Reading Time: 4 minutes

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। এই জাতীয় পরিচয়পত্রটিই প্রমাণ করে আমাদের পরিচয় এবং নাগরিকত্ব। নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ আমাদের যেমন পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি জমি বা প্রপার্টির ক্ষেত্রেও রয়েছে  আলাদা পরিচয়পত্র যা প্রমাণ করে জমিটির মালিকানা আসলে কোন ব্যক্তির কিংবা জমিটির অবস্থান আসলে কোথায়। তবে জমির এই পরিচয়পত্রের একটি আলাদা নাম রয়েছে, সেটি হল দলিল। মানুষ তার বহু কষ্টে অর্জিত অর্থ দিয়ে একটি জমি ক্রয় করেন কিংবা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তির মালিক হয়ে থাকেন। কিন্তু তিনিই যে আসলে প্রপার্টির মালিক,তা তিনি কীভাবে প্রমাণ করবেন? ঠিক এই জায়গাটিতেই প্রয়োজন হয় দলিল নামের আইনী ডকুমেন্ট এর। কেননা কেবলমাত্র জমিজমা বা স্থাবর সম্পত্তির দখলই মালিকানা নয়। আর এই দলিল বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। আজকের লেখায় আলোকপাত করব বিভিন্ন রকম দলিল সম্পর্কে। সহজভাবে জানাতে চেষ্টা করব দলিল কী এবং বিভিন্ন রকম দলিল এর কোনটি কখন প্রয়োজন হয় ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে।  

দলিল কী? 

বাংলাদেশের ভূমি আইন অনুযায়ী জমির দলিল মোট ৯ প্রকার

ডিকশনারির ভাষায় যদি বলি তাহলে দলিল হচ্ছে যে কোনো চুক্তির লিখিত ও আইনগ্রাহ্য রূপ।  তবে প্রচলিত অর্থে এই দলিলের সংজ্ঞাটা একটু বিশেষ। কারণ এখানে দলিল শব্দটি এখানে  প্রপার্টি ক্রয় বিক্রয়, বণ্টন বা হস্তান্তরের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়। দলিলের ৫ টি মৌলিক অংশ রয়েছে যেমন- 

১। জমির বিস্তারিত বিবরণ

২। জমি দাতার /বিক্রেতার পরিচয়

৩। জমি গ্রহীতা /ক্রেতার পরিচয়

৪। সাক্ষীদের পরিচয়

৫। দলিল সম্পাদনের তারিখ

এই তথ্যগুলো সব ধরনের দলিলেই থাকতে হবে। দলিল করা হয়ে গেলে সেটি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে নিবন্ধন করিয়ে নিতে হবে। এতে দলিলের আইনি বৈধতা দৃঢ় হয়। বাংলাদেশের ভূমি আইন অনুযায়ী জমির দলিল মোট ৯ প্রকার। তবে এই বিভিন্ন রকম দলিলের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল ব্যবহৃত দলিলগুলো নিয়ে আলোচনা করব আজকে। 

সাফকবলা

বিভিন্ন রকম দলিল এর মধ্যে এই দলিলটি অন্যতম। এখানে নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে সম্পত্তি বিক্রি হয় অর্থাৎ মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। এক্ষেত্রে নির্ধারিত দলিল স্ট্যাম্পে লেখার পর বিক্রেতা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে এসে দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং প্রপার্টি ক্রেতাকে রেজিস্ট্রি করে দেন। আর এই রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে বিক্রেতা এবং তার ওয়ারিশদের ঐ প্রপার্টির উপর থেকে মালিকানা স্বত্ব বিলুপ্ত হয় এবং প্রপার্টির মালিকানা ক্রেতা এবং তার ওয়ারিশদের কাছে হস্তান্তরিত হয়।

দানপত্র দলিল

যেকোনো সম্প্রদায়ের যে কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তি দান করতে পারেন। দানপত্রে কোনো শর্ত না রেখে দলিলে দানকারীর স্বাক্ষর করতে হয় এবং যাকে দান করা হল ঐ ব্যক্তি অথবা তার পক্ষ হয়ে অন্য কাউকে দান গ্রহণ করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে যাকে দান করা হল তাকে অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্ক এবং সুস্থ মস্তষ্কের হতে হবে।  কিন্তু কোনো ব্যক্তিই চাইলেই তার সমস্ত প্রপার্টি দান করতে পারবেন না। কেবলমাত্র সম্পত্তির ৩ ভাগের সর্বোচ্চ ১ ভাগই  তিনি দান করতে পারবেন। 

হেবা দলিল

মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য, হেবা হচ্ছে দানপত্র দলিল। সাধারণত রক্তের সম্পর্কের ব্যক্তিকে এই দলিল করে দেওয়া হয়। এই দলিল কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়, কেবল সন্তুষ্ট হয়ে এ দান করা হয়। এবং হেবা সম্পূর্ণ শর্তবিহীনভাবে দাতাকে দান করতে হয় এবং প্রপার্টির হস্তান্তর, রূপান্তরসহ সব রকমের ক্ষমতা গ্রহীতাকে দেয়া হয়। অর্থাৎ এই দানপত্রে দাতার কোন স্বার্থ আলাদাভাবে সংরক্ষিত থাকে না। ইসলামিক আইন অনুযায়ী মানসিকভাবে সুস্থ এবং নাবালক নন এমন যে কোনো মুসলিমই হেবা করে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন।  

