Reading Time: 6 minutes

সমাজ, দেশ এবং ধর্ম- এ তিনে মিলেই একটি দেশের মানুষ এবং সে দেশের পরিচয়। একটি দেশের মানুষের আচার-আচরণ, রীতিনীতি, বিশ্বাস, জীবনযাত্রার ভাষা; এ সবই জড়িত সে দেশের সংস্কৃতির উপর। সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হিসেবে প্রতিটি ধর্মের মানুষই সে দেশের, সমাজের এবং জাতির পরিচয় বহন করে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলার বিভিন্ন সংস্কৃতি, জনগোষ্ঠী এবং আচার-অনুষ্ঠান এর রয়েছে ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। যা যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। বাংলার সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায় নিয়ে আরও বিস্তারিত থাকছে আমাদের আজকের ব্লগে। তবে চলুন জেনে নেয়া যাক!

Boishakh Celebration
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বৈশাখ উদযাপনে থাকে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন

দক্ষিণ এশিয়ার ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ। আয়তনে খুব বড় না হলেও, জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাটা বেশ বড়। সাহিত্য, সঙ্গীত, রন্ধনশিল্প, নৃত্য, পোশাক এবং উৎসব উদযাপনে এ দেশের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। যার চর্চা জাতিগত ভাবে একেক রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবের মধ্যে রয়েছে দুর্গা পূজা, কালী পূজা, সরস্বতী পূজা ইত্যাদি। বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের প্রধান উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং খ্রিস্টানদের বড়দিন এর উৎসব উদযাপিত হয় বেশ ভালোভাবেই। এছাড়া সার্বজনীন উৎসবের মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখ, যা বাংলা নতুন বছরের প্রথমদিন। এছাড়া বাংলার গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন লোকজ উৎসব যেমন- নবান্ন উৎসব, পৌষ পার্বণ ইত্যাদি। এছাড়া বাংলাদেশি হিসেবে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের দিনটিও উদযাপিত হয় যেকোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। 

বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বড় অংশ হলো উপজাতি সম্প্রদায়। এর মধ্যে রয়েছে গারো, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, মনিপুরী, খাসিয়া ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত চাকমা সম্প্রদায়। হাজার বছর ধরে এই ভূখণ্ডে বাস করা বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর অনেকেই আবার বর্ডারের অন্যপাশে অর্থাৎ ভারতেও বসবাস করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪৫টি। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলার সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায় ও  তাদের জীবন ব্যবস্থা নিয়েই মূলত আমাদের আজকের আয়োজন।

চাকমা

Bamboo Plants
বাঁশের ভেতরে যেমন রান্না করা হয়, তেমনি কচি বাঁশ সবজি হিসেবে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে

শত বছরের পুরাতন বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করা চাকমা সম্প্রদায় এর রয়েছে বৌদ্ধ মন্দির বা হিয়ং। আর এ সম্প্রদায় এর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বলা হয় ভান্তে, যারা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধায়ন করে থাকেন। চাকমারা মূলত আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। যদিও তাদের কথার মধ্যে চাটগাঁইয়া ভাষারও বেশ মিল পাওয়া যায়। চাকমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, লোক সাহিত্য ও ঐতিহ্য, রয়েছে ভিন্ন ডিজাইনের পোশাক। বিশেষ করে মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রে কোমর থেকে গোড়ালি জড়ানো অংশটি পিনোন এবং কোমরের উপর অংশটি হাদি হিসেবে পরিচিত। হাদি ও পিনোন সাধারণত বিভিন্ন রঙ এবং নকশার হয়ে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা আদিকাল থেকেই মাচাঙ ঘরে বসবাস করে আসছেন। তবে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে বসতবাড়ির কাঠামোতেও। এখন তারা আধা পাকা ও বড় দালানকোঠায়ও বসবাস করেন। বাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে সাধারনত বাঁশ, বড় গাছ ব্যবহার করা হয় যা ঘরকে মজবুতভাবে বানাতে সহায়তা করে। এছাড়া ছাউনি এর জন্য বাঁশের পাতা ব্যবহার করা হয়।

চাকমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো বিজু। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এ উৎসব পালিত হয়। বাংলা বছরের শেষ দিনের আগের দিনকে বলা হয় ফুল বিজু এবং শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি বা মূল বিজু। আর মূল বিজুর দিন চাকমা তরুণ-তরুণীরা ভোর বেলায় কলা পাতায় করে কিছু ফুল পানিতে ভাসিয়ে দেন। নতুন জামাকাপড় পরে উদযাপন করা এই দিনটি চাকমা সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ একটি দিন। এছাড়া আরেকটি বিশেষ উৎসব হচ্ছে বৌদ্ধ পূর্ণিমা।  

বাংলার সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায় এর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম ‘সিদল’, যা মূলত শুঁটকি জাতীয় খাবার। এছাড়া আরেকটি বহুল প্রচলিত খাবার হচ্ছে ‘হোরবো’।  এছাড়া বাঁশের ভেতরে মাছ মাংস রান্না করার এক ধরনের প্রচলন আছে চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে। আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হল ‘পাচন তোন’, যা বিজু উৎসবে রান্না করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবে বিন্নি পিঠা, বড়া পিঠা, শান্নে পিঠা ইত্যাদি মিষ্টান্ন বানানোরও প্রচলন রয়েছে।

মারমা

Lantern Festival
বৌদ্ধ পূর্ণিমার দিন আকাশে ওড়ানো হয় ছোট-বড় অনেক ধরনের ফানুস

বাংলার সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায় এর মধ্যে মারমা সম্প্রদায়ের বসবাস তিনটি পার্বত্য অঞ্চলে হলেও, মূলত এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই থাকেন বান্দরবানে। চাকমাদের মতো তারাও বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করে থাকেন। মারমাদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও লেখার ক্ষেত্রে তারা বার্মিজ বর্ণমালা ব্যবহার করেন। মারমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা এবং সাংগ্রাই। চাকমাদের মতো মারমা সম্প্রদায়েরও রয়েছে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, যা সাংগ্রাই নামে পরিচিত।  এছাড়া বুদ্ধ পূণির্মা, প্রবারণা পূর্ণিমার উদযাপন ও করা হয় বেশ উৎসবমুখর ভাবেই। এই দিন মারমাদের ঘরে সুস্বাদু পিঠা তৈরী করা হয় এবং রাতের বেলায় আকাশে ওড়ানো হয় উজ্জ্বল  ফানুস বাতি। বাংলাদেশে চাকমা জনগোষ্ঠীর পর দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত এই মারমা সম্প্রদায়।

মারমা সম্প্রদায়ে আঠালো ভাতের সাথে ‘নাপ্পি’ অর্থাৎ শুঁটকি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এছাড়া বিন্নি চালের সাথে নারিকেল ও চিনি যোগ করে স্যুপের মতো আঠালো করে এক প্রকার খাবার তারা খেতে পছন্দ করেন। ‘সাংগ্রাই’ উৎসবে বিভিন্নি সবজি ও শুঁটকি দিয়ে ‘হাংরো’ তৈরি করা হয়, যা তাদের একটি ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। তবে তাদের পছন্দের তালিকায় থাকা আরেকটি খাবার হচ্ছে কচি বাঁশ সিদ্ধ, যা তারা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকেন, যা বাঁশকড়ল নামে পরিচিত। বিকেলের নাস্তায় থাকে ‘মুন্ডি’ যা দেখতে অনেকটা ন্যুডলসের মতো, যার শুঁটকির গুঁড়ো ও গরম পানি দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

ত্রিপুরা

Traditional ethnic dance
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যানুষ্ঠান

বাংলার সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায় এর মধ্যে আরেকটি পরিচিত সম্প্রদায় হচ্ছে ত্রিপুরা, যাদের অনেকে আবার ভারতেও বসবাস করেন। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড ও মিরসরাই, কুমিল্লা, নোয়াখালীর বিলোনীয়া অঞ্চল, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরা বসবাস করেন। তাদের জীবন-জীবিকা, আচার ব্যবস্থার সাথে গীতি নৃত্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজনে অবশ্যই গীতি বাদ্য ও নৃত্য অনুষ্ঠান রাখা হয়। এমনকি যখন কোনো ত্রিপুরা জন্মগ্রহণ করে, তার আগমনী বার্তাও জানানো হয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে। 

