Reading Time: 5 minutes

কৃষি বিপ্লবের পর থেকেই মানুষ স্থাপত্য এবং পুরাকৌশলকে কত দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব সে সংজ্ঞাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। মিশরের পিরামিড হোক কিংবা চীনের মহাপ্রাচীর, একটি অকল্পনীয় আকারের স্থাপত্য বা মেগাস্ট্রাকচার আসলে কত বিশাল হতে পারে, সে সীমা মানুষ প্রতিনিয়ত অতিক্রম করে চলেছে। আর গত দুই শতাব্দীতে নির্মাণ প্রযুক্তির অবিস্মরণীয় উন্নতি সাধিত হওয়ায় আমরা চোয়াল ঝোলানো বেশ কিছু স্থাপত্যকীর্তির চাক্ষুষ করেছি। তাই আমাদের আজকের লেখা সাজানো এমনই কয়েকটি মেগাস্ট্রাকচার নিয়ে যেগুলো নির্মাণ শিল্পে মানুষের অগ্রযাত্রার নিদর্শন হিসেবে মাইলফলক হয়ে আছে।

থ্রি জর্জেস ড্যাম (হুবেই প্রদেশ, চীন)

Three Gorges Dam
চীনের হুবেই প্রদেশের থ্রি জর্জেস ড্যাম

ইয়াংসি নদী, চায়নার হুবেই প্রদেশের এক বিশাল নদী। প্রায় এক শতাব্দী ধরেই চীনের বিভিন্ন শাসকেরা স্বপ্ন দেখেছেন এই নদীতে একটি ড্যাম বা বাধ নির্মাণের। কিন্তু প্রকৃতির এক অকল্পনীয় সৃষ্টি এই ইয়াংসি নদ। এবং বিশ শতকের চীন অর্থনৈতিকভাবে ততটা শক্তিশালী ছিল না যতটা থাকলে এই বিশাল নদীর বুকে বাঁধ নির্মাণ করা যায়! তবে গত কয়েক দশকের অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি চায়নাকে করে তুলেছে শিল্প এবং প্রযুক্তির দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম পাওয়ারহাউজ। সেজন্যই শেষ পর্যন্ত চায়না ২০০৬ সালে শেষ করেছে এই নির্মাণ মহাজজ্ঞের।

এই ড্যাম নির্মাণের পেছনে কারণ ছিল জীবাশ্ম জ্বালানী বা ফসিল ফুয়েলের উপর চায়নার নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। আর যেহেতু এটি সমগ্র বিশ্বের মধ্য সর্ববৃহৎ জল-বিদ্যুত উৎপন্নকারী বাঁধ বা ড্যাম, বলাই যায় যে সে উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল। এতে আছে ৩২টি টারবাইন এবং বিশাল দুটি ইঞ্জিন যা সর্বমোট ২২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম। এই সংখ্যাটি আসলে কত বড়? বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্যমতে ২০২১ সালে দেশের সর্বমোট বিদ্যুৎ চাহিদা হবে ২১০০০ মেগাওয়াট!

এই মহাজজ্ঞ সম্পন্ন করতে চাইনিজ সরকারের খরচ হয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এই ড্যামের যেখানে পানি জমা হয় সেই রিসার্ভারের ক্ষেত্রফল (surface area) ১০৮৪ বর্গ কিলোমিটার, যা আকৃতিতে প্রায় নিউ ইউর্ক বা লস অ্যাঞ্জেলস শহরের সমান। এই স্থাপনা যে কতটা বড় তা বুঝাতে একটি বিশেষ তথ্য উল্লেখ করাযেতে পারে। আমরা জানি পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর প্রতি মুহুর্তে ঘুরছে, এজন্যই পৃথিবীতে হচ্ছে দিন এবং রাত। জাগতিক কোন শক্তির কি এই ক্ষমতা আছে যে পৃথিবীর আহ্নিক গতিতে কোন রকম হের ফের করতে পারে? উত্তর হ্যা, আছে, এই থ্রি জর্জেস ড্যাম! এই ড্যামের সাহায্যে যখন নদীতে পানি প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করা হয় এবং আবার সেই পানি ছেড়ে দেয়া হয়, তখন পৃথিবীর গতি ০.০৬ মিলি সেকেন্ড কমে যায়!  

টাঁশিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (বেইজিং, চীন)

Beijing Daxing International Airport
টাঁশিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর – বেইজিং, চীন

হুবেই প্রদেশের ড্যাম থেকে চলুন এবার চীনের রাজধানী বেইজিং এর দিকে নজর ফেরানো যাক। চীন এমন একটি দেশ যেখানে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫৫ কোটি যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করে। আকাশ পথে ভ্রমণে চীন বিশ্বে দ্বিতীয়। শহরের ব্যস্ততম বিমানবন্দরটির নাম এখনো বেইজিং ক্যাপিটাল এয়ারপোর্ট, যা পৃথিবীর দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। তবে তা হয়ত খুব বেশিদিনের জন্য নয়। কেননা সেই ধারণাকে বদলে দেবার উদ্দেশ্য নিয়েই নির্মিত হয়েছে বেইজিং এবং ল্যাংফ্যান এর সীমান্তবর্তী স্থানে, টাঁশিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

বিশ্বের কয়েকটি মেগাস্ট্রাকচার নিয়ে কথা বললে কেন সেখানে টাঁশিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কথা আসবে? প্রথমেই বলা যায় যে, এতে আছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ টার্মিনালটি। এর সর্বমোট এরিয়া সাড়ে ৭ মিলিয়ন বর্গফুট! এই টার্মিনালটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যেন এর একমাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে সর্বোচ্চ ৮  মিনিট সময় লাগে। এতে আছে ৪টি রানওয়ে এবং একইসাথে এখানে ১৫০টি প্রমাণ সাইজের বিমান পার্কিং করে রাখা যায়। বর্তমানে এই বিমানবন্দর বছরে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ব্যবহার করতে পারলেও পরিকল্পনামাফিক ১২ কোটি মানুষ  বছরে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারবেন। বিশ্বের কয়েকটি মেগাস্ট্রাকচার নিয়ে কথা বললে তাই টাঁশিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কথা আসেই।

বোয়িং করপোরেশনের ফ্যাক্টরি (এভ্রেট, ওয়াশিংটন)

Inside the Boeing Everett Factory
বোয়িং করপোরেশনের ফ্যাক্টরি – এভ্রেট, ওয়াশিংটন

কয়েকটি মেগাস্ট্রাকচার বিমানবন্দর নিয়ে তো কথা হল, কিন্তু যদি কথা উঠে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানি কোনটি? সামান্য খোঁজ খবর রাখা যে কেউ বলে দিতে পারবেন, সেটি বোয়িং। বোয়িং করপোরেশন মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সফল হয়ে উঠতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে ৫০ ও ৬০ এর দশকে যাত্রীবাহী বিমানের বিপুল চাহিদা বৃদ্ধির সময়ে তারা পৃথিবীর শেরা হয়ে উঠতে শুরু করে। বোয়িং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় বিমানের মডেল হল  বোয়িং ৭৪৭, এবং এটি একটি দৈত্যাকৃতির বিমান। আর এই দৈত্যাকৃতির বিমান যে কারখানার বানানো হয়, সেটি পৃথিবীর কয়েকটি মেগাস্ট্রাকচার এর একটি।

বলছি বোয়িং করপোরেশনের ফ্যাক্টরির কথা যেটি অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের  ওয়াশিংটনের এভ্রেটে। সমগ্র ফ্যাক্টরির আয়তন চোখ কপালে তোলা, প্রায় ১ কোটি ৩ লক্ষ ঘনমিটার! তাই শুধু বিমান নয়, বরং যে কোন কিছুর মাপকাঠিতে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারখানা! এই কারখানা নির্মিত হয় ১৯৬৭ সালে। এর মাঝে সমস্ত ডিজনিল্যান্ড এটে যাবে। এর আয়তন এতই বড় যে, কোন স্থাপনা নির্মাণে কল্পনা করা যায় না, এমন সমস্যাতেও এর নির্মাণের সময় নির্মাতাদের পড়তে হয়েছে। এমন কল্পনাতীত বড় একটি কারখানার অভ্যন্তরে যে গরম বাতাস এবং জলীয় বাষ্পের জমা হত তাতে কারখানার ভেতরেই, সিলিং এর নিচে এক ধরণের মেঘের সৃষ্টি হত! পরবর্তীতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে তা নির্মূল করা হয়। বোয়িং এর ফ্যাক্টরিতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার কর্মী কাজ করতে আসেন। এখানেই তৈরি হয় বোয়িং এর বিভিন্ন বিখ্যার মডেলের বিমান যার মধ্যে আছে বোয়িং ৭৪৭, ৭৬৭, ৭৭৭ এবং ৭৮৭ ডিমলাইনার।

পার্লামেন্ট প্যালেস (বুখারেস্ট, রোমানিয়া)

