Reading Time: 7 minutes

ইট-কাঠ-পাথরে বিনির্মিত হয় স্থাপত্য। তবু এতে জড়িয়ে থাকে স্মৃতির ছোঁয়া, অনুভবের ব্যাপ্তি আর সময়ের জলছাপ। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অনন্য স্বাক্ষর এ ভূখন্ডের স্থাপত্যশিল্প। ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকেই এখানে বিকশিত হয়েছে নির্মাণের অপরূপ শৈলী। আজও আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্প। ‘স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এ সিরিজের প্রথম পর্বে থাকছে বাংলার স্থাপত্যের অতীত ইতিহাস।  

পাল বৌদ্ধ স্থাপত্য

সোমপুর মহাবিহার
সোমপুর মহাবিহার পাল বৌদ্ধ স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন

অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলায় ছিলো বৌদ্ধ শাসন। বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ ও যার অন্তর্ভুক্ত ছিল) ভারতীয় বৌদ্ধ শাসনের প্রথম দিককার সাম্রাজ্য ছিল পাল সাম্রাজ্য, যারা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করে। পাল গণ স্থাপত্যের একটি নতুন ধারা তৈরি করে যা ‘পাল ভাস্কর্য শিল্প বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত ছিল। স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশ কেমন ছিলো তা জানতে ময়নামতির শালবন বিহার, সোমপুর মহাবিহার, সুবিশাল বিক্রমশিলা বিহার, ওদন্তপুরু বিহার এবং জগদ্দল বিহারের পালদের কিছু উল্লেখযোগ্য কীর্তি দেখতেই হবে। 

প্রায় এক হাজার বছর আগে সম্রাট নির্মিত এ বিহারগুলো ছিলো অনেকটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। দেশ-বিদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন ছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষিপ্রযুক্তি, গণিত প্রভৃতি চর্চা করা হতো এখানে। শালবন বিহার, সোমপুর বিহারের বর্গাকৃতির লেআউট বা কাঠামো এ যুগের স্থাপত্যশৈলীর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। তবে তাদের স্থাপত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিলো ভিক্ষুকোঠা। এসব ভিক্ষুকোঠার মেঝেতে ছিলো নিরেট মঞ্চ ও মূর্তি রাখার ফোকর  আর দেয়ালে ছিলো কুলুঙ্গি (বিভিন্ন জিনিস রাখার ছোট ছোট গর্ত)। সোমপুর বিহারে এমন ভিক্ষুকোঠা পাওয়া গেছে ১৬টি। পালদের স্থাপত্যশৈলীতে আরো ছিলো লম্বা টানা বারান্দা এবং কারুকার্যখচিত তোরণ। তবে এ কারুকার্যের প্রকৃতি ফুলেল বা নকশাদার ছিলো না, বরং মূর্তির প্রতিকৃতি ছিলো এ কারুকার্যের মূল অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের বৌদ্ধ স্থাপত্যের স্বনামধন্য দুটো নিদর্শন সোমপুর মহাবিহার ও শালবন বিহারে দেখা যায় ক্রুশাকৃতির মন্দির, যা ভারতীয় শিল্পশাস্ত্রে ও বাস্তুশাস্ত্রে ‘সর্বতোভদ্র মন্দির’ নামে পরিচিত। কোনো কোনো পালা বৌদ্ধ স্থাপত্যে স্তূপ ও ছোট ছোট মন্দিরও দেখা যায়। 

প্রস্তর বা পাথরের মূর্তি পালা বৌদ্ধ স্থাপত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সোমপুর মহাবিহারের ৬৩টি পাথরের মূর্তির মধ্যে মূলত একটি ছিলো বৌদ্ধ ধর্মের, বাকি ৬২টি হিন্দু ধর্মের প্রতিমা। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এ-ও জানা যায় যে, পঞ্চম শতকের একটি জৈন বিহারের ওপর পাল আমলের কিছু বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করায় জৈনদের কিছু নিদর্শন বিহারগুলোতে র‍য়ে গিয়েছিলো। তৎকালীন সময়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, চীন, জাপান এবং তিব্বত জুড়েও পাল স্থাপত্য অনুসরণ করা হচ্ছিল। স্থাপত্যবিদ ড. স্টেল্লা ক্রাম্রিস্ক বলেন, “বিহার এবং বাংলার পালা বৌদ্ধ স্থাপত্য নেপাল, বার্মা, শ্রীলংকা এবং জাভার উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।”

