যদি আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্য এসে বলে, বর্তমান থেকে অতীতে ফিরে যাওয়ার বর দেবে সে আপনাকে! চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, অতীতের ঠিক কোন সময়ে ফিরে যেতে চাইবেন? চোখের সামনে ঠিক কোন অতীতটি সামনে এসে দাঁড়াবে তখন? আপনি একালের মানুষ হোন বা সেকালের, ৯০ এর দশকের হোন বা একবিংশ শতকের, যে জায়গাটি মিলে যাবে সবার সাথে সেটা হচ্ছে হাই স্কুলে ফিরে যাবার ইচ্ছা। বর্তমানের সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে সবাই চাইবে হাই স্কুলের সোনালি গন্ডি আরো একবার মাড়িয়ে আসতে। কারণ, সবার কাছেই হাই স্কুলের দিনগুলো একটু বেশি আলাদা, একটু বেশিই আবেগের। তাহলে চলুন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হাই স্কুলের স্মৃতি হাতড়ে আসি ৯০ এর দশক থেকে একবিংশ শতক অব্দি।
৯০ এর দশকের হাই স্কুলের গল্প
শ্যাওলা জমে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া হলদে দালান, সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, আরেকটু এগোলে স্কুলের সাথে লাগোয়া পুকুরঘাট। মাঠের এক প্রান্তে অবধারিতভাবে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো শহীদ মিনার। তার একপাশে আপন গতিতে উড়ে চলছে জাতীয় পতাকা। সেই মাঠে শহীদ মিনারের সামনে সোজা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে একসাথে শপথ পাঠ আর সমস্বরে গাওয়া জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। ৯০ এর দশকে যাদের জন্ম, এই দৃশ্যপটটি কার না চেনা! ভিন্ন ভিন্ন জেলার, ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, তবু সময়ের সীমারেখা সবারই এক হয়ে যায় হাই স্কুলের স্মৃতি তে এসে। হাফপ্যান্ট ছেড়ে নীল রঙ-এর ফুল প্যান্ট আর সাদা শার্টে হাই স্কুলের আঙিনায় প্রথম পা রাখা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের সাথে নিজের কথোপকথন “এইবার বড় হয়ে গেছি আমি।” ৯০ এর হাই স্কুলের স্মৃতি এইসব বোঝাপড়ার সাথেই যেন যাচ্ছেতাই করতে পারার শৌখিনতায় পরিপূর্ণ। সে সময় হাইস্কুল মানেই তাই, দক্ষিণ জানালার পাশের প্রিয় সিট দখলে নিতে বন্ধুর সাথে মারামারি, ক্লাস ফাঁকি দেয়া, দেয়াল টপকে স্কুল পালানো, সবাইকে লুকিয়ে স্কুলের ছাদে কৈশোরের রঙিন ঘুড়ি নীল আকাশে মেলে ধরাসহ আরো অসংখ্য দুরন্তপনা।
নব্বইয়ের সেই সময়ে বদমেজাজী কঠিন শাসনের কাশেম স্যার যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন মিষ্টি হাসির মায়া ম্যাডাম। এই নামগুলো না মিললেও, কাশেম স্যারের ক্লাসে অংক না পারায় ঠাঁস ঠাঁস করে বেতের বাড়ি কিংবা ক্লাসে অমনোযোগী হওয়ায় ডাস্টার ছুড়ে মারার মত তিক্ত অভিজ্ঞতা যে মিলে যাবে সবার সাথে তা কিন্তু নিশ্চিত করেই বলতে পারি। সেইসাথে মিলে যেতে পারে বৃষ্টির বিকেলে ক্লাসের পড়া না ধরে সবাইকে তাক লাগিয়ে সঞ্চিতা ম্যাডামের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত। সে সময় গ্রীষ্মেকালে দীর্ঘ ছুটির সময়গুলো হাই স্কুলের স্মৃতি তে যোগ করে দিত বাড়তি মাত্রা। ছুটির মাঝে কী কী অঘটন ঘটানো যাবে এই নিয়ে চলত দস্যু দলের জল্পনা কল্পনা। আবার কবে স্কুল খুলবে, কবে বন্ধুদের সাথে বাঁদড়ামোতে যোগ দেব, সেই প্রতীক্ষাও কম ছিল না। কাঁচা-পাকা চুল, মাঝারি গোঁফ আর নীল রঙের ইউনিফর্ম পরা দপ্তরি চাচার ঢং ঢং ঘণ্টাই তখন কেবল এই অপেক্ষার অবসান ঘটাতে পারে। কারণ, সেই ঘণ্টার সাথেই তো আবারো শুরু হয় স্কুলের মাঠজুড়ে এক ঝাঁক ছেলেমেয়ের দাঁড়িয়াবাঁধা বা বৌ-চিঁ খেলা, দৌড়ঝাঁপ আর দস্যিপনা! সদ্য কৈশোরে পা বাড়ানো এই সময়ে, অবুঝ প্রেমের ঘোরও লাগে কখনো কখনো। চিরকুট বিনিময় আর ক্লাসে বসে অদ্ভুত ইশারায় কথা বলা দিয়েই শুরু হয় তাদের প্রেমের প্রথম পাঠ। ঠিক এতোটাই রোমাঞ্চকর নব্বইয়ের দশকের স্মৃতি তে জুড়ে থাকা হাইস্কুল জীবনের প্রতিটি দিন। এই সমস্ত স্মৃতি যদি আপনার ঝুলিতেও জমা থাকে তবে আপনিও ৯০ দশকের সেই ভাগ্যবান যিনি হাইস্কুলের আদ্যোপান্ত উপভোগ করেছেন নিংড়ে নিংড়ে।
