডিবির হাওর

ডিবির হাওর
হাজারো শাপলার ডিবির হাওর

হালের বিছানাকান্দি, রাতারগুল বা পানতুমাই আসার আগে ভ্রমণপিয়াসুদের অতি প্রিয় একটি গন্তব্য ছিল সিলেটের জাফলং। কালের বিবর্তনে এবং অতিরিক্ত মানুষের চাপে জাফলং-এর টুরিস্ট স্পট তার পুরনো জৌলুশ হারিয়েছে অনেকটাই। তবে এই জাফলং রোডেই রয়েছে বেশ কিছু চমৎকার টুরিস্ট স্পট । অল্প কিছুদিন হল প্রাতপ্রদীপের নিচে আসা ডিবির হাওর তারই একটি। হাওর নামে পরিচিতি পেলেও এটি মূলত একটি বিল। হাজারো লাল শাপলার নয়ন জুড়ানো দৃশ্য দেখতেই ডিবির হাওরে ছুটে আসে মানুষ। কেউ হয়ত মাটির রাস্তায় বসেই দেখে রক্তলাল শাপলা ফুলগুলো। কেউ আবার ডিঙ্গি নৌকায় উঠে ছুয়ে দেখতে চায় সেগুলোকে।  দু দেশের সীমান্তঘেঁষা একটি এলাকা। বিশাল বিস্তীর্ণ জলাভুমির মাঝখান দিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গিয়েছে একটি কাঁচা রাস্তা। সিলেট তামাবিল সড়ক ধরে এগুতে এগুতে জৈন্তা বাজার পার হয়ে দু-এক কিলোমিটার সামনে এগুলেই হাতের ডানে পাওয়া যাবে এই রাস্তাটি। সিলেটের অন্য সব টুরিস্ট স্পট থেকে কিছুটা ভিন্ন এই শাপলা বিল, শীতকালেই যে ফোটে শাপলা ফুল!

টাঙ্গুয়ার হাওর

টাঙ্গুয়ার হাওর
টাঙ্গুয়ার হাওরে গোধূলী

সুনামগঞ্জের বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা কে শোনেনি? বৃহত্তর সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই হাওরকে বলা হয়ে থাকে দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন হাওর। স্বল্প কথায় এর সৌন্দর্য বর্ণনা করা সম্ভব না। বড় নৌকায় করে মাঝ হাওরে গিয়ে রাতের আকাশের তারা দেখা হতে পারে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। সাথে মাঝিদের সঙ্গে থেকে হাওরের ফ্রেশ মাছ খেতে পারলে তো পোয়াবারো! আর বাজেট ভ্রমণ হলে টাঙ্গুয়ার ট্রিপেই যুক্ত হতে পারে যাদুকাটা নদী, তাহিরপুর, শহীদ সিরাজ লেক, বারিক্কা টিলা সহ আরও অনেক স্থান।

বান্দরবনের বিভিন্ন ট্রেইল

টুরিস্ট স্পট
বান্দরবানে অগণিত ট্রেইলের একটি

সিলেট বিভাগ রেখে এবার একটু দেশের অন্য প্রান্তে নজর দেয়া যাক। দেশে ঘুরাঘুরির কথা উঠলে সেখানে নিশ্চিতভাবেই আসবে বান্দরবানের কথা। আলীকদম, রুমা বা থানচি উপজেলার পাহাড়ি বাঁকে ছড়িয়ে আছে জানা-অজানা অসংখ্য ট্রেইল। বগালেক, কেউক্রাডং, রেমাক্রি, তিন্দুমুখ, নাফাকুম, অমিয়াকুম, সাতভাইকুম, জাদিপাই কেউই কারো চেয়ে কম নয়। এসব ট্রেইলে হাটতে হাটতে শরীরে হয়ত নেমে আসবে ক্লান্তি কিন্তু মনের ক্লান্তি ধুয়ে যাবে ক্রমশই!

