Reading Time: 4 minutes

করোনা ভাইরাস শব্দ বা নাম যাই বলি না কেন, সারা বিশ্বে গত কয়েকদিনে নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে এটি। হাতের আঙ্গুলের ডগায় থাকতে পারে কয়েক হাজার করোনা ভাইরাস, এতই ক্ষুদ্র এই সৃষ্টিটি। অথচ মানবসভ্যতার উপর এর প্রভাব অকল্পনীয়। এ সামান্য ভাইরাস এমন কিছু করে দেখিয়েছে যা এই ব্যস্ত, যান্ত্রিক জীবনে কল্পনা করাও ছিল কঠিন। করোনা ভাইরাস প্রায় সব মানুষকে ঘরে বন্দী করে ফেলেছে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছে হোম কোয়ারেন্টাইন এর মতন প্রায় নতুন এক শব্দের সাথে! 

হোম কোয়ারেন্টাইন কী?

একটি হোম কোয়ারেন্টাইন নোটিশ

কোয়ারেন্টাইন(quarantine) শব্দটি শুনতে যতই কাঠখোট্টা লাগুক, বিষয়টি কিন্তু খুব বেশি কঠিন কিছু নয়। কোয়ারেন্টাইনের সরাসরি আক্ষরিক অনুবাদ না থাকলেও “পৃথকীকরণ” হতে পারে কাছাকাছি একটি শব্দ। তবে কোয়ারেন্টাইন শব্দটি সাধারণত ব্যবহার করা হয় সংক্রামক/ছোঁয়াচে রোগ ছড়াতে পারে এমন মানুষ বা জীবকে কিছুদিনের জন্য দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে পৃথক রাখা বোঝাতে।
হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার অর্থ হল গৃহবন্দীত্ব, নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে ফেলা। অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া। জনসমাগম হতে পারে এমন কোন স্থানে যাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না! করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কোন রুগীর সংস্পর্শে আসলে কিংবা কোভিড ১৯ এর প্রাদুর্ভাব হয়েছে এমন দেশে/এলাকায় যাতায়াত করে থাকলে আপনাকে অবশ্যই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।

হোম কোয়ারেন্টাইনে কেন থাকতে হবে?

করোনা ভাইরাস যে অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগের কারণ সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে এই ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে দেহে রোগের লক্ষণ দেখা দিতে ১৪দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কিন্তু লক্ষণ দেখা দেয়ার অনেক আগে থেকেই ভাইরাসটি অন্য আরেকজনের দেহে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। তাই হোম কোয়রেন্টাইন অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়।
দেহের ভেতরে ঢুকে কোষ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারলে একটি ভাইরাস মাত্র এক ঘণ্টার মাঝেই ১০,০০০ (দশ হাজার) ভাইরাসের জন্ম দিতে পারে। কোন রকম লক্ষণ প্রকাশ করার আগেই সংক্রমিত একজন মানুষের এক চা-চামচ পরিমাণ রক্তে, লালায় কিংবা কফ থুতুতে থাকতে পারে কয়েক লক্ষ ভাইরাস! নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখার জন্য এর চেয়েও দরকারী কোন কারণ থাকতে পারে কি?

হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকলেই কি কেউ নিশ্চিত করোনা ভাইরাস আক্রান্ত?

এক কোথায় উত্তর – না। অনেকেরই ভুল ধারণা থাকতে পারে, তবে কেউ হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার অর্থ এই না যে সে নিশ্চিতভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। এটি একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। কেউ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে থাকলে কিংবা রোগ আছে এমন এলাকায় ভ্রমণ করলে তারও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এজন্যই তাকে ১৪ দিন সব কিছু থেকে আলাদা হয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়।

হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীন করণীয়

হোম কোয়ারেন্টাইন খুব কঠিন কিছু নয়, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এসময় তাই কিছু জিনিস মেনে চলুন