Palace Of The Parliament
পার্লামেন্ট প্যালেস, রোমানিয়া

কিছুদিন আগেই আমাদের ব্লগে আমরা পৃথিবীর চোখধাঁধানো কিছু রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্টের বাসভবন নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করেছি। সেখানে কয়েকটি মেগাস্ট্রাকচার নিয়ে আলাপ থাকলেও রোমানিয়ার এই বিশাল প্যালেস নিয়ে আলাপ নেই। অথচ এই আকার, আকৃতি এবং অন্যান্য বিষয়ে এটি খুব সহজেই সেই তালিকায় জায়গা করে নিতে পারতো। তা হয়নি কেননা এটি কোন রাষ্ট্রপতির বাসভবন নয়। যদিও সমাজতান্ত্রিক রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চৌসেশের নির্দেশেই এই নির্মাণ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে, কিন্তু এর নির্মাণ শেষের আগেই বিপ্লবের ফলে রাষ্ট্রপতির পতন হয় এবং এটি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। 

বুখারেস্টে, রোমানিয়ার এই পার্লামেন্ট প্যালেস নির্মাণে কাজ করেছেন ৭০০ স্থপতি এবং ১লক্ষেরও বেশি নির্মাণ শ্রমিক। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী ভবন,এর ভর ৪০৯ কোটি ৮৫ লক্ষ কিলোগ্রাম! এর নির্মাণে প্রয়োজন হয়েছে ৭লক্ষ মেট্রিকটন স্টিল এবং ৩৫লক্ষ ঘনফিট মার্বেল পাথর। এবং যত যা কিছু নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে, তার সবকিছুর উৎসই ছিল রোমানিয়ার নিজস্ব।

এই মহাস্থাপনায় আছে ১১০০টি কক্ষ, এবং এতে আছে ২০ হাজার গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা! এটি যে শুধু রোমানিয়ার পার্লামেন্ট হাউজ তাই নয়, বরং এতে ৩টি জাদুঘর এবং একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রেরও উপস্থিতি রয়েছে। শুধু তাই না, ভবনের তলদেশে আছে একটি নিউক্লিয়ার বাংকার! এ যে কত বিশাল কর্মজজ্ঞ তা আসলে কল্পনা করা কঠিন। একটি হিসেব দিয়ে শেষ করা যায়, প্রতি বছর এই স্থাপনার জন্য বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচ হয় ৬০ লক্ষ আমেরিকান ডলার, যা প্রায় ৫১ কোটি টাকার সমান!! 

আবরাজ আল-বাইত (মক্কা, সৌদি আরব)

Abraj Al-Bait from the top of a hill
আবরাজ আল-বাইত

আমাদের তালিকার শেষ মেগাস্ট্রাকচারটি বর্তমানে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম স্থাপনা। এর অবস্থান মুসলানদের প্রাণের নগরী মক্কায় এবং এটি পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা উচ্চতম একটি ভবন। আবরাজ আর-বাইত যেন মক্কা নগরীর অন্যতম নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিশাল স্থাপনা নির্মাণের জন্য অটোমান সম্রাজের নিদর্শন আয়জাদ দূর্গকে গুড়িয়ে ফেলতে হয়েছে। পৃথিবীর উচ্চতম আকাশছোঁয়া কয়েকটি ভবনের মধ্যে এটি একটি।

পৃথিবীর সব ধরণের বিলাসবহুল সুবিধার চূড়ান্ত আছে এই আবরাজ আল-বাইতে। এর মধ্যে আছে একটি ফাইভ স্টার হোটেল, ৫ তলা শপিং অল যেখানে ১০০০ এরও বেশি গাড়ি একসাথে থাকতে পারে। আছে সুবিশাল একটি মসজিদ যেখানে একসাথে ১০ হাজারেরও বেহসি মানুষ নামাজ আদ্যা করতে পারে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঘড়িটিরও দেখা পাবেন আপনি এখানে। এর নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ৯৮ মিলিয়ন গ্লাস-মোজাইক টাইলস যা ২৪ ক্যারেট সোনায় মুড়ানো।

এই ছিল কয়েকটি মেগস্ট্রাকচার নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। এগুলোর নির্মাণে যে শুধু অসংখ্য মানুষ এবং কাচামালের দরকার পড়েছে তাই না, বরং তার চেয়েও বেশি লেগেছে প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার। আমাদের এই লেখাটি আপনার কেমন লাগলো? জানিয়ে দিন মন্তব্যের ঘরে। আর এমন আরও লেখা পেতে ভিজিট করুন বিপ্রপার্টি বাংলা ব্লগ যেখানে আমরা লেখা পাবলিশ করি প্রতিদিন!

Write A Comment