বড়পাথর

বড়পাথর
বড়পাথরের মাঝ দিয়ে চলছে নৌকা

তিন্দুমুখ আর রেমাক্রি ঝিরির মাঝপথে রয়েছে এই আশ্চর্য বড়পাথর। নাম শুনে কিছুটা আন্দাজ করে গেলেও এই বড়পাথরের বিশালত্ব নিজ চোখে না দেখলে বুঝবার জো নেই। ঝিরিপথে এমন দৈত্যাকার পাথর প্রথমবার দেখে একটু হলেও বুক কাঁপেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। হাজার বছর পুরাতন বিশালাকৃতি এই পাথরগুলো দেখে প্রমত্ত প্রকৃতির অবিনাশী শক্তি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যায়।

নাফাকুম

নাফাকুম
বর্ষায় প্রমত্ত নাফাকুম

রেমাক্রিমুখ দেখার জন্য অতি চমৎকার একটি জায়গা। থাকার জন্য বেশকিছু কটেজও আছে এখানে। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা বান্দরবানে আরামআয়েশ করতে আসেন না। তাদের অনেকের জন্যই প্রাথমিক ঠিকানা হল নাফাকুম। রেমাক্রি ঝিরির আপস্ট্রিমে, সাধারণ মৌসুমে, সাধারণ মানুষ ঘণ্টা দুয়েক ট্রেকিং করলে পৌঁছাতে পারেন অনিন্দ্যসুন্দর এই নাফাকুমে। স্থানীয় ভাষায় নাফা শব্দের অর্থ মাছ (মহাশোল মাছ) এবং কুম অর্থ গভীর। নামের অর্থ থেকেই কল্পনা করা যায় এর গভীরতা সম্পর্কে। আর এই সৌন্দর্য বুঝতে হলে সামান্য কষ্ট সহ্য করে হলেও এখানে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

জাদিপাই ঝর্ণা

জাদিপাই
জাদিপাই ঝর্ণার বিশালত্ব

ছবি দেখেই ধারণা করা যায়, জাদিপাই ঝর্ণা দেশের প্রশস্ততম জলপ্রপাতের একটি। বান্দরবানের রুমা উপজেলার অন্তর্গত জাদিপাই পাড়ার এই ঝর্নায় যেতে সাধারণত কেউক্রাডং থেকে পাসিংপাড়া হয়ে দুঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ পাড়ি দিতে হয়। এপথ পুরাটাই নিচে নেমে যাবার পথ, তা বিপদজনকও বটে। তবে জাদিপাইয়ের সৌন্দর্য দেখতে অভিযাত্রীরা এটুকু সাহস করতে পিছপা হন না। বর্ষাকালে জাদিপাই ধারণ করে এক ভয়ংকর সুন্দর রূপ!

কাপ্তাই লেক

কাপ্তাই
কাপ্তাই হ্রদের শান্ত জলরাশি

বান্দরবানের মতই রাঙামাটি একটি পার্বত্য জেলা। রাঙামাটির উপজেলা কাপ্তাইতে রয়েছে এক মনোমুগ্ধকর হ্রদ যা কাপ্তাই লেক নামে বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ তো বটেই এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যেই বৃহত্তম মনুষ্যসৃষ্ট স্বাদুপানির হ্রদ। কর্ণফুলী নদীতে বাধ দেয়ার কারণে গড়ে উঠা এই হ্রদটি রাঙামাটি জেলার প্রায় ৭টি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। আর এখানেই আছে বেশ কিছু চমৎকার টুরিস্ট স্পট । চট্টগ্রাম থেকে  অনেকেই এখানে বেড়াতে যান। লেকে অনুমতি নিয়ে মাছ, কায়াকিং করা বা নৌকায় ঘোরা, যে কোনটি হতে পারে আপনার লক্ষ্য।

অনেকেই ছুটি কাটাতে দেশের বাইরে যেতে চাইলেও ছোট এই দেশেও ঘুরাঘুরির জায়গা নেহায়েত কম নয়। তার মধ্যে এই ছিল আমাদের আজকের বাছাই করা টুরিস্ট স্পট কালেকশন। এর মধ্যে কতটিতে আপনার যাওয়া হয়েছে? যাবার ইচ্ছাই বা আছে কোনটিতে? এর বাইরেও বা কোন কোন স্পটে আপনি যেতে চান? আমাদের সবকিছু জানিয়ে দিন মন্তব্যে।

আর ছোট্ট এই দেশে সবকিছু দেখে রাখার দায়িত্বও কিন্তু আমাদেরই। তাই কোন টুরিস্ট স্পটেরই ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না, ফেলে আসবেন না কোন ময়লা বা প্লাস্টিক। আপনার দেশ দেখা হোক আনন্দদায়ক।

ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার

  • পানতুমাই, বিছানাকান্দি এবং টাঙ্গুয়ার হাওরের ছবি – আল-আমিন আবু আশরাফ দোলন
  • নাফাকুম এবং জাদিপাই ঝর্ণার ছবি – রুহুল আমিন সুমন

4 Comments

Write A Comment