Reading Time: 5 minutes

আমার মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু এদেশে আরও কিছু মানুষ আছেন যাদের দেশের ভাষা বাংলা হলেও মায়ের ভাষা কিন্তু বাংলা নয়! ঘরের বাইরে আমরা যে যেভাবেই কথা বলি না কেন, ঘরে যে ভাষায় কথা বলি সেটাই তো মায়ের ভাষা! আপনার আমার মাতৃভাষা! আজকে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে চলুন তবে ঘরে ফিরে যাই।

মায়ের ভাষায়, মায়ের বাসায় ফিরি! 

বাংলাভাষা, যে ভাষাতে আমি খুঁজে পাই সোঁদামাটির গন্ধ। যে ভাষা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শিকড়ের কাছাকাছি। যে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার সম্মান এনে দিতে দুঃসাহসী তরুণ অরুণদের আত্মত্যাগ। ক্যালেন্ডারের পাতায় ৫২ তে ফিরে যাওয়া! তবে, মাতৃভাষার জন্য ত্যাগের গল্প ২০২০ এ এসেও জমাট বাঁধে। আজকে শোনাব সেইসব না জানা ত্যাগের গল্প, মায়ের ভাষায় বলতে না পারার গল্প! যে গল্পের চরিত্রদের ঘরের বাইরে মাতৃভাষা বলতে না পারার কষ্ট আছে, একই সাথে মায়ের ভাষাকে হৃদয়ে বয়ে বেড়ানোর সাহসও আছে। চলুন তবে, মুদ্রার এপিঠ থেকে ওপিঠে উঁকি দেই…।।

সাঁওতাল

অন্ধকারে মোমবাতি জলছে
ভাষার আলো পৌঁছে যাক ঘরে ঘরে

একটি পুরনো শ্রেণীকক্ষ! বেঞ্চ বা ব্ল্যাকবোর্ড এতটাই পুরোনো, সাদা চকের আঁচড়ও বসে না। সেখানে বসে ঘড়ি তাকছে, একজন বয়স্ক শিক্ষক। অপেক্ষা করছেন কখন তার শ্রেনীর ছেলেপেলেরা কক্ষে ঢুকবে, তবেই না তিনি ছড়ি উঁচিয়ে পড়া ধরবেন! যেই ভাবা, সেই কাজ। ঘণ্টা বাজার সাথে সাথেই কিচিরমিচির করতে করতে সব ছোট পাখিরা কক্ষে ঢোকে এবং যার যার জায়গায় বসে যায়! অমনি স্যার প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন, কিরে কিছু কি শিখেছিস তোরা? নাকি তাও না! নম্বর বেঞ্চ থেকে “বোংগা” বলে ওঠে, “জেরে ক ক তের তের…” ( পাখি সব করে রব)… স্যার, এই বাক্য শুনেই থামিয়ে দিয়ে বলেন, তুই কি বলিস বাপু কিচ্ছু বুঝি না! থাকগে, পরের জন বল দেখি!

উপরের গল্পটি নেহাতই একটি উদাহরণ। যেখানে ছোট শিশু বোংগা মায়ের ভাষায় একটি ছড়া শোনাতেই শিক্ষকের অনীহার উদ্রেক হয়!

ঠিক এ জায়গাতেই আমরা বলতে চাই, চলুন ফিরে যাই মায়ের ভাষায়, মায়ের বাসায়। যে সকল ভাষায় মানুষ ঘরে কথা বলে । শিশু তাঁর মাতৃভাষায় কথা বলুক ঘরে, বাইরে সকলখানে। মায়ের ভাষাটি রাষ্ট্রভাষা হোক আর না হোক! এবার তাহলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছি আপনার দিকে। বলুনতো, এদেশের কতজন মানুষের মাতৃভাষা সাঁওতাল ভাষা? নিশ্চয়ই ভাবছেন কতোইবা! ষাট হাজার কিংবা এক লক্ষ। আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। অথচ, আমার আপনার ভাবনার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে আসছে! নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ও পঞ্চগড় এই সমস্ত জেলায় সাঁওতাল ভাষায় কথা বলেন, ২,০২,৭৪৪ জন মানুষ। এত বড় সংখ্যার মানুষেরা এই ভাষায় কথা বলে ভাবতেই কিন্তু বেশ ভাল লাগে। 

