Reading Time: 4 minutes

যেকোনো ধরণের মাইগ্রেশনই মেট্রোপলিটন শহরের নাগরিক জীবনে  গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। ঢাকা সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মাঝে একটি। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ শহরে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষের বসবাস। এছাড়া প্রায় ৩.৫৬% জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তো রয়েছেই। ঢাকা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং প্রসাশনিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল। এই কেন্দ্রীভূত অবকাঠামোর কারণে সারা দেশের মানুষই সবসমই ঢাকামুখী। হবেন বা না কেন; ভালো চাকরি, উন্নত চিকিৎসা সুবিধা, মান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা কিংবা সুন্দর বাসস্থানের জন্যে তো ঢাকার সাথে বাংলাদেশের অন্য কোনো শহরের তুলনা হয় না।

তবে ২০২০ সালের চিত্রটা বেশ ভিন্ন। লকডাউনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রচুর মানুষকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে দেখা গিয়েছে। মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানেই ঢাকার জনসংখ্যার একটা অংশ নিজ শহরে ফিরে গিয়েছে বা অন্য কোনো জেলায় ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। রিভার্স মাইগ্রেশনের এ জোয়ার রিয়েল এস্টেট সেক্টরেও বেশ উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে এবং ফেলছে। কেননা শহরের জনসংখ্যা, তাদের চাহিদা, রুচি এবং উপস্থিতির উপরে রিয়েল এস্টেটের অনেক ব্যপারই নির্ভর করে।

বর্তমান করোনা প্যানডেমিকের সমস্যা এবং সামাজিক অবকাঠামোতে তার প্রভাব

overcrowded dhaka road
ঢাকায় এমন দৃশ এখন অনেকটাই বিরল

কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের কারণে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ-ই আজ ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের শ্রমিকরা শহর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে তীব্র আর্থ সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে রাজধানী বা ঢাকা কেন্দ্রিকতা অনেক বেশি। তাই বহু বছর ধরেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অর্জনের তাড়নায় বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভুক্তভোগী হয়ে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ঢাকায় আসতে শুরু করেন। কিন্তু এই শ্রমিক শ্রেণীরই বড় এক অংশ বর্তমান প্যানডেমিকের শিকার হয়ে বাধ্য হচ্ছেন ঢাকা ছাড়তে। বিপুল সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে রিভার্স মাইগ্রেশন।

লকডাউন এবং করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধের কড়া নিয়মগুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে স্বল্প আয় ও দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল শ্রমিকদের উপরে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা এদিক থেকে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত। সরকার গার্মেন্টস মালিকদের শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত না করার নির্দেশ দিলেও তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। অনেক বিশ্লেষণ বলছে, গার্মেন্টস সেক্টর প্রচুর পরিমাণে বিদেশী ক্রেতাদের অর্ডার হারাচ্ছে। তাতে গার্মেন্টস মালিকরা বাধ্য হচ্ছেন শ্রমিকদের চাকরি থেকে ছাটাই করতে। বাস্তব সত্য হলো, এই চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের জন্য কোনো বিকল্প চাকরি বা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়নি। শুধু গার্মেন্টস সেক্টরই  নয়, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হলসহ বিনোদন সেক্টর এবং কমিউনিটি সেন্টার, ক্যাটারিং সার্ভিস সহ সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনকারী সেক্টরেও করোনার কারণে কোনো দর্শক কিংবা ক্রেতা নেই বললেই চলে। তাই সেখানেও চাকরি হারাচ্ছেন প্রচুর শ্রমিক।

লাখ লাখ মানুষ প্রতিবছর চাকরির খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে আসেন। তাই শহরে মাইগ্রেশন সবসময়ই জাতীয় নীতি নির্ধারকদের জন্য জরুরি বিষয় ছিলো, সেভাবেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন নীতিমালা। যেহেতু প্যানডেমিকের কারণে স্রোত এখন উল্টো দিকে বইছে, তাই তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ঘটনাও।

দেশের অর্থনীতির উপর রিভার্স মাইগ্রেশনের প্রভাব

aerial view of Dhaka city
অনেক ফ্ল্যাট ও বাসা বর্তমানে খালি পরে আছে

রিভার্স মাইগ্রেশনের ভালো দিকের চাইতে খারাপ দিক অনেক বেশি। এটি সত্যি যে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোর ঘনবসতি হয়তো এই কারণে কিছুটা কমছে, তবে মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আরো অনেক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।