  • সর্বপ্রথম কথা, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আতঙ্ক মানুষের স্বাভাবিক চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। আগেই বলা হয়েছে হোম কোয়ারেন্টাইন মানে এই না যে আপনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। আর খুব খারাপ বিষয়ে যদি হয়েও যান, করোনাভাইরাসের বিপক্ষে আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধে নিয়োজিত থাকা অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো, কোষগুলো কাজ শুরু করে দেবে। তাই আপনার দায়িত্ব আতঙ্কিত না হয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে খুব চিন্তাশীল হওয়া।
  • আপনার ঘরে থাকা বৃদ্ধ এবং শিশু কেউ যেন কোন অবস্থাতেই আপনার আশেপাশে না আসতে পারে তা কঠোরভাবে নিশ্চিত করুন। কেননা বয়স্ক এবং শিশুরা ভাইরাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে দূর্বল। নিজের অজান্তেই আপনার মাধ্যমে তাঁরা আক্রান্ত হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আবেগের কোন স্থান নেই।
  • সর্বোচ্চ প্রয়োজন ছাড়া কোনভাবেই রুম থেকে বের হবেন না। নিজের ঘরে অ্যাটাচড বাথরুম থাকলে তো ভাল, না থাকলে আপনি যে বাথরুম ব্যবহার করবেন তা যেন কোনভাবেই অন্য কেউ ব্যবহার না করে। 
  • অবশ্য অবশ্যই আপনার সংস্পর্শে আসছে এমন সব কিছু আলাদা করে ফেলুন। খাবার পাত্র, পানির গ্লাস, পরিধেয় বস্ত্র থেকে শুরু করে সব কিছু। যেখানে আপনার ছোঁয়া লাগবে তা যেন অন্য কারো কাছে না যায়। 
  • মাস্ক পরিধান করুন এবং প্রতিনিয়ত তা বদলে ফেলুন। খোলাস্থানে হাঁচি কাশি দেবেন না, টিস্যু ব্যবহার এবং বদ্ধ পাত্রে তা ফেলে দেবার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
  • নিজ ঘরে বদ্ধ থাকা অবস্থাতেও ঘনঘন হাত সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার রাখুন। শত চেষ্টার পরও হাত থেকে অন্য বস্তুতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই হাতে থাকতেই (যদি থাকে) তা ধ্বংস করে ফেলার ব্যবস্থা করুন।
  • জ্বর, কাশি বা যে কোন ধরণে লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

লম্বা সময়ের জন্য হোম কোয়ারেন্টাইনের প্রস্তুতি

স্যানিটাইজার মাস্ক
হোম কোয়ারেন্টাইন থাকতে হলে প্রস্তুতি নিয়ে নিন

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের এই গৃহবন্দীত্ব বেশ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এছাড়া যদি কোন পরিবারের একজনকেও কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়, এর অর্থ মোটামুটি সমগ্র পরিবারেরই বাড়িতে বন্দী থাকা। তাই আগে থেকেই কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে রেখা ভাল। হোম কোয়ারেন্টাইনের প্রস্তুতি হিসাবে যা যা করা যেতে পারে

  • যেহেতু ১৪দিন আলাদা থাকতে হবে এবং যত সম্ভব বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারের মজুদ করুন ঘরে। ঘরে বসে থেকেও যেন পরিবার ১৪ দিন পরিমাণ চলতে পারে এই পরিমাণ চাল, ডাল, তেল, আটা, লবণ কিনে রাখুন। শুকনো খাবার যেমন মুড়ি, চিড়া, ওটস, বিস্কুট, বিভিন্ন টিনজাত খাবার ইত্যাদিও কিনে রাখতে পারেন।
  • দরকারী সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টিস্যু হ্যান্ডওয়াশ ইত্যাদি কিনে রাখুন। এবং তা নিজের ঘরেই রাখুন। আপনি যেটি ব্যবহার করছেন, বাড়ির অন্য কাউকে তা ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করুন।
  • অবশ্যই মাসখানেকের মত দরকারী ঔষুধ, এবং অন্যান্য মেডিক্যাল সাপ্লাই (কন্টাক্ট লেন্স, হেয়ারিং এইড এর ব্যাটারি ইত্যাদি) সংগ্রহে রাখুন। যদি কোন ঔষুধ আপনার অথবা পরিবারের কারো দরকার হয়, তাও সংগ্রহে রাখুন। একটি দরকারী ফাস্ট-এইড বক্সও হাতের নাগালে প্রস্তুত রাখুন।
  • নিজের মানুষিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রস্তুতি নিন। ১৪ দিন কম সময় নয় এবং তা বাড়তেও পারে