হেবা বিল এওয়াজ

মুসলিম আইনে, কোন কিছুর বিনিময় নিয়ে দান করাকে হেবা বিল এওয়াজ বলে। এক্ষেত্রে গ্রহীতাকে হেবা গ্রহণের বিনিময়ে দাতাকে অবশ্যই কিছু দিতে হবে। যেমন- পবিত্র কোরআন, জায়নামাজ, তসবিহ, স্বর্ণালংকার, মোহরানার টাকা ইত্যাদি যেকোন জিনিসের বিনিময়ে হেবা  হতে পারে। এই দলিলের গ্রহীতা সম্পূর্ণ শর্তবিহীন অবস্থায় জমি হস্তান্তর ও রূপান্তর করতে পারবেন এবং দাতার যাবতীয় স্বত্ব গ্রহীতার কাছে চলে যাবে। এই দলিল অবশ্যই রেজিস্ট্রি হতে হবে। ইসলামিক আইন অনুযায়ী মানসিকভাবে সুস্থ এবং নাবালক নন এমন যে কোনো মুসলিমই হেবা করে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন।  

এওয়াজ দলিল

এওয়াজ দলিলের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির সাথে পরষ্পরের প্রপার্টি সুবিধা মত এওয়াজ বিনিময় করতে পারেন। আরেকটু সহজ করে বলা যাক। ধরুন, “ক” এর জমি “খ” এর বাড়ির কাছে এবং “খ” এর জমি “ক” এর বাড়ীর কাছে। দুজনের জমিই সমপরিমাণ মূল্যের। এক্ষেত্রে সম্মতির ভিত্তিতে, “ক” তার জমি “খ” কে এবং “খ” তার জমি “ক” কে দিয়ে দুজনই একটি দলিল সম্পাদন করে রেজিস্ট্রি করে নিতে পারেন। এভাবে দুইপক্ষের মধ্যে প্রপার্টি বিনিময়ের যে রেজিস্ট্রি হয় সেটাই এওয়াজনামা বা এওয়াজ পরিবর্তন দলিল।  

বণ্টননামা 

সকল শরিকদের উপস্থিতি ও স্বাক্ষরের মাধ্যমে বন্টননামা দলিল করতে হয়

ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির সীমানা চিহ্নিত করে যার যার প্রাপ্ত স্বত্ব বুঝে নেয়ার জন্য যে দলিল করা হয় সেটি হচ্ছে বণ্টননামা দলিল।  এক্ষেত্রে প্রপার্টির শরিক ২ ভাবেই হতে পারে। 

১। উত্তরাধিকার সূত্রে শরিক বা কো-শেয়ারার বাই ইনহেরিটেন্স  এবং

২।  ক্রয় সূত্রে শরিক বা কো-শেয়ারার বাই পারচেজ 

সকল শরিকদের উপস্থিতি ও স্বাক্ষরের মাধ্যমে বন্টননামা দলিল করতে হয়। যদি শরিকরা আপোষে সম্পত্তি বণ্টনে রাজী না হন, সেক্ষেত্রে আদালতে মামলার মাধ্যমে সমাধান করা হয়ে থাকে। ওয়ারিশি জমি বিক্রি করতে এবং ওয়ারিশি সম্পত্তির নামজারি করতেও এই বন্টন দলিল অত্যন্ত জরুরি। 

অছিয়তনামা দলিল

কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সকলকে না দিয়ে একজনকে বা কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে দিতে চাইলে সেটি ওছিয়তনামা দলিলের মাধ্যমে করতে হয়। তবে, অনেক সময় অছিয়তকারীর মৃত্যুর পর যদি তার উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তির দাবী করে থাকেন তাহলে যাকে সম্পত্তি অছিয়ত করা হলো সে সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ পাবে বাকি দুই তৃতীয়াংশের মালিক সকল উত্তরাধিকারীরা হবেন। 

উইল দলিল

কোনো ব্যক্রির মৃত্যুর পর, তার রেখে যাওয়া প্রপার্টি কিভাবে বন্টন করা হবে, তা  পূর্বেই লিখিত বা মৌখিকভাবে নির্ধারণ করে দেয়ার আইনসম্মত ঘোষণাই হল উইল। যে কোনো সম্প্রদায়ের লোক উইল করতে পারেন, তবে যার নামে উইলটি করা হবে তাকে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক এবং মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। যিনি উইল করলেন তিনি জীবিত অবস্থায় একটির বেশিও উইল করতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সর্বশেষ যে উইল করলেন কেবল ঐটাই তার মৃত্যুর পর কার্যকর হবে।    

বিভিন্ন রকম দলিল এর মধ্যে আমাদের দেশে এই দলিলগুলোই জমি কেনা বেচা, হস্তান্তর বা দান করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়ে। প্রপার্টির মালিকানা যাচাই এর জন্যও এই দলিলগুলো খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি। তাই জমি কেনার আগে জরুরি বিষয়গুলোর সাথে সাথে দলিল সম্পর্কে নূন্যতম এই ধারণাটুকু থাকা মানে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। যা প্রপার্টি ক্রয়-বিক্রয়- হস্তান্তর বা দানের সিদ্ধান্ত নিতে অনেকখানি সাহায্য করবে আপনাকে। বিভিন্ন রকম দলিল সংক্রান্ত আজকের ব্লগটি আপনার কাছে কেমন লাগলো? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না!

Write A Comment

Author