যারা শহর ছেড়ে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের-ই একটি নির্দিষ্ট আয় ছিল। এছাড়াও, আয়কৃত অর্থের এক বিশাল অংশ এই মানুষগুলো খরচ করত স্থানীয় অর্থনীতিতে। এমন মাইক্রো ইনভেস্টমেন্টের কারণে অনেক চাহিদা তৈরি হতো, যেই চাহিদার গ্রাফ রিভার্স মাইগ্রেশনের কারণে প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাইক্রো ইনভেস্টমেন্ট বন্ধ হয়ে গেলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রিয়েল এস্টেট সেক্টরে অবশ্যই পড়বে।

ঢাকা এবং চট্টগ্রামের রিয়েল এস্টেটের উপর রিভার্স মাইগ্রেশনের সামগ্রিক প্রভাব

আগেই বলা হয়েছে, রিয়েল এস্টেট এবং রিভার্স মাইগ্রেশন দুটি আলাদা বিষয় হলেও একে অন্যের সাথে জড়িত। কারণ, মাইগ্রেশনের পরে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো থাকার জায়গা নির্ধারণ করা। যেহেতু প্রচুর সংখ্যক মানুষ ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলো ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাই এই মেট্রোপলিটনগুলোর রিয়েল এস্টেট সেক্টর কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক বাড়িওয়ালারা-ই সময়মতো ভাড়া পাচ্ছেন না দেখে বিপদে পড়ছেন। পাশাপাশি, অনেক ভাড়াটিয়া-ই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, এবং এই বিপদের সময়ে নতুন করে সেই খালি বাসাগুলোও ভাড়া হচ্ছে না।

তাই এখন বাসা ভাড়ার বাজার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বাসস্থান ভাড়া দেয়া হাউজিংগুলোর সবচেয়ে জনপ্রিয় পন্থা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়িওয়ালারা বাধ্য হচ্ছেন ভাড়া কমাতে। এমনকি কেউ কেউ অর্ধেক টাকায়ও বাসা ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

অনেক বাড়িওয়ালার জন্যেই বাসা ভাড়া একমাত্র আয়ের উৎস। ভাড়াটিয়ারা যাতে এই মুহুর্তে বাসা না ছাড়েন, তাই কেউ কেউ কয়েক মাসের ভাড়া পর্যন্ত নিচ্ছেন না। তাই সার্বিকভাবে তাদের আয় কমছে, অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়ছেন তারাও। অনেক মানুষ সাশ্রয়ী বিকল্প খুঁজছেন।তাই যেসব এলাকায় বাসা ভাড়া কম বা তুলনামূলকভাবে সস্তা, সেসব এলাকায় আগের তুলনায় বেশি মানুষ বাসা ভাড়া নিতে চাচ্ছে।

যারা করোনা পরিস্থিতির আগে নতুন বাসা কিংবা ফ্ল্যাট কিনতে চাচ্ছিলেন, এই দুর্বল অর্থনৈতিক সময়ে তারা অনেকেই সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন। একাধিক সুবিধাজনক হোম লোনের অফার পাওয়ার পরেও তারা ফ্ল্যাট কিনতে রাজি হচ্ছেন না। অনেকেই আবার ঢাকা ছেড়ে নতুন জায়গায় চলে যাওয়ার কথাও ভাবছেন। কেউ কেউ দেশ ছাড়ার কথাও ভাবছেন।

অনেকের মতে, জমি এবং অ্যাপার্টমেন্টের দাম আগের তুলনায় নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। এখন তা ঢাকা এবং চট্টগ্রাম নিবাসী বেশিরভাগ মানুষেরই সামর্থ্যের মাঝে চলে এসেছে। অনেক নির্মাণাধীন প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে শ্রমিকের অভাবে। এত সুবিধা থাকার পরেও মানুষের মাঝে প্রপার্টি কেনার আগ্রহ কিছুটা হলেও কম দেখা যাচ্ছে। অনেকেই বরং ভবিষ্যতের জন্যে টাকা জমাচ্ছেন, কিংবা মাইগ্রেশনের কথা ভাবছেন।

এই ক্রাইসিস দূর করতে সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে কিছু নতুন নীতিমালা প্রবর্তন করেছে। রিভার্স মাইগ্রেশনের প্রভাবে যেহেতু রিয়েল এস্টেট সেক্টরে কিছু সামগ্রিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তাই অনেক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি-ই তাদের সেলস প্যাকেজে নানা ধরনের বাড়তি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। তাতে মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলেও মহামারীর এ সময়ে রিয়েল এস্টেটের চাহিদা বাড়তে হয়তবা সময় লাগবে।

রিভার্স মাইগ্রেশন এবং প্যানডেমিকের প্রভাবের সাথে লড়াই করতে ব্যবসার স্ট্র্যাটেজি পাল্টানোর বিষয়টি রিয়েল এস্টেট সেক্টরকে আশা দেখাচ্ছে। এই সেক্টরের ক্রমাগত উন্নয়ন মানুষের ভবিষ্যতের বাসস্থানের সমস্যার সমাধান করবে।

Write A Comment