ইসলামিক এবং মুঘল স্থাপত্য

লালবাগ কেল্লা
মুঘল স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন লালবাগ কেল্লা

বাংলায় সুলতানি শাসন বা সালতানাত ছিল ১৩৪২ থেকে ১৫৭৬ সালে। তখন মধ্য এশীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম নবাবেরা মুঘল সাম্রাজ্য থেকে প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতেন। আবার ১৫৭৬ এর দিকে মুঘল সাম্রাজ্য বাংলার বেশিরভাগ জায়গায় বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। ঢাকা হয়ে ওঠে মুঘলদের ‘সামরিক ঘাঁটি’। ১৬০৮ সালে সুবাদার প্রথম ইসলাম খান ঢাকাকে ‘বাংলা সুবাহর রাজধানী’ হিসেবে ঘোষণা দিলে নগরায়ন এবং আবাসন এর ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়। নির্মিত হয় বহু মসজিদ এবং দুর্গ। সুলতানি স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন ষাট গম্বুজ মসজিদ, সোনা মসজিদ, কুসুম্বা মসজিদ প্রভৃতি। আর মুঘল স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন লালবাগ কেল্লা, চক বাজার মসজিদ, সাত মসজিদ, বড় কাটরা, ছোট কাটরার ইত্যাদি। স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশ এর বিবর্তন জানতে এ সময়কাল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। 

সুলতানি স্থাপত্যরীতি

সুলতানি স্থাপত্যে তুঘলকি স্থাপত্যের প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। চওড়া প্রাচীর ও মিনারের সমন্বয় সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর প্রায় সবগুলো নিদর্শনেই লক্ষণীয়। সুলতানি স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন ষাট গম্বুজ মসজিদের কথাই ধরা যাক, প্রায় আট ফুট চওড়া এর প্রাচীর। এছাড়া ছাদের কোণায় কোণায় মিনার, সামনে ও পেছনের দরজায় খিলান এবং অনেকগুলো দরজা- এসবও সুলতানি স্থাপত্যে দেখা যায়। ষাট গম্বুজ মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রধান মেহরাবের পাশে একটি দরজাসহ ২৬টি দরজা আছে। এছাড়া মসজিদের সামনের দিকে একটি বড় খিলান এবং এর দুই পাশে পাঁচটি করে ছোট খিলানও দেখা যায়। মোহাম্মাদপুরস্থ সাত গম্বুজ মসজিদের ছাদে রয়েছে তিনটি বড় গম্বুজ এবং চার কোণের প্রতি কোনায় একটি করে অণু গম্বুজ।  

মুঘল স্থাপত্যরীতি

মুঘল স্থাপত্যে পারস্যের সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট । গম্বুজ, কারুকার্যখচিত ছাদ, বিশালাকৃতির প্রবেশদ্বার মুঘল স্থাপত্যের প্রায় সবগুলো উল্লেখযোগ্য নিদর্শনেই দেখা যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মার্বেল পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। মোগল আমলের চকচকে নীল-সাদা মার্বেল এখনো শোভা পাচ্ছে লালবাগ কেল্লার হাম্মামের মেঝেতে। এছাড়া দেয়ালে ফলক তৈরি করে তাতে নানা নির্দেশাবলি লিখে রাখার রেওয়াজও ছিলো মুঘল স্থাপত্যে। মুঘল স্থাপত্যের অবিস্মরণীয় প্রমাণ বড় কাটরার তোরণে ফার্সি ভাষায় শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজী লিখিত একটি পাথরের ফলক লাগানো ছিল। সেখানে এই মুসাফির খানার নির্মাতা ও এর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় নির্বাহের উপায় সম্পর্কে লেখা ছিল:

“সুলতান শাহ্‌ সুজা সব সময় দান-খয়রাতে মশগুল থাকিতেন। তাই খোদার করুণালাভের আশায় আবুল কাসেম তুব্বা হোসায়নি সৌভাগ্যসূচক এই দালানটি নির্মাণ করিলেন। ইহার সঙ্গে ২২টি দোকানঘর যুক্ত হইল- যাহাতে এইগুলির আয়ে ইহার মেরামতকার্য চলিতে পারে এবং ইহাতে মুসাফিরদের বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা হইতে পারে। এই বিধি কখনো বাতিল করা যাইবে না। বাতিল করিলে অপরাধী শেষ বিচার দিনে শাস্তি লাভ করিবে। শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজি কর্তৃক এই ফলকটি লিখিত হইল।

