Reading Time: 5 minutes

ঘুম ভাঙতেই ঘরের কোণে দোয়েলের ডাক।
সোনালু গাছ থেকে ঝুলে থাকা হলুদ হলুদ প্রেম।
আর ঘর পেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই দিগন্তবিস্তৃত তেপান্তরের মাঠ! 

আমরা যারা ঢাকায় বাস করি, এমন কল্পনা তাদের জন্য অলীকই বটে,  খানিকটা অতিরঞ্জিত অভিলাষও। এ শহরে দৃষ্টির সীমানা প্রসারিত করার আগেই তা সীমাবদ্ধ হয় উঁচু উঁচু দালানকোঠায়। দোয়েলের ডাক মিলিয়ে যায় যানবাহনের কোলাহলে। তবুও, এই শহুরে জীবনে বহুতল ভবনগুলোই আমাদের আশ্রয়। যেখানে প্রয়োজনীয় ঘরগুলো ছাড়াও, থাকে ব্যালকনি নামের মিষ্টি একটা জায়গা। যেখানে আমাদের সেই অতিরঞ্জিত অভিলাষগুলো খানিক মাথাচাড়া দেওয়ার আস্কারা পায়। শহুরে জীবনে চার দেয়ালের মাঝে ঘরের এই কোনটিতেই বোধ হয় আমাদের সুখ, স্বপ্ন আর সম্পর্কের গল্পগুলো সহজাতভাবে বেড়ে ওঠে। চলুন আপনার ও আমার অভিজ্ঞতায় মিলিয়ে নেয়া যাক সেইসব ব্যালকনি ও শহুরে জীবনের গল্পগুলো। 

শহুরে বাস্তবতায় ব্যালকনির গল্প

শহুরে ব্যালকনি
একা থাকার মূহুর্তটুকু খুঁজে পাওয়ার জন্যই ব্যালকনির প্রয়োজনটা শহুরে সময়ে এত বেশি

এমন কি কখনও হয়েছে? চেনা বাড়ি, চেনা ঘর, চেনা মানুষের সঙ্গে থেকেও মনে হয়েছে একটু একা থাকি৷ এই একা থাকার মূহুর্তটুকু খুঁজে পাওয়ার জন্যই ব্যালকনির প্রয়োজনটা শহুরে সময়ে এত বেশি। ঠিক যেন ঘরবন্দি থেকেও কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা! কিন্তু কেবল হারিয়ে গেলেও চলে না, এই শহরে বাঁচতে গেলে হতে হয় ভীষণ বাস্তববাদী। বহুতল ভবনে ছাদে যাবার অধিকার থাকে না সবার। থাকে না গ্রাম বাংলার চিরাচরিত উঠানও। উঠান আর ছাদ উভয়ের একমাত্র বিকল্প হিসেবে তাই শুরু হয় ব্যলকনি ও শহুরে জীবনের গল্প। সেই গল্পে থাকে ব্যালকনির রেলিং জুড়ে  মায়ের কাপড় শুকানো। থাকে ব্যালকনির কোন অংশে রোদটা বেশি পড়ছে তা খুঁজে নিয়ে দাদীর আঁচার শুকোতে দেয়া। থাকে সকালের মিষ্টি রোদে বাবার খবরের কাগজের প্রথম ভাঁজ খোলা। থাকে দুপুরবেলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রেমিকার ভেজা চুলের উত্তাপ অথবা ভাইয়ের লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার মত অসংখ্য প্রিয়-অপ্রিয় মূহুর্ত। ব্যস্ততম দিনটি কাটিয়ে, শহরের দীর্ঘ যানজট পাড়ি দিয়ে যিনি ঘরে ফেরেন তারও একান্ত সময় কাটানোর থাকে, খোলা বাতাসে শ্বাস নেবার থাকে। এই কর্মব্যস্ত, পরিশ্রমী মানুষটির জন্যও কিন্তু ব্যালকনি হয়ে ওঠে রিলাক্সিং কর্নার যেখানে আর কেউ বিরক্ত করবার নেই। যে বইপোকাদের ঘরে বই পড়ার জন্য আলাদা স্পেস নেই তাদের জন্যও এই ব্যালকনিটাই হয়ে ওঠে বই পড়ার প্রিয় জায়গা।  যেখানে কেবল নিজের সাথে নিজের কথোপকথনে আরেকটু সহজ হতে থাকে ব্যালকনি ও শহুরে জীবনের গল্প।   

