Reading Time: 5 minutes

যে কোনো জাতি ও সভ্যতার অনন্য এক অংশ হল সংস্কৃতি। যা ক্রমাগত নদীর মতো প্রবাহমান। নদীর মত বলেই সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে, ভাঙ্গন হয়। থাকে দিক বদলে পুনরায় নতুন রূপে বয়ে বেড়াবার প্রচেষ্টা। তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে ফেলা যায় না সংস্কৃতির সংজ্ঞা বা এর সীমা- পরিসীমা। কেবল দেশ-কাল-ভাষা কিংবা ধর্মভেদে সংস্কৃতির এ রূপান্তরের যাত্রা অনুসরণ করা যায়। বাঙালির সংস্কৃতিও এড়াতে পারেনি এ অবধারিত পরিবর্তনকে। লোকসংস্কৃতির স্থান এখন দখল করে নিয়েছে নগর সংস্কৃতি। তাই বলে লোকসংস্কৃতিও বিলীন হয়ে যায় নি। নতুন রূপে ফিরে এসেছে নাগরিক জীবনে।  সংস্কৃতির এ রূপান্তর প্রভাব ফেলেছে বাঙালির আবাসন, শিল্পচর্চা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে। কালের আবর্তে বাঙালির জীবনে লোকসংস্কৃতি ও নগর সংস্কৃতি এর যে দীর্ঘ যাত্রা সেসব নিয়েই আজকের আলাপচারিতা।  

লোকসংস্কৃতি ও নগর সংস্কৃতি  

লোকসংস্কৃতিকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে মূলত এদেশের নদ-নদী, প্রকৃতি ও কৃষি-জীবন

প্রযুক্তিনির্ভর ও আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত শিক্ষিত নগরবাসীর সংস্কৃতিই নগর সংস্কৃতি। নব্বই দশক কিংবা তারও আগে থেকে ধীরে ধীরে এ সংস্কৃতির প্রভাবেই বদলে গেছে আমাদের লোকজ জীবন। কিংবা কে জানে! লোকসংস্কৃতিকে নতুন মোড়কে আচ্ছাদিত করতেই নগর সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে আমাদের এই নাগরিক জীবনে। 

অন্যদিকে, বাংলার লোকসংস্কৃতিকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে মূলত এদেশের নদ-নদী, প্রকৃতি ও কৃষি-জীবন। যা প্রভাব ফেলেছে বাঙালির বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ-সজ্জা-প্রসাধন, খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে প্রতিটি অনুষঙ্গে। মূলত, বঙ্গ জনপদের আদিম অধিবাসীদের বিশ্বাস-সংস্কার ও লোকাচারকে কেন্দ্র করেই এই লোকসংস্কৃতির জন্ম। যার উৎস, লালন ও বিকাশ ক্ষেত্র ছিল গ্রাম ও গ্রামীন জীবন। আমরা যেদিন থেকে গ্রামকেন্দ্রিক জীবন থেকে নগরকেন্দ্রিক জীবনে পা বাড়িয়েছি, বহুতল ভবনের সুরম্য ফ্ল্যাটকে আবাসস্থল ভাবতে শিখেছি, সম্ভবত সেদিন থেকেই ধীরে ধীরে সংস্কৃতির এ গতি তার মোড় পাল্টেছে। সৃষ্টি হয়েছে নগর সংস্কৃতি।    

সংস্কৃতির আবর্তে আবাসন

ঢাকার আকাশচুম্বী অট্টালিকা দেখলেই বুঝা যায় আমাদের জীবনযাপনে নগর সংস্কৃতির প্রভাব