জুম চাষের সাথে শুরু থেকেই যুক্ত আছেন ত্রিপুরা সম্প্রদায়। ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্যের মধ্যে তারা বিভিন্ন উৎসব ও পূজা পার্বণ সম্পন্ন করে থাকেন। চাকমা সম্প্রদায়ের মতো তাদেরও প্রধান উৎসব নববর্ষ , যা বৈসুক নামে পরিচিত। তাদের প্রধান খাবার হল ভাত। ভাতের সাথে সিদ্ধ সবজি, মরিচ ও ভুট্টা তাদের পছন্দের খাবার। ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসুক’ তাদের মাংস রান্নার প্রচলন রয়েছে। এছাড়া এইদিন বিন্নি চালের পিঠা ও কলাপাতা এবং লাইরু পাতা দিয়েও পিঠা তৈরি করে থাকেন। আর অতিথি আপ্যায়নে ত্রিপুরাদের রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। 

সাঁওতাল

Boil Rice
সাঁওতালদের অন্যতম প্রধান খাদ্য ভাত, যদিও রান্নার পদ্ধতিতে থাকে ভিন্নতা

বাংলার সংস্কৃতি ও সম্প্রদায় এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। যারা মূলত দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে বসবাস করেন। দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ি এবং রংপুর জেলার পীরগঞ্জে সাঁওতালরা অধিক সংখ্যায় বসবাস করেন। এছাড়া রাজশাহী এবং বগুড়া অঞ্চলে কিছু সংখ্যক সাঁওতাল রয়েছেন। সাঁওতালদের বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে ‘সোহরাই‘ অন্যতম। এছাড়া ‘বাহা‘, ‘দাসাই‘ নামের জনপ্রিয় উৎসব উদযাপন এর প্রথা রয়েছে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে।  সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য ভাত, যদিও তাদের রান্নার পদ্ধতি ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ভাত রান্নায় তারা পানি পুরোপুরি না শুকিয়ে সিদ্ধ গরম পানি থাকা অবস্থাতেই পরিবেশন করেন। আর সাথে মাছ, কাঁকড়া, খরগোশ ও পাখির মাংস পছন্দ করেন।

গারো

Dry Fish
রান্নায় শুঁটকির ব্যবহার থাকা চাই-ই চাই

বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় বসবাসকারী সম্প্রদায় এর অন্তর্ভুক্ত গারো জনগোষ্ঠী। ময়মনসিংহ ছাড়াও টাঙ্গাইল, সিলেট, শেরপুর, নেত্রকোণা, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ গারোরা বসবাস করে থাকেন। গারোরা মূলত খ্রিষ্টান ধর্ম অনুসরণ করে থাকেন। তবে হিন্দু ধর্মালম্বীদের মত তারা পূজাও করে থাকেন। তাদের প্রধান ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসব হচ্ছে ওয়ানগালা, যা ওয়ান্না নামেও পরিচিত। ঘরে ফসল তোলা উপলক্ষ্যেই মূলত এই উৎসব উদযাপন করা হয়। 

গারোদের খাবারে তেল ও মসলার ব্যবহার খুবই কম থাকে। তারা অধিকাংশ খাবারের সাথেই শুটকি ও খাবার সোডা ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণে শূকরের মাংস প্রধান খাদ্য হিসেবে পরিবেশিত হয়। এ মাংসের সাথে চালের গুঁড়ো, আদা, রসুন, পেয়াজ ও মরিচ দিয়ে তৈরি করা হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ওয়াক ঘুরা’। মাটির নিচে হওয়া এক ধরনের বিশেষ বড় জাতের আলুর সাথে শুঁটকি ও সোডা দিয়ে তারা রান্না করেন, এছাড়া ছোট মাছ কলা পাতায় মুড়িয়ে আগুনে পুড়িয়ে ‘হিথোপ্পা’ নামক খাবার তৈরির প্রথা রয়েছে।  

উৎসব উদযাপনে একেক সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন রীতিনীতি বা প্রথা থাকলেও বাংলার সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায় এর ধারন করা প্রতিটি উৎসবই বাংলাদেশিদের জন্য বিশেষ। তাই তো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউই অংশ নিতে পারে এই উৎসবের আমেজে।      

Write A Comment

Author