“আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।”
আসমানীর কথা আপনাদের মনে আছে? পাতার ছাউনিতে কেমন দেখতে তাদের পাখির বাসার মতো বাড়ি? গোলপাতার ঘরে কীভাবে কাটে তাদের সাদাসিধে জীবন? বৃষ্টি ধোয়া জানালা, খোলা বারান্দা কিংবা একান্ত চিলেকোঠা । যেন ঘরের কোণে নিজের, অন্য এক ঘর খুঁজে পাওয়া । কখনো আবার গোটা দেশটাই আমাদের ঘর। কখনো ঘর মানে শহর। ফেলে আসা ভিটেমাটি। কিংবা প্রিয় মফস্বলের চিরোচেনা গলি। ঘর নামের এই কাব্যকে কিছুতেই চার দেয়ালে আটকে রাখা যায় না, তাই আজ আমরা জানবো, বাংলার নানারকম ঘর-বাড়ি সম্বন্ধে আর সেখানো কাটানো স্মৃতি সম্বন্ধে!
গোলপাতার ঘর
সবুজের মাঝে সরু আঁকাবাঁকা পথ। সেই পথের বাঁকে বাশ অথবা কাঠের বেড়ায় গোলপাতার ছাউনিতে ছোট ছোট ঘর। নাম গোলপাতা হলেও গোলপাতা কিন্তু গোল না। সুন্দরবনের অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষের একটি হলো গোলগাছ। এই গোলগাছের গোলপাতা খানিকটা মিলে যায় নারিকেল পাতার সাথে। গোলপাতার ছাউনিতে ঘর গ্রীষ্মকালে শীতল থাকে আর শীতে ঠাণ্ডা। সুন্দরবনের কাছে হওয়ায় পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা কিংবা সাতক্ষীরার মতো অঞ্চলগুলোতে গোলপাতা নিরাপদ আশ্রয়ের আরেক নাম। শহরতলীতে ইট, কাঠ আর পাথরের ভীড়ে গোলপাতার ঘর হারিয়ে গেলেও। তবে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে প্রান্তিক মানুষগুলো। গোলপাতার এই ছোট্ট ঘরেই বেচে থাকে তারা। সেখানেই জীবনের নানা রূপ ফুটে ওঠা। কখনো অভিমান উঁকি দেয় আবার কখনো মুচকি হাসি। দুপুরের মিষ্টি রোদে ঘরের লোকেদের কণ্ঠে বেজে ওঠে কোনো এক আঞ্চলিক গান। তবুও, ছোট্ট কুটিরে সুখ খুঁজতে জানে তারা। গোলপাতার ছাউনিতে কী যত্নে তারা গড়েছে তাদের ঘর নামের ভালো বাসা!
গেরস্থ বাড়ি
বাঁশের ব্যাড়া আর টিনের ছাউনিতে যে গল্পগুলো লুকিয়ে থাকে সেগুলোই হল গেরস্থ বাড়ি। বাড়ির পাশে ছোট্ট এক পকুর যেখানে চাষ করা হতো মাছ। আর গোলা ভরা ধান তো আছেই। বাংলার বুকে এই গেরস্থ বাড়ির নানা চিত্র একটু একটু করে ফুটে ওঠে। কখনো বাড়ির উঠানে কিশোরীর এক্কা দোক্কা খেলা আবার কখনো সকলে মিলে, অলস দুপুরে গপ্পো করা। বাংলার বুকে এমন বাড়িগুলো বরাবরই নানা স্মৃতি বহন করে আসে। ১৫-২০ জনের বিশাল এক পরিবার বসবাস করছে একই ছাদের নীচে। থাকা এখনকার সময়ে আর কোথায় দেখা যায়। গেরস্থ বাড়ির সব কিছুতেই ষোল আনা বাঙালিয়ানা ফুটে ওঠে! এক সাথে সকলে মিলে থাকতে গেলে কড়াই খুন্তির ঠোকাঠুকি হলেও, ভাতের হাড়ি আলাদা হয় না। তাইতো রান্না হয় বড় এক পাতিলে সকলের জন্য। নব্বই দশকে এমন পরিবারের সন্ধান বেশ মিলত। বাড়ির ঢালাও বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে সবার জন্য খাওয়ার আয়োজন। এই গৃহস্থ বাড়ির একমাত্র আভিজাত্যের প্রতীক বাহির আঙিনার কাচারি ঘর। বাড়ির সালিশ, বৈঠক থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়নের কেন্দ্র এই ঘর। ঠিক যেন গেরস্থ বাড়ির ড্রয়িং রুম। তখনকার সময়ের ড্রয়িং রুমের সাজ এখনকার মত মোটেও ছিল না। পুরো বাড়িকে সাজিয়ে রাখতো সোনা রাঙা ধান। আর এই সাজে সুর দিত ঢেঁকিঘর। সেখান থেকে একই তালে বাজছে ঠক ঠক আওয়াজ। চলতে থাকে ধান ভানার উৎসব। যদিও সময়ের সাথে এই গেরস্থ বাড়ি আজ নেই বললেই চলে। কিন্তু স্মৃতিতে সে তো আজও অমলিন।
মাটির বাড়ি
বাংলার নানারকম ঘর-বাড়ি নিয়ে গল্প করতে বসলে যে কথাটি সব চেয়ে বেশি মনে নাড়া দিবে তা হলো, মাটির বাড়ির গল্প। শীতল পরিবেশে ছিমছাম এক আশ্রয়স্থল। যেখানে কেটেছে অনেকের সুন্দর এক সময়। মাটির বলেই ঘরের ভিতরটা প্রখর গ্রীষ্মতেও শান্ত সুশীতল। সাথে দক্ষিণের জানালা দিয়ে দমকা বাতাস। বাড়ির লাল বউ তখন হয়তো ভেজা চুল শুকিয়ে নিচ্ছে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর ভেজা পায়ের ছাপে গাঢ় হয়েছে মাটির রঙ। বাড়ির পাশেই পুকুর সেখান সাতার কাটছে ছোট ছোট শিশুরা। এটাই তো জীবন আসলে। এই মাটির ঘরের মতোই সরল এ বাড়িতে বসবাস করা মানুষগুলো। ব্লকের পর ব্লক সাজিয়ে মাঝে আঠালো কাদার প্রলেপ এটে যেমন ঘর বানানো হয় ঠিক তেমনি করেই সাজানো তাদের প্রতিটি সম্পর্ক। যে সম্পর্কে আঠালো কাদার মতোই শক্ত গাথুনির নাম ভালোবাসা।
টিনের নকশা ঘর
বাংলার নানারকম ঘর-বাড়ি এর মধ্যে এখন যে ঘরটি প্রচলিত আছে তা হলো টিনের বাড়ি! টিনের ঘরের চালে বৃষ্টির শব্দ যেন পানির প্রতি ফোটার সাথে তৈরি করে একেকটি নতুন গান। বৃষ্টি ধোয়া জানালা, খোলা বারান্দা কিংবা একান্ত চিলেকোঠা যেন ঘরের কোণে নিজের, অন্য এক ঘর খুঁজে পাওয়া। টিনের ঘর করে তাড়া ক্ষান্ত নয় আঁকেন নকশাও। ঢাকা থেকে প্রায় ৯৭কিলো মিটার দূরে কুমিল্লা জেলা। আর সেই জেলার ছোট্ট একটা উপজেলা হোমনা। সেখানেই নাকি নকশা কেটে ঘর বানান টিন কারিগররা। টিনের ঘরের মানুষের যেখানে হাজার বছরের সখ্যতা। জুড়ি মেলা ভার সেই ঘরে আঁকা রঙিন নকশার। কুমিল্লা জেলার হোমনা, দাউদকান্দি, মেঘনা, তিতাস। গ্রামগুলোকে নকশা গ্রাম বললেও একদম ভুল হবে না। নকশাগ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘর নকশা করা টিনে তৈরি।
তবে এই টিনের ঘরের কারিগরদের ইতিহাস অনেক পুরনো। বংশ পরম্পরায় ঘর বানিয়ে আসছেন শতাধিক কারিগর। যেন নিপুণ হাতের কারুকাজে ঘর বানানোর বিশাল কর্মযজ্ঞ। ঘরের সাজে নান্দনিকতার ডিজাইনের এসব রেডিমেড ঘরের রয়েছে নানারকম নাম। আসাইম্মা, চুয়ারি, দোচালা, টপ বারান্দা কিংবা গোলাবাড়ি, মিষ্টি মিষ্টি নামের এসব ঘরগুলোর চাহিদাও রয়েছে বেশ। এখানকার গ্রামীণ জীবনে এই টিনের ঘরেই গড়ে ওঠে ভালোবাসা।
আগেরকার বাড়িগুলোর ব্যাপারটাই ছিল বেশ আবেগী। বিলাসিতার ছোঁয়া না লাগা এই ঘরগুলো আসলেই বেশ আপন। বাংলার ইতিহাস ঘাটলে এমন অনেক বাহারি ঘরের খোঁজ অবশ্যই মিলবে। তার আগে বলুন কেমন লেগেছে আজকের এই ব্লগ!