আচিক

খোলা বই
ভাষা শুধু বইয়ে নয়, ভাষা রয়েছে বুকেও

এদেশের অন্যতম আদিবাসীগোষ্ঠীর নাম গারো। টিলা কিংবা পাহাড়ের গা জুড়ে থাকা তাদের মাচাং ঘরের মতোই বৈচিত্র্যময় তাদের ঘরের ভাষা। গারোদের প্রধান ভাষা মান্দি, যার উৎপত্তিটা চীনা তিব্বতীয় ভাষা থেকে। তবে, প্রধান ভাষা মান্দি হলেও তাদের ঘরের ভাষা কিন্তু আচিক। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও শেরপুরজুড়ে এদেশের প্রায়, ১,২৫,৯৯৫ জন লোক আচিক ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসেন। আচিক ভাষাটি এদের কাছে মায়ের ভাষা হিসেবেই ভীষণ আদরের। 

অফিস আদালতের প্রয়োজনে কিংবা জাতীয় ভাষা বাংলার জন্য সব গারোরাই বাংলা ভাষা বলতে পারেন কেউ কেউ আবার লিখতেও পারেন। একটি দেশে থাকতে গেলে সেদেশের রাষ্ট্রভাষা জানাটা জরুরী। আর সেই প্রয়োজনেই গারোরা ও শিখেছেন বাংলা।তবে, ভাষার আবেদন তাদের কাছে তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তারা আচিক ভাষায় কথা বলতে পারেন আপন স্বাধীনতায়। এখানেই তো মাতৃভাষার চরম স্বার্থকতা, হোক না তা আমার আপনার মাতৃভাষা বাংলা কিংবা কোনো গারো বালিকার মাতৃভাষা আচিক! যে সকল ভাষায় মানুষ ঘরে কথা বলে সেটাই তার মায়ের ভাষা। আচ্ছা, আচিক শব্দের অর্থ কি জানেন? পাহাড়! পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষের মন নাকি পাহাড়ের মতই বড়। এবং তারা সেটারই পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে রোজ, ভাষার মধ্য দিয়ে কিংবা পাহাড়ের গায়ে পরম যত্নে গড়া বাসার মধ্য দিয়ে। 

ককবরক বা ত্রিপুরা  

সাদাকালো ছবিতে এক তরুণ
স্বপ্নবাজ তরুণেরা তবুও থেমে নেই

একজন তরুণ নির্মাতা, যিনি কিনা স্বপ্ন দেখেন সিনেমা বানানোর! 

স্বপ্নবাজ সেই তরুণের নাম সান্তুয়া ত্রিপুরা। সন্তুয়ার সিনেমার গল্প তার নিজের সম্প্রদায়কে ঘিরে। সিনেমার ভাষাটিও ত্রিপুরা।  গল্প সে নেবে ত্রিপুরা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ “রাজমালা” থেকে। যে গ্রন্থের স্রষ্টা শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর শর্মা। সিনেমার মধ্য দিয়ে সান্তুয়া তার মাতৃভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা দুইটি ভাষার প্রতিই দেখাতে চেয়েছেন তাঁর অবাধ ভাষাপ্রেম। তিনি তার স্ক্রিপ্টের জন্য এমন একটি বিষয় বেছে নিয়েছেন যেখানে, ত্রিপুরা রাজ্য সম্বন্ধে কথা বলা হলেও সমান প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস। আমরা কয়জনই বা জানি ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ। এমন কি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও নাকি ত্রিপুরার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। এজন্যই হয়তো কবি গুরু ত্রিপুরার কাহিনী নিয়ে ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস ও ‘বিসর্জন’ নাটক রচনা করেছিলেন। কবি গুরুর মত অনেককেই পাবেন যারা কিনা ত্রিপুরা থেকে গল্প সংগ্রহ করেছেন। সান্তুয়ার সিনেমার চরিত্রগুলোও হতে পারে বাংলা ত্রিপুরা মিলিয়ে। সিনেমা বানাতে যতটুকু লেখাপড়া তার করার প্রয়োজন সবকিছুই করেছে সে, কিন্তু আটকে আছে সেই একই প্রশ্নে! সিনেমা বানালে লোকে দেখবে তো? ত্রিপুরা ভাষার সিনেমা যেখানে বাংলা থাকবে সাবটাইটেল হিসেবে। অথচ, বাংলার এই দেশে ১,৩০,৯৯৫ জন মানুষ এই ত্রিপুরা, যে সকল ভাষায় মানুষ ঘরে কথা বলে । অনেকের কাছে যা ককবরক ভাষা হিসেবে পরিচিত। ককবরক শব্দের অর্থ “ভাষা মানুষ”। এই ভাষাটি খাগড়াছড়ি, খাগড়াছড়ি সদরসহ, মাটিরাঙ্গা সমূহ এলাকায় আছে। 

