বাড়ি নির্মাণ আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের একটি। তাই এ নির্মানকাজে কোন কোন উপকরণ ব্যবহার হবে, কেন ব্যবহার হবে, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে থাকে নানা সংশয়। এই সংশয় দূর করে নির্মাণ সামগ্রী বাছাইয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে, জানতে হবে এর খুঁটিনাটি দিকগুলো। ভবন নির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে অন্যতম উপাদান হচ্ছে সিমেন্ট। আজকের লেখায় আমরা জানবো বাড়ি নির্মাণে সিমেন্ট এর রকমফের, সতর্কতা, সঠিক সিমেন্ট বাছাই সহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে।
সিমেন্ট কেনার আগে সতর্কতা
বাড়ি নির্মাণে সিমেন্ট একটি সংযোগকারী উপাদান যা কংক্রিট, মর্টার, প্লাস্টারসহ বিভিন্ন কাজে বালি এবং খোয়ার সংযোগ ঘটায়। সিমেন্টের উপরই নির্ভর করে একটি স্থাপনা কতটা মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। তাই সবসময় অনুমোদিত বিক্রেতার কাছ থেকে গুণগত মানসম্পন্ন সিমেন্ট কেনা উচিত। সেক্ষেত্রে দাম একটু বেশী হলেও বাড়ির মান এবং সুরক্ষার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সিমেন্টের মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সিমেন্টের মিহিত্ব পরীক্ষা, জমাট বাঁধার সময় প্রাথমিক ও শেষ ধাপে পরীক্ষা, সাউন্ডনেস পরীক্ষা এবং রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পরীক্ষা এবং কমপ্রেসিভ ও টেনসাইল স্ট্রেংথ পরীক্ষা করিয়ে নেয়া যায়। যাচাই বাছাই করে বাজারে ভালো ব্র্যান্ডের সিমেন্ট কিনলে সাধারণত সিমেন্ট এর গুণগত মান নিয়ে আশঙ্কা করার প্রয়োজন হয় না।
মানসম্মত সিমেন্ট এর সুবিধা
সিমেন্টই একটি গোটা স্থাপনাকে ধরে রাখে। এক্ষেত্রে মানসম্মত সিমেন্ট টেকসই নির্মাণের নিশ্চয়তা দেয় এবং তাপের তারতম্যের কারণে সৃষ্ট ফাটল রোধ করে। যে কোনো ভালো মানের সিমেন্ট মাটি, পানি এবং বাতাসের ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও, ভবনে রডসহ যে লোহা জাতীয় উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোকে মরিচা ধরার হাত থেকে রক্ষা করে। কেবল গঠনগত দিক থেকেই নয়, মানসম্মত সিমেন্ট ব্যবহার করলে তা বাহ্যিকভাবেও স্থাপনার সুন্দর ও সমৃণ ফিনিশিং দেয়। ভালো মানের সিমেন্ট পরিবেশ বান্ধব হয়ে থাকে, যা ক্ষতিকারক রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রতিরোধ করে এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধক স্থাপনার জন্যও ভালো কাজ করে।
সিমেন্ট সংরক্ষণ এর উপায়
সারা বিশ্বে অনেক ধরনের সিমেন্ট আছে । তবে, বাংলাদেশে সাধারণত ৪ ধরনের সিমেন্ট এর ব্যবহার দেখা যায় ।
১.সাধারণ পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
২.হোয়াইট সিমেন্ট
৩.পোর্টল্যান্ড প্রজ্জোলনা বা ফ্লাই অ্যাশ সিমেন্ট এবং
৪.ব্লাস্ট ফার্নেস স্লাগ সিমেন্ট
একেক ধরনের সিমেন্ট ব্যবহারে একেক ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। সিমেন্ট ঠিক মত বাছাই করতে পারলে স্থাপনায় দীর্ঘস্থায়ী শক্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।
সাধারণ পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
কিছুদিন আগেও এই ধরনের সিমেন্ট ছিল বাংলাদেশের একমাত্র সিমেন্ট। সব ধরনের কাজের জন্য এই সিমেন্ট ব্যবহার করা হত। কিন্তু বর্তমানে ভারী নির্মাণ কাজে এখন আর সাধারণ পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় না। কারণ এই সিমেন্ট পানির সঙ্গে মিশালে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয় যা ভারী নির্মাণ কাজের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মাঝারি আকৃতির নির্মাণ কাজের জন্য এই সিমেন্ট অত্যন্ত উপযোগী।
পোর্টল্যান্ড প্রজ্জোলনা বা ফ্লাই অ্যাশ সিমেন্ট