টেরাকোটা মন্দির স্থাপত্য

কান্তজীর মন্দির
কান্তজীর মন্দিরের গায়ের টেরাকোটা কারুকার্য আজও মুগ্ধ করে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের

স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশ এর উল্লেখযোগ্য বিবর্তন দেখা যায় টেরাকোটা মন্দির গুলোতে। কাদা মাটি পুড়িয়ে টেরাকোটা দিয়ে এ মন্দিরগুলো তৈরি করা হয়। বাংলার টেরাকোটা মন্দির স্থাপত্যের ধরনে বিভিন্ন রকম ছাদ দেখা যায়। চাল বা ছাদের গঠনের ভিত্তিতে মন্দিরের গঠন ভিন্ন হয়, আবার রত্নের ভিত্তিতেও মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ভিন্ন হয়।  

ছাদের স্থাপত্যশৈলী

একবাংলা মন্দিরে রয়েছে দুই ঢাল বিশিষ্ট একটি বাঁকা ছাঁদ। বিক্রমপুরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়নে থাকা মন্দিরগুলো এ গঠনশৈলীর আভাস দেয়। জোড়বাংলা বা একবাংলা মন্দিরে রয়েছে দো-চালা ধরনের ছাঁদ, যার দুটি বাঁকা অংশ একটি বাঁকা চূড়ায় এসে মিশে। মুন্সীগঞ্জের সোনারং জোড়া মন্দির এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। চারচালা মন্দিরে চারটি ত্রিকোণাকার খণ্ডের সমন্বয়ে তৈরি হয়। রঘুনাথজীউ মন্দির এভাবেই তৈরি করা হয়েছে। আটচালা মন্দির আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলায়, বিশেষ করে হুগলি ও হাওড়া জেলার নির্মাণশিল্পী ও পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ধারার মন্দির চারচালা মন্দিরের মতোই, তবে তার সঙ্গে একটি অতিরিক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির ছাদের গঠন জোড়া দিয়ে মন্দিরের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়।

বৃহত্তর আটচালা মন্দিরে সাধারণত তিনটি প্রবেশদ্বার থাকে। আটচালা মন্দিরের দৃষ্টান্ত রয়েছে যশোরের গুঞ্জনাথ শিব মন্দির, বাগেরহাটের জোড় শিব মন্দির, কুমিল্লার চান্দিনার শিব মন্দিরে। দেউল ধরনের ছাদ সাধারণত ছোট আকারের হয় এবং ইসলামিক স্থাপত্যের কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারা প্রভাবিত। বিক্রমপুর ও নরসিংদী অঞ্চলে এ মন্দিরগুলো থাকার প্রমাণ ইতিহাসে পেলেও বর্তমানে এর মূর্তিমান দৃষ্টান্ত পাওয়া দুষ্কর। 

রত্ন মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী 

একরত্ন মন্দিরের মূল কাঠামো চারপাশওয়ালা চারচালা মন্দিরের মত। তবে এর ছাদ সমতলীয় হয় ও কেন্দ্রে একটি সুসজ্জিত চূড়া থাকে। একরত্ন, মূল স্তম্ভ চারকোণা চারচালা মন্দিরের মত। কিন্তু ছাঁদ অন্যরকম, সমতল এবং কেন্দ্রে একটি টাওয়ার বিশিষ্ট। বর্তমানে এর নিদর্শন পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, বিষ্ণুপুর ও বিক্রমপুরে এ ধরনের মন্দির প্রচলিত ছিলো। পঞ্চরত্ন রীতির মন্দিরের ছাদে পাঁচটি চূড়া বা কুটিরসদৃশ কাঠামো দেখা যায়। চারটি কোণে চারটি চূড়া সমান উচ্চতায় থাকে, পঞ্চম চূড়াটি কেন্দ্রে এবং অন্যান্য চূড়ার চেয়ে উঁচু হয়। সম্ভবত উত্তর ভারতের পঞ্চায়তন স্থাপত্যরীতি থেকে বাংলা পঞ্চরত্ন মন্দির উদ্ভূত হয়েছে, যেখানে মূল মন্দিরের চারকোণে চারটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মন্দির থাকে। যশোর, রাজশাহীর পুঠিয়া, দিনাজপুর, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে এই রীতির মন্দির দেখা যায়। পুঠিয়া মন্দির এ দেশে এ নির্মাণশৈলীর অনন্য নিদর্শন।