একবিংশ শতকের হাই স্কুলের গল্প
৯০ এর সাদাকালো সময়ে হাইস্কুল জীবন যতো রঙিন ছিল, একবিংশ শতকের এই সময়ে সেই রঙে হয়তো খানিক ভাটা পড়েছে। এল(L) শেইপের শ্যাওলা পড়া একতলা স্কুলের চেয়ে ঝকঝকে বহুতল ভবনের আধিক্যই এখন বেশি। ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ড আর চকের জায়গা দখল করে নিয়েছে হোয়াইট বোর্ড আর মার্কার নামের আধুনিক উপকরণ। এইসব আধুনিকতার সাথে খাপ খাওয়াতে, একটু একটু করে পাল্টে গেছে এসময়ের হাই স্কুল জীবনের গল্পগুলোও।
পড়াশোনার প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে প্রাথমিক স্কুল থেকে কাঁধে চাপানো স্কুল ব্যাগের ভার, হাইস্কুলে এসে বেড়েছে আরো কয়েক গুণ। বেড়েছে কোচিং সেন্টার আর সেখানে প্রাইভেট পড়ার হিড়িক। এই শতকে স্কুলের গল্পগুলো স্কুল গেইট আর দপ্তরির ঘণ্টার ঢং ঢং আওয়াজে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে এখন যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট নামক বৈশ্বিক জাল। ফলে, এখনকার হাই স্কুল পড়ুয়াদের যতোটা না স্কুলের চার দেয়ালে সময় কাটছে, তার চেয়ে বেশি সময় কাটছে বৈশ্বিক এই জালের শাখা প্রশাখায় বিচরণ করে। স্কুলজীবনের প্রেম এখানে চিরকুট পেরিয়ে হোয়াটস অ্যাপ থেকে মেসেঞ্জার-ইন্সটাতে বিকশিত।
তবে, অসংখ্য পরিবর্তনের ভীড়েও যে জিনিসটি অপরিবর্তনীয় সেটি হল বন্ধুত্ব। বন্ধু নামের এই সম্পর্কটি কোনোকালেই এড়ানোর নয়। বৌ-চিঁ, দাঁড়িয়াবাঁধা ভুলে গেলেও, ছেলেমেয়েরা টিফিনের ফাঁকে এখনও দুরন্ত হয়ে ওঠে ফুটবল আর ক্রিকেটের মত জনপ্রিয় খেলায়। এখনো অগোচরে শিক্ষকদের ডাকা হয় মজার কোনো নামে। তবে এখন কাশেম স্যারের বেতের বাড়ির সেই যুগ পেরিয়েছে। ৯০ দশকের সদা হাস্য মায়া ম্যাডাম, তিনিও এখন দূরের রূপকথা। তারপরেও প্রিয় কিছু শিক্ষক স্মৃতির ঝুলিতে বরাবরই থাকে আমাদের, রয়েছে এই শতকেও। এই শতকেও ঝগড়া হয়, বন্ধুর সাথে রেষারেষি হয়, আবার মূহুর্তেই সব ভুলে এক হয়ে যাওয়ার গল্পও জমা হয়। এখনও অবোধ বালকের সবুজ ঘুড়িতে বাঁধা থাকে তার আজন্ম লালিত লাল স্বপ্ন।
ছোটবেলার সেই আফসোস “ইশশ, কবে যে বড় হব!” সেই ‘বড় হওয়া’ একটা সময় পেরিয়ে সত্যি হয়ে আসে। ততদিনে, আলাদীনের দৈত্যের বরে হাইস্কুলের সোনালি দিনে ফিরে যাবার সাধ, আমাদের কারোরই সাধ্যের আওতায় থাকে না। তারপরেও ফিরে তাকাতে দোষ নেই। দোষ নেই ফেলে আসা হাই স্কুলের স্মৃতির মাঝে ফেটে পড়া হাসিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলে। বর্তমানের এই গৃহবন্দী সময়গুলোকে উপভোগ্য করে নিতে চাইলে আপনিও ফিরে যেতে পারেন হাই স্কুল জীবনের প্রিয় কোনো গল্পে আর সেইসব টুকরো গল্প আমাদের জানাতে পারেন কমেন্ট বক্সে।
1 Comment
শব্দগুলোর সাথে নিজের হাইস্কুল জীবনের স্মৃতিগুলো মিলে যাচ্ছিলো। আমার জন্ম এমন এক সময়ে যে সময়ে ৯০ এর দশকের হাইস্কুলকে আস্তে আস্তে একবিংশ শতকের হাইস্কুলে বদলে যেতে দেখেছি। সে কারণে দুইটি ভিন্ন সময়ে ভিন্ন দুই ধরনের স্মৃতি অনুভব করতে পেরেছি। ❤