Reading Time: 5 minutes

“খনা”, নামটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের কাছে কিংবদন্তী তূল্য। মূলত কৃষি উৎপাদন এবং প্রকৃতি ভিত্তিক বিভিন্ন উপদেশই খনার বচনের মূল উপজীব্য। বাসার সামনে কেমন ঔষধি গাছ রোপণ করা উচিত সে বিষয়ে একটি খনার বচন দিয়েই শুরু করা যাক।

নিম নিসিন্দা যথা,

মানুষ কি মরে তথা?

হাজার বছর আগে খোদ খনাই বলে গিয়েছেন যে নিম নিসিন্দা গাছ বাড়ীর জন্য অত্যন্ত ভালো। মানুষ মরণশীল, সে মারা যাবেই। কিন্তু নিম নিসিন্দার মত গাছ রোগ বালাইকে রাখে দূরে। আমাদের আজকের ইট কাঠ পাথরের জীবনে গাছ লাগানোর সুযোগ হয়ত খুব কম তবে ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে “ছাদ কৃষির” ধারণা। আর আমাদের আজকের লেখা এমন কিছু গাছ নিয়েই যা আপনার বাসা থেকে শুধু অসুখ-বিসুখই দূরে রাখবে না বরং বাসার সৌন্দর্যও বাড়াবে। বাসার সামনে সামান্য জায়গায় কিংবা ছাদে এসব সৌন্দর্যবর্ধক বা ঔষধি গাছ লাগাতে পারেন আপনি।

তুলসী

বাড়ির উঠোনে তুলসী গাছ
বাড়ির আঙ্গিনায় একটি তুলসী গাছ

তুলসী একটি জনপ্রিয় ঔষধি গাছ। তুলসী শব্দটির সাথে কেউ যদি “তুলনা” শব্দের মিল খুঁজে পান তাতে অবাক হবার কিছু নেই কেননা তুলসী অর্থ “যার তুলনা নেই”। গ্রামেগঞ্জে প্রায় সব সব বাড়িতেই তুলসী গাছ দেখতে পাওয়া যেত একসময়। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রায় সবার বাড়িতেই থাকে তুলসী গাছ।

তুলসী গাছের যে অংশটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেটি এর পাতার রস। তুলসী পাতার রস সুগন্ধিযুক্ত কিন্তু এর স্বাদ তিতে এবং কটু। সর্দি কাশির নিরাময়ে এই রস টনিকের মত কাজ করে। বাজারে এখন সর্দি-কাশি বা কফ নিরাময়ে যে সব সিরাপ পাওয়া যায় তার অধিকাংশই বাজারজাতকরণের জন্য এতে যে তুলসীর নির্যাস রয়েছে সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা থাকে। এছাড়াও তুলসী কৃমিনাশক, হজমকারক ও এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে, দাঁতের ব্যাথা উপশমকারী বলে টুথপেস্ট তৈরিতেও তুলসী ব্যবহার আছে।

তুলসী গাছ খুবই ছোট হয় এবং এর শিকড় খুব গভীরে পৌছায় না। এজন্য চাইলে যে কেউ খুব সহজেই বাসার ছাদে এই গাছ লাগাতে পারেন।

ঔষধি গাছ নিম

ঔষধি গাছ নিমের পাতা
নিম পাতা

নিম আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔষধি গাছ । নিম গাছের ডাল, পাতা বা রস, ছাল বা বাকল, নিমের তেল,বীজ এমন কোন অংশ নেই যা কাজে লাগে না। নিমগাছের গুণাবলী এতই যে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্নভাবে নিম গাছ ধ্বংস করাকে নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষনা করেছে নিম গাছকে।

নিম গাছের ঔষধি গুণাগুণ বলে শেষ করা যাবে না।  কৃমিনাশক হিসেবে নিমের রস খুবই কার্যকর। বিশ্বব্যাপী নিম গাছ, গাছের পাতা, শিকড়, নিম ফল ও বাকল ওষুধের কাঁচামাল হিসেবে পরিচিত। ছত্রাকনাশক, ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসরোধক হিসেবে, ম্যালেরিয়া নিরাময়ে,দন্ত চিকিৎসায় জন্ম নিয়ন্ত্রণে, কোথায় নেই নিমের ব্যবহার! ভাবতে আশ্চর্য লাগে আজ থেকে হাজার বছর আগেই কীভাবে খনা নিমের এত গুণাগুণ জানতে পেরেছিলেন!

নিম একটি বহুবর্ষজীবি ও চিরসবুজ বৃক্ষ। নিমের কাঠ খুবই শক্ত। এ কাঠে কখনো ঘুণ ধরে না বা উইপোকা খেতে পারে না। এ কারণে নিম কাঠের আসবাবপত্রও তৈরি করা হচ্ছে আজকাল। বৃক্ষ হলেও নিম গাছ জন্মাতে যে অনেক বেশি জায়গা লাগে তেমন নয়। বাসার সামনে সামান্য খালি জায়গা পেলেই সেখানে নিম গাছ লাগান। এক সময়কার মহীরুহ আম গাছ, লিচু কিংবা পেয়ারা গাছও এখন ছাদে, ড্রামের ভেতর ফল দিচ্ছে। সেখানে যে কদিন পর নিম গাছ জন্মানো সম্ভব হবে না কে জানে?