নবরত্ন মন্দিরে দুটি ধাপ থাকে। প্রতি ধাপের চতুষ্কোণে চারটি করে আটটি আর কেন্দ্রে একটি করে মোট নয়টি চূড়া বা রত্ন নির্মাণ করা হয়। অষ্টাদশ শতকে এ রীতির মন্দির স্থাপত্যের উদ্ভব ঘটে। নবরত্ন ধারাটি মূলত পঞ্চরত্ন ধারার সম্প্রসারিত রূপ যেখানে পাঁচটি (চারকোণে চারটি ও কেন্দ্রে একটি) চূড়া বা রত্ন থাকে। দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের পুরোনো নয়টি রত্নের সাতটি দৃশ্যমান রয়েছে। তবে একটি ভূমিকম্পে বিখ্যাত এই নবরত্ন মন্দিরের রত্নসমূহ বিলীন হয়ে যায়। এছাড়া সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল মন্দির, খুলনার ধামারেলী মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীও এমন। 

ঔপনিবেশিক স্থাপত্য

সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ,  ওলন্দাজ, ফরাসীসহ আরো অনেক  ইউরোপীয় বণিকগণ ঢাকায় তাদের নিজ নিজ দেশের নামে নিজস্ব ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করে। তৎকালীন সময়ে ইউরোপীয় বণিক সমাজ তাদের ব্যবসার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ঢাকায় কলকারখানার পাশাপাশি বেশ কিছু স্থায়ী স্থাপনা গড়ে তুলে, যা মূলত ‘কলোনিয়াল’ বা ‘ঔপনিবেশিক’ স্থাপনা নামে পরিচিত। তবে ঔপনিবেশিক স্থাপত্য সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে কোম্পানি রাজ শুরু হওয়ার পর। 

কলকাতার মত ঢাকায় ঔপনিবেশিক স্থাপনার উপস্থিতি তেমন একটা না দেখা গেলেও, শহরতলীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা। এ স্থাপনাগুলোর কোনো নির্দিষ্ট গঠনশৈলী খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেননা যে জাতির বণিকেরা যখন এখানে বাণিজ্যের জন্য এসেছে তখন তাদের দেশের স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী এখানে গড়ে তোলা হয়েছে নানা ভবন। 

ইউরোপীয় নির্মাণশৈলী 

স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশ এর অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ইউরোপীয় নির্মাণশৈলী। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতেই বাংলাতে গ্রীক ব্যবসায়ীদের আগমন শুরু হয়। ১৮২১ সালে পুরান ঢাকার ‘মুকিম কাটরা’য় (চকবাজারের পাশে) একটি গ্রীক গীর্জার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বিলীন হয়ে যায়। এছাড়া তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের আদেশে, গ্রীক প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ্গোজ এন্ড র‍্যালি ব্রাদার্সের আর্থিক সহযোগিতায় একটি সমাধিস্তম্ভ নির্মিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে স্থানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অধীনে চলে যায়। বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিএসসি)-এর ভিতর অবস্থিত। ছোট্ট হলুদাকৃতির এই স্মৃতিস্তম্ভটি প্রাচীন গ্রীক মন্দিরের আদলে তৈরী। মার্বেল পাথরের তৈরি, চুনাপাথরের ভিত্তি সহযোগে নির্মিত এ দুটো স্তম্ভেই গ্রিক পিলার স্টাইলের সরাসরি প্রভাব রয়েছে।