ব্যালকনি ও শৈশব 

ব্যালকনিতে রোদ
যে শিশুটির জন্মই হয়েছে ঢাকা শহরে, তার সাথে ব্যালকনির পরিচয় কিন্তু একেবারে শুরু থেকে

যে শিশুটির জন্মই হয়েছে ঢাকা শহরে, তার সাথে ব্যালকনির পরিচয় কিন্তু একেবারে শুরু থেকে। সকালবেলায় রোদ পোহাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যালকনিতে। আরেকটু বড় হলে এই ব্যালকনিতেই তার জন্য বরাদ্দ হয় একখানা দোলনা। ঘরের এই ছোট্ট অংশে বসে দোল খেতে খেতেই সে পৃথিবী চিনতে শেখে।   যেহেতু এই শহরে ঘরের বাইরে গিয়ে আকাশ দেখার বিলাসিতা শিশুদের জন্যও প্রযোজ্য নয় তাই এই ছোট্ট শিশুদের শৈশবে আকাশের রং চেনার একমাত্র সহজ জায়গা ব্যালকনি। বইয়ের পাতায় “রংধনুর সাত রং” পড়তে পড়তে রংধনুর বেগুনী, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ আর কমলা রঙ-এর সাথে তার প্রথম পরিচয় হয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই। ঘরভর্তি খেলনা ছড়িয়েও যে শিশুর দুষ্টুমি থামে না, সেও মায়ের কোলে বারান্দায় বসে লক্ষী ছেলের দলে নাম লেখায়। আয় আয় চাঁদমামার আধো বোলে যে শিশু সদ্য কবিতা পড়তে শিখেছে, চাঁদমামার সাথে তার সখ্যতাও কিন্তু এই শহুরে জীবনে ব্যালকনির গল্পেরই ক্ষুদ্র অংশ। শৈশবে প্রথম বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখা, প্রথমবারের মত নিজ হাতে ব্যালকনির এককোণে ছোট্ট চারাগাছটি রোপণ, হঠাৎ একদিন বারান্দার গ্রিলে চড়ুই পাখি দেখে আনন্দে আটখানা হওয়া! শহুরে জীবনে শৈশবকে উদযাপনে ব্যালকনির এইসব মূহুর্ত কিন্তু বড়বেলায় পৌছেও অস্বীকার করার উপায় থাকে না!   

রাতের ব্যালকনি

রাতের ব্যালকনি
সদ্য বালিকাবেলা থেকে যৌবনে পা ফেলা মেয়েটা মুঠোফোনে চাপা হাসিতে মূর্ছা যায় রাতের ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে

সদ্য বালিকাবেলা থেকে যৌবনে পা ফেলা মেয়েটা মুঠোফোনে চাপা হাসিতে মূর্ছা যায় রাতের ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে। হয়তো ফোনের ওপাশে রাতের তারা গুণতে প্রেমিকের বৃথা চেষ্টাই তার এই হাসির রহস্য। কিংবা কে জানে! ভালবাসার প্রথম প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবে কি দেবে না, সেই হিসেবই কষছে সে মধ্যরাতের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। যে ছেলেটা প্রিয় মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে, সেও পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে মাঝরাতে মেসের ওই ঘুপচি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই মফস্বলের ঘ্রাণ পায়। পাশের ব্যালকনিতে হয়তো অন্য কোনো যুবক একলা বসে এফএমের ফ্রিকোয়েন্সি বদলায় প্রিয় কোনো গানের প্রতীক্ষায়। মাঝে মাঝে রাতের ব্যালকনিতে চেনা গল্পের বাইরেও অচেনা গল্পের ক্ষোভ জমে। দূরের কোনো বারান্দা থেকে দেখা যায় কোনো এক নারীর কম্পমান ছায়া, হয়ত তার অশ্রু ঝরে! হয়তো দীর্ঘদিনের পুষে রাখা দুঃখ, ক্ষোভ এই রাতের ব্যালকনিতেই মুক্তি খুঁজে নেয়।  হয়তো পুরোনো কাপড়টায়, বাতাস দোলা দিয়ে যায় অন্য কোনো বারান্দায়! সবচেয়ে লাজুক ছেলেটাও রাতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুণগুণিয়ে যায় মনের অজান্তেই। ভীষণ ব্যস্ত কর্পোরেট নারীও, ঘুমোতে যাবার আগে রাতের বারান্দায় গিয়ে একবার দেখে নেয় নতুন কতগুলো নয়নতারা ফুটেছে তার আজ!  এই শহরের প্রতিটি বারান্দাই রাতে যেন হয়ে ওঠে এক-একটি  খোলা মঞ্চ, যেখানে মঞ্চায়িত হয় অদেখা সব ব্যালকনি ও শহুরে জীবনের গল্প! 