সিমেন্টের প্রধান উপকরণ হলো ক্লিংকার আর এই ক্লিংকারের প্রধান উপকরণ চুনাপাথর। চুনাপাথর পানির সাথে বিক্রিয়া করে প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে যা ভারী এবং বিশাল আয়তনের নির্মাণ কাজের জন্য ক্ষতিকর। তাপ বেশি উৎপন্ন হলে ঢালাইয়ের পর স্থাপনাতে সূক্ষ্ম ফাটল দেখা দেয়, যা হেয়ার ক্র্যাক নামে পরিচিত। বর্তমানে এই সমস্যা দূর করার জন্য সিমেন্টে ক্লিংকারের পরিমাণ কমিয়ে তার জায়গায় কয়লা চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার করা হয়। ফ্লাই অ্যাশ সিমেন্ট ঢালাইয়ের সময় খুব কম তাপ উৎপাদন করে, ফলে ঢালাই শক্ত হওয়ার পরে হেয়ার ক্র্যাক এর প্রবণতা কমে যায়। ভারী কন্সট্রাকশন কাজে যেখানে একসাথে প্রচুর সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় এবং প্রচুর তাপ উৎপন্ন হবার সম্ভাবনা থাকে এমন স্থাপনাতে এ সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়।
ব্লাস্ট ফার্মেস স্লাগ সিমেন্ট
বর্তমান সময়ে বাড়ি নির্মাণে সিমেন্ট এর ক্লিংকারের অনুপাত কমিয়ে তার বদলে বিভিন্ন ধরনের সমধর্মী উপাদান মেশানো হয়। এমন একটি সমধর্মী উপাদন হলো ইস্পাত কারখানা থেকে উৎপাদিত বাই প্রোডাক্ট স্লাগ। এটি কম তাপ উৎপন্ন করে এবং লবণাক্ত আবহাওয়াতে সাধারণ পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট থেকে বেশী কার্যকরী হয়। ভারী কন্সট্রাকশন কাজে, লোনা পানির আবহাওয়াতে, মাটির নিচের কাজে, পানির নিচে বা পানির সংস্পর্শে থাকে এমন স্থাপনাতে এ সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়।
হোয়াইট সিমেন্ট
এ ধরনের সিমেন্ট সৌন্দর্য বর্ধনের কাজে ব্যবহৃত হয়। ফ্লোরের মোজাইক বা টাইলস কিংবা স্থাপনার বাইরের দিকের ফেয়ার ফেস ফিনিশিং এর জন্য এই সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়। এর মূল উপাদান ক্লিংকার, কিন্তু এ ক্লিংকার সাধারন ক্লিংকার থেকে অনেক গুণ বেশি পরিশোধিত। ফলে এর দামও সাধারণ সিমেন্টের চেয়ে থেকে ৪ গুণ বেশি। ভেজা এবং পানির নিচে নির্মাণ কাজে, স্থায়ীত্ব এবং অধিক শক্তির প্রয়োজন এমন নির্মাণকাজে, এবং পানিরোধক নির্মাণ কাজে হোয়াইট সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়।
সিমেন্ট মজুদ রাখার নিয়মাবলী
নির্মাণকাজের যে কোনো কাঁচামাল সংরক্ষণেই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। তবে সিমেন্ট এর ক্ষেত্রে এ সতর্কতা প্রয়োজন আরও বেশি। শুল্ক ও বায়ু চলাচল করে এমন জায়গায় সিমেন্ট এর ব্যাগগুলো ধাপে ধাপে রাখতে হবে। একটি ব্যাগের উপর আরেকটি এভাবে সর্বোচ্চ দশটি ব্যাগ রাখা যাবে এবং দুই লাইনের মাঝে ফাঁকা জায়গা থাকতে হবে। স্টোর করার জায়গার ফ্লোরে কাঠের গুড়া বা ভুসি ছিটিয়ে দিয়ে তার উপর কাঠের বাটাম রেখে সিমেন্ট রাখতে হবে। দেয়ালের ঠেস দিয়ে এবং পানি সংস্পর্শে আসতে পারে , ভুলেও এমন জায়গায় সিমেন্টের ব্যাগগুলো রাখা যাবে না। মনে রাখতে হবে পানি সিমেন্টের সবচেয়ে বড় শত্রু। অতএব, সাবধান থাকতে হবে যাতে ঘরের দেয়াল বা মেঝে কিংবা সানশেড দিয়ে পানির ঝাপটা আসতে না পারে। ভ্যানগাড়ি বা ট্রাকে সিমেন্ট সরবরাহের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে হঠাৎ বৃষ্টি এলেও সিমেন্ট ভিজে না যায়। এজন্য বর্ষাকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও ত্রিপল অথবা পলিথিন দিয়ে সিমেন্ট ঢেকে নিয়ে যেতে হবে।
মনে রাখা প্রয়োজন, আমরা বাড়ির রং, ফিটিংস পছন্দ না হলে, চাইলেই বদলে নিতে পারি। কিন্তু মূল স্থাপনায় সিমেন্ট একবার ব্যবহার করলে আর কখনও বদলানো যায় না। সুতরাং, একজন সচেতন ভবন নির্মাতা হিসেবে মানসম্মত সঠিক সিমেন্টই আপনার বেছে নিতে হবে। আজকের ব্লগটি আপনার নির্মাণ ভাবনাতে কতটা প্রভাব ফেললো, জানিয়ে দিন কমেন্টে।