আমলকী

কিছু আমলকি ফল
কিছু আমলকি ফল

আমলকী আমাদের দেশীয় ফল হিসাবে বেশ জনপ্রিয়। এটি একপ্রকার ভেষজ ফল। এর ঔষধি গুণাগুণ অনেক। আমলকী তে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি’। এজন্য আমলকীতে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ দরকার। মাত্র ২টি আমলকি থেকেই এই পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া সম্ভব।  গ্রিন টি আমরা অনেকেই খাই, গ্রিন টি-তেও থাকে প্রচুত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। বুড়িয়ে যাওয়া ও সেল ডিজেনারেশনের অন্যতম একটি কারণ ফ্রি র‍্যাডিকেলস। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফ্রি র‍্যাডিকেলস প্রতিরোধক।

একসময় প্রচুর আমলকী গাছ আমাদের আশেপাশে দেখা গেলেও বর্তমানে এ গাছের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এমন একটি অসাধারণ গুণ সম্পন্ন ঔষধি গাছ রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। তাই সুযোগ পেলেই আমলকী গাছ লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।

ঘৃতকুমারী (অ্যালোভেরা)

ঔষধি গাছ অ্যালোভেরা
ঘৃতকুমারী গাছ

বিভিন্ন সাবান, শ্যাম্পু বা প্রসাধনীর মার্কেটিং এর ফলেই হোক অথবা অন্য কোন কারণেই হোক, অ্যালোভেরা শব্দটি আমাদের অনেকেরই জানা। এই অ্যালোভেরাই হল ঘৃতকুমারী। এর আরেকটি বাংলা নাম ‘তরুণী ঔষধি গাছ’। দেশে ঘৃতকুমারী নামটিই বেশি পরিচিত। অনেকে একে শুধু ‘কুমারী’ বলেও ডাকেন।

ভেষজ গাছ হিসেবে এর কদর সারা বিশ্বজুড়ে। ঘৃতকুমারী একটি রসালো  প্রজাতির উদ্ভিদ। মানবদেহের জন্য যে ২২টি অ্যামিনো অ্যাসিড প্রয়োজন তার ৮টিই উপস্থিত এই ঘৃতকুমারীতে। এছাড়া এতে আরও আছে ২০ রকমের খনিজ। একইসাথে ঘৃতকুমারীতে রয়েছে ভিটামিন A, B1, B2, B6, B12, C এবং E। খুবই স্বাভাবিক যে গোটা বিশ্বজুড়েই এই গাছের জুস, ক্যাপসুল বা জেল আকারে বিক্রি হচ্ছে। এটি একটি বহুবর্ষজীবি ভেষজ উদ্ভিদ। এটি দেখতে অনেকটা আনারস গাছের মতো। এর পাতা বেশ পুরু এবং দুইপাশে করাতের মতো কাঁটা থাকে। এর ভেতরে থাকে স্বচ্ছ পিচ্ছিল শাঁস যেটিই মূলত ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

ঘৃতকুমারী জন্মানো যায় প্রায় সব রকম মাটিতেই। তাই সামান্য জায়গা থাকলে আপনার ছাদে কিংবা বারান্দার এক কোনায় টবে লাগিয়ে দিন অ্যালোভেরা গাছ! এটি লাগাতে পারেন আপনার সদর দরজার সামনেও, উপকারের সাথে সাথে এটি আপনার সদর দরজার সৌন্দর্য বাড়াতেও বড় ভূমিকা রাখবে।

পুদিনা

পুদিনা পাতা
পুদিনা পাতা

খুঁজলে হয়ত অনেককেই পাওয়া যাবে যিনি “মিন্ট” শব্দটির সাথে পরিচিত। এই মিন্ট প্ল্যান্টের বাংলাই হল পুদিনা গাছ। পুদিনা প্রাচীনকাল থেকেই বেশ জনপ্রিয় ঔষধি গাছ হিসেবে পরিচিত। অসংখ্য রোগ নিরাময়ে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পাওয়া যায়। পুদিনা পাতায় আছে চমৎকার এক ধরনের সুগন্ধ। এই গাছের পাতা তরকারির সাথে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে পুদিনা পাতা দিয়ে রঙ চা-ও বেশ জনপ্রিয়।

পুদিনা গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। বিশ্বের অনেক দেশেই পাওয়া যায় পুদিনার গাছ । বাসার ছাদে বা আলো বাতাস আসে এমন বারান্দার টবে লাগানো গাছ থেকে খুব সহজেই পুদিনা পাতা পাওয়া সম্ভব।

মানুষ একসময় প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে বাস করত। উন্নতি, অগ্রগতি বা শিল্পন্নোয়ন, যে কারণেই হোক না কেন, সেখান থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। তবে সবুজের সাথে মানুষের যে আত্মার টান তা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেই আধুনিক স্থপতিরা সারা পৃথিবীতেই এমন ডিজাইন করতে চেষ্টা করছেন যাতে থাকে সবুজের ছোঁয়া। আর সেজন্যই ছাদে, বারান্দায় বা সামনে সামান্য খালি জায়গাতে এমন ঔষধি গাছ লাগানোর গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। বেঁচে থাকার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? আর বেঁচে থাকার প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে ঔষধি গাছগুলো। নিশ্চিতভাবেই এসব গাছ আপনার বাড়িতে বয়ে আনে সৌভাগ্য!

এই লেখাটি আপনার কাজে লেগে থাকলে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। আর এরকম অন্যান্য লেখা পড়তে চাইলে বিপ্রপার্টি ব্লগে সাবস্ক্রাইব করুন এখনই! 

Write A Comment