ব্যালকনি ও পারিবারিক বৈচিত্র্য

ব্যালকনি ও পরিবার
গম্ভীর বাবাদের সাথে সন্তানের বন্ধুত্বের গল্পগুলো শুরু হয় ব্যালকনি থেকেই

পরিবার নামক এই ছোট্ট গণ্ডিটাই বোধ হয় আমাদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় উপলক্ষ্য। ঠিক এই কথাটাই আমরা আরও বেশি উপলব্ধি করেছি কিছুদিন আগের ঘরবন্দি সময়গুলোতে। যখন ঠিক কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করবার নেই, তখন পরিবারের মানুষগুলোকে ঘিরেই তৈরি হয় বেঁচে থাকার উৎসব। সে উৎসবে খানিকটা রং ছড়াতে এই শহুরে জীবনে ব্যালকনির জুড়ি নেই।  গম্ভীর বাবাদের সাথে সন্তানের বন্ধুত্বের গল্পগুলো শুরু হয় ব্যালকনি থেকেই। কর্মব্যস্ত দিন শেষে বাবা যখন ঘরে ফিরে ব্যালকনির রিলাক্সিং চেয়ারটাতে বসে একটু আরাম করে নিচ্ছেন, সেটাই যেন সন্তানের জন্য মূখ্য সময়, বাবার কাছে অদ্ভূত সব আবদারের। হয়তো মা তার ছোট্ট ব্যালকনিতেই গড়ে তুলেছেন এক টুকরো বাগান। সেই বাগানে মায়ের সাথে শখ করে গাছে পানি দেয় কলেজ পড়ুয়া কিশোর ছেলেটা। সপ্তাহান্তে পরিবারের সবাই মিলে লুডু খেলার আসর জমে ঠিক এই ব্যালকনিতে বসেই। এই ছোট্ট জায়গাটি পরিবারের সবাইকে যেন এক করে ফেলে বিকেলবেলার চা খাওয়ার অজুহাতে। কিংবা অসময়ে হঠাৎ বৃষ্টিপাত! খোলা বারান্দায় সব ঠিক-ভুলের হিসেব চুকিয়ে নিয়ে সদ্য সংসারে পা বাড়ানো দম্পতির বৃষ্টিতে ভিজে নেয়া! শহুরে জীবনও মাঝে মাঝে এমন কিছু মূহুর্ত উপহার দেয় ব্যালকনি বা বৃষ্টির অজুহাতে। তাই হয়তো সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা শহরে, আমাদের লাল-নীল সংসারগুলো খানিকটা সহজ আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সাহস পায়।   

ব্যালকনি বড়, মাঝারি বা ছোট যেমনই হোক না কেন, ক্ষুদ্র এ কোণটুকুই কিন্তু আমাদের অসংখ্য আনন্দের উপলক্ষ্য। ৯০ এর দশকের গল্প থেকে বর্তমানের গল্প, কোথাও কিন্তু ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনির প্রয়োজনে ছেদ পড়েনি এতটুকুও। একাল হোক বা সেকাল, মধ্যবিত্ত হোক বা উচ্চবিত্ত, সকল আঙ্গিকেই নাগরিক জীবন যাপিত হয় এখানে। পুরনো দিনের চেয়ে এখনকার সময়ে ব্যালকনির পরিসর বেশ ছোট হয়ে আসলেও, ব্যালকনি ও শহুরে জীবনের গল্পে এটাই কিন্তু উড়াল দেয়ার একমাত্র রানওয়ে।  উড়াল দেয়ার এই রানওয়েতে আপনার দখল কতটুকু, জানিয়ে দিন কমেন্টে।  

Write A Comment

Author