বাংলার লোকজীবনে আবাসনের যে সংস্কৃতি তা মূলত গড়ে উঠেছিল বাংলার প্রকৃতি ও এর ভৌগলিক অবস্থান এর উপর ভিত্তি করে। সে কারণেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো দেখা মেলে নানারকম ঘর-বাড়ি। খড় বা শনের দোচালা ঘর, মাটির ঘর, গোলপাতার  পাটকাঠি বা কঞ্চির বেড়া, এক পাশে গোয়ালঘর, এক চিলতে উঠোন, চারপাশে সারি সারি গাছ, এ সমস্তই গ্রামীণ বাস্তুগৃহের সাধারণ সংস্কৃতি। কিন্তু মানুষ এখন নগর কেন্দ্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়েছে। যেখানে কেবলমাত্র বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্যই নয়, প্রয়োজনের তাগিদেই নির্মিত হয়েছে ইট কাঠ পাথরে নির্মিত বহুতল ভবন। একটি ভবনেই গড়ে উঠেছে অগণিত ফ্ল্যাট, একই ছাদের নিচে আলাদা আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করছে অনেকগুলো পরিবার। আলাদা আলাদা কাচারি ঘর, রান্নাঘর কিংবা শোবার ঘরের বদলে বেডরুম, লিভিং রুম, ডাইনিং, ব্যালকনি ও কিচেন সম্বলিত অ্যাপার্টমেন্ট এ থাকতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন নগরবাসী। লোকসংস্কৃতিতে ঘরের সাজ বলতে যা কেবল আল্পনা বা মাটির টেরাকোটাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নগর সংস্কৃতিতে বিস্তৃত হয়েছে ইন্টেরিয়র ডিজাইন নামে। কেবল ঢাকা শহরের  আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যায়, নগর সংস্কৃতি আমাদের জীবনযাপনে কি ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে! 

সংস্কৃতির আবর্তে আসবাব ও আনুষঙ্গিক

শুধু আবাসনেই নয়, এর প্রভাব পরিলক্ষিত আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ব্যবহার্য প্রতিটি উপাদানে।  এক সময়ের নিত্য ব্যবহার্য মাটির হাঁড়ি-পাতিল-সানকি কিংবা কাঁসার থালা-বাটি এখন নগর সংস্কৃতির শখের উপাদান। নগরবাসীর কেউ কেউ তা সংগ্রহে রাখেন ঘরের সাজে বাঙালিয়ানা ও নিজস্ব রুচির প্রকাশ ঘটাতে। কিন্তু নিত্য ব্যবহার্য তৈজসপত্র হিসেবে সিরামিক, স্টিল, অ্যালুমিনিয়ামের আধুনিক উপকরণগুলোই জায়গা করে নিয়েছে  বর্তমান নগর সংস্কৃতিতে। বাংলার লোকশিল্পে কাঠের গায়ে খোদাই করা নকশাকে বলা হত দারুশিল্প। খাট-পালঙ্ক থেকে শুরু করে সিন্দুক, ঘরের আসবাবপত্র এ সবই দারুশিল্পীরা নির্মাণ করতেন কাঠে খোদাই করে।  যেখানে লোকায়ত নকশার মধ্যে প্রাধান্য পেত পশুপাখি, দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য, বনফুল, কলমিলতা, লৌকিক দেবদেবী ইত্যাদি। নগর জীবনে এর চল এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। এখন সহজলভ্যতা আর স্বল্পমূল্যের কারনে সে স্থান দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক ও প্লাইউড এর রেডিমেড আসবাবপত্র। 

সংস্কৃতির আবর্তে খাদ্যাভ্যাস 

নানা রকম পিঠা-পায়েস ও মিষ্টান্ন ভোজনের যে রীতি, এসবই বাংলার লোকসংস্কৃতির অংশ

বাঙালির ঐতিহ্য ছিলো কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরাল মাছের ঝোল আর নলিতা (পাট) শাক। বৃষ্টিবাদলের দিনে নগরজীবনে যে খিচুড়ি খাওয়ার চল এখনো দেখা যায়, তাও কিন্তু প্রাচীন বাংলার এই লোকসংস্কৃতি থেকেই আসা। নানা উৎসবে মূল খাবারের সাথে নানা রকম পিঠা-পায়েস ও মিষ্টান্ন ভোজনের যে রীতি, এসবই বাংলার লোকসংস্কৃতির অংশ। কিন্তু নগরজীবনে বাকি সব কিছুর মত পরিবর্তন এসেছে খাদ্যাভ্যাসে। কন্টিনেন্টাল, থাই, ইতালিয়ান, চাইনিজ কিংবা ম্যাক্সিকান নানান দেশের রকমারি খাবার তো বটেই, দেশীয় খাবারেও যোগ হয়েছে নানারকম ফিউশান। আর এ কারণেই লোকসংস্কৃতি ও নগর সংস্কৃতি তে ভিন্নতা এত বেশি, হোক তা বাসস্থান, খাবার কিংবা পোশাক।