চাকমা 

খোলা বই
ভাষার আলো ছড়িয়ে যাক সব প্রান্তে

এ দেশে চাকমা ভাষী আছেন ৫,১৭,৮৩২ জনের মত। কমবেশি হতে পারে। সমগ্র দেশে ছড়িয়ে আছে এই মানুষগুলো। দেশের এই কোণা থেকে সেই কোণা পর্যন্ত । রাঙামাটি, বাঘাইছড়ি, বারকল, নান্নেরচর ও দীঘিনালা ইত্যাদি জেলা ও উপজেলায় কম বেশি চাকমাদের খুঁজে পাবেন। আমাদের দেশের জাতীয় ও দাপ্তরিক ভাষা বাংলা হওয়াতে যেটা হয়েছে, আপনার মায়ের ভাষা যাই হোক না কেন জীবিকার জন্য আপনাকে বাংলা জানতেই হবে! এখানে যারা চাকমা আছেন এদের সবাই বাংলা বলতে ও লিখতে পারেন। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা কিনা নিজের মায়ের ভাষা চাকমা বলতে পারলেও লিখতে পারেন না! এমন কি তাদের নিজের প্রজন্মকেও তারা চাকমা লিখতে শেখাতে পারছেন না, কারণ তারা নিজেরাই ভুলতে বসেছেন তাদের মায়ের ভাষা। একটা জাতি হিসেবে আপনি যদি নিজের মায়ের ভাষাই ভুলতে বসেন, এর থেকে ভয়াবহতা আর কি হতে পারে? এমনই এক খবরের খোঁজ পেয়েছিলাম, দেশের বরেণ্য পত্রিকা প্রথম আলোর এক হেডলাইনে! যেখানে লেখা ছিল,  “চাকমা বর্ণমালা শেখান তারা”। কারা শেখান? চাকমা যুব সংঘ নামের একটি সংঘটন নিজ দায়িত্বে নিজেদের মানুষদের চাকমা বর্ণ মালা শিখিয়ে যাচ্ছেন। যাতে সংখ্যার দিক দিয়ে কম বিশ্বের এই জাতির বর্ণমালা যেন হারিয়ে না যায়। এমন আরও একটি সংগঠন এই একই কাজ করছে। এখানে আছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্ররা। যারা সময় করে নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি এই মহৎ কাজে সময় দিচ্ছেন। এই কাজটি তারা করে আসছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে!

এদেশের ১,৫৪,২১৬ জন মানুষের মায়ের ভাষা মারমা। রাঙামাটি, রাজশাহী এই অঞ্চলের দিকে এই ভাষায় কথা বলতে বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশ জুড়ে আরও আছে, মান্দারি ভাষায় কথা বলে ৫০,০০০ মানুষ। এমন আরও অনেক ভাষাই আছে এই বাংলার বুকে। ভাষার হাতেখড়িটা তো মায়ের ভাষাতেই। আপনি বাঙালি হোন, চাকমা হোন, মারমা হোন কিংবা অন্য কোনো গোষ্ঠী, হাটি হাটি পা পা করে যখন ঘরের মেঝেতে পা রেখেছেন, ঠিক তখনই আধো আধো বুলিতে মায়ের ভাষায় শিখেছেন কথা বলতে। মাতৃভাষার অধিকার তাই প্রতিটি দেশের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর।

ঘরে অথবা বাইরে, দেশে অথবা বিদেশে, মাতৃভাষার প্রকাশ হোক সবখানে।
ভাষার স্বাধীনতা উদযাপিত হোক এদেশের প্রতি ঘরে!

Write A Comment