১৭৮১ সালে, আরমানিটোলাতে তৈরী করা হয় বর্তমানের আর্মেনিয়ান চার্চ। বৃহৎ টাওয়ার, ইউরোপিয়ান গথিক স্টাইলের জানালা-দরজা, বিশাল ঘড়ি আর অনাড়ম্বর সাদা-সোনালি দেয়াল এ চার্চে এনেছে স্বতন্ত্রতা। ১৬৭৭ সালে পর্তুগিজ বণিকেরা স্থাপন করেন হলি রোজারিও চার্চ, যা বর্তমানে তেজগাঁওতে অবস্থিত। এর নির্মাণশৈলীতে পর্তুগিজদের মতো প্রশস্ত বারান্দাযুক্ত প্রবেশপথ দেখা যায়। আবার গাজীপুরস্থ সেন্ট নিকোলাস চার্চে চিরাচরিত নার্দেক্সের পরিবর্তে বাংলাঘরের অনুকরণে চারটি মজবুত খুঁটির ওপর সমতল ছাদযুক্ত একটি বারান্দা তৈরি করা হয়েছে। এটা ইউরোপীয় গির্জা স্থাপত্যের দেশি চরিত্র হিসেবেও ধরা যেতে পারে। এই গির্জা বিদেশিদের আদলে করা হলেও এর নির্মাতারা ছিলেন দেশি। আর ব্রিটিশ স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য লাল ইট-সুরকি, মধ্য যুগীয় তোরণ বিশিষ্ট প্রবেশপথের ছাপ পাওয়া যায় ফরাশগঞ্জের নর্থ ব্রুক হল, রাজশাহীর ফুলার ভবন, নারিন্দার ক্রিশ্চিয়ান সিমেট্রি সহ আরো অনেক স্থাপনায়। 

বাংলো স্থাপত্যশৈলী 

স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশ এর অগ্রগতির সাথে এ রীতির স্থাপত্য বেশ জরুরি। বাংলো স্থাপত্যের সূচনার ঐতিহাসিক ভূমি বাংলা প্রদেশ হলেও ইংরেজদের হাতে এ ধরনের স্থাপত্য নানা রূপ লাভ করে।  এ ধরনের বাড়িগুলো প্রথাগত ভাবেই ছোট ছিল। কেবল একতলা, নিরিবিলি, একটি প্রশস্ত উঠান থাকতো এখানে। এ বাড়িগুলো ব্রিটিশরা ব্যবহার করতো চা বাগানে, অবকাশ যাপনে এবং ভারতীয় শহরের বাইরে তারা এগুলো প্রাদেশিক প্রশাসকের বাড়ি হিসেবেও ব্যবহার করত। বাংলো ধরনের বাসাগুলো এখনো গ্রাম বাংলায় বিখ্যাত। আধুনিক কালে মূল স্থাপত্য উপাদান হিসেবে খাঁজকাটা ষ্টীলের পাত ব্যবহার করা হয়। 

ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যের প্রত্যাবর্তন 

স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশ এর বিস্তারিত আলোচনায় এ নির্মাণশৈলীর কথা বলতেই হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ যুগে অতীতে প্রচলিত ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যে ধরনের উন্নতি হতে থাকে, যা কিনা ভারতীয়, ইউরোপিয়ান এবং মধ্য এশীয় (ইসলামিক) উপাদানের মিশ্রণে তৈরি । ‘ইউরোপীয় শরীরে মুঘল অলংকার’ –ঔপনিবেশিক আমলের শংকরধর্মী স্থাপত্যকে এটিও বলা হয়। এমন উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হচ্ছে ঢাকার আহসান মঞ্জিল এবং রংপুর শহরে অবস্থিত তাজহাট রাজবাড়ি। ব্রিটিশ রীতির পিলার, কক্ষ বিন্যাস থাকলেও এগুলোর অলংকরণ হয় মুঘল কারুকাজ দিয়ে। 

স্থাপত্যশিল্প যেকোনো জাতিসত্তার ইতিহাসের পালাবদল, ঐতিহ্যের বহতামান ধারাকে তুলে ধরে। তাই যেকোনো জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য বুঝতে চাইলে জানতে হবে এর স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণের বিস্তারিত। ব্রিটিশ শাসনের পর কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশের স্থাপত্য, কীভাবে আধুনিক জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠেছে আমাদের ভবনগুলোতে- সেসব নিয়ে পড়ুন এ সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে। আর প্রথম পর্বে স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশ এর অতীত নিয়ে আমাদের এ আয়োজন আপনার কেমন লাগলো সেটি জানিয়ে দিন কমেন্টস বক্সে!

Write A Comment