সংস্কৃতির আবর্তে পোশাক-পরিচ্ছদ

নকশীকাঁথা বর্তমান নগরসংস্কৃতিতেও নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রেখেছে

যে কোনো সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল পোশাক। সেই পোশাকে মোটা দাগে চোখে পড়ে বাঙালি নারীর শাড়ি। পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে মোটা তাঁতের শাড়ির প্রচলন ছিল। তবে নগর জীবনে শাড়ি এখন নারীদের উৎসবের পোশাক। লোকসংস্কৃতি ও নগর সংস্কৃতি এর দুই মেরুতে পুরুষদের পোশাকেও দেখা মেলে বিস্তর ভিন্নতা। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না। এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরিধানে থাকলে হতো ‘ধুতি’ আর মেয়েদের পরিধানে থাকলে ‘শাড়ি’।  সঙ্গে ছোট করে পুরুষদের পোশাকের অন্যতম সঙ্গী হয়ে উঠা গামছার কথা না বললেই নয়। ধুতির সঙ্গে গামছার একটা সহাবস্থান দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই তখন থেকেই। যদিও আধুনিক জীবন ধারায় গামছা বা ধুতি কোনোটাই পোশাক হিসেবে বহুল প্রচলিত নয়।  কিন্তু সংস্কৃতি মাত্রই যেহেতু রূপ বদলায়, তাই অতীতের সেই গামছা দিয়েই বর্তমান নগর সংস্কৃতিতে নতুন রূপে তৈরি হচ্ছে গামছা শাড়ি, গামছা ব্লাউজসহ বাঙালিয়ানা ধাঁচের নানা পোশাক। দারিদ্র্যের ভেতরে থাকা বাঙালি নারীদের শাড়ি তালি জোড়া দিতে গিয়েই জন্ম হয়েছিল লোকসংস্কৃতির আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নকশীকাঁথার। বাঙালি নারীদের শিল্পী মনের পরিচায়ক এ নকশীকাঁথা বর্তমান নগর সংস্কৃতিতেও নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কাঁথা তো বটেই, শাড়ি, পোশাক, কুশন, চাদর কিংবা রানার সহ অসংখ্য উপকরণে এ নকশার চল এসেছে নগর সংস্কৃতিতে। বাংলার লোকসংস্কৃতি মৌলিকত্ব ও নিজস্বতা ধারণ করে বলেই , আধুনিক নগর সংস্কৃতিতেও তার দেখা মেলে। ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে প্রবাহমান থাকে যুগের পর যুগ। 

সংস্কৃতির আবর্তে শিল্প-সাহিত্য ও বিনোদন 

হরেক রকম মেলা কিংবা নবান্নের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত

বাংলায় লোককথা, রূপকথা, ব্রতকথা, কিংবদন্তি, লোকনাট্য,  ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি মিলে লোকসাহিত্যের এক বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে।  জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তনসহ অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত প্রকার লোকসংগীতের প্রচলন আছে। বাংলা লোকজ খেলাধুলাও কম নয়। কড়ি খেলা, কানামাছি, লাঠি খেলা, কাবাডি, গোল্লাছুট, ষাঁড়ের লড়াই, বউচি, নৌকা বাইচ এর খেলাগুলোও বাঙালি জীবনযাত্রারই অংশ ছিল। সামাজিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে হরেক রকম মেলা কিংবা নবান্নের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। 

বর্তমান শিল্প-সাহিত্য ও বিনোদনে এসেছে বৈশ্বিক প্রভাব। ঠাকুমার ঝুঁলির জায়গা নিয়েছে ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান, ড্রাগন, ফেইরি টেল আর সায়েন্স ফিকশন। বিনোদনে নতুন মাত্রা এনেছে নেটফ্লিক্স কিংবা অ্যামাজন। ফুটবল আর ক্রিকেটই নগরজীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা।  

তারপরেও, আমাদের জীবনযাত্রায় নগর সংস্কৃতির প্রভাব যত ব্যাপকই হোক না কেন, বাংলার লোক শিল্পের যে বিশাল ভান্ডার তাকেও অগ্রাহ্য করবার উপায় নেই। বাংলার লোকসংস্কৃতি আপনার নাগরিক জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে সূক্ষ্মভাবে হলেও প্রভাব বিস্তার করেছে? জানাতে পারেন কমেন্টে।    

   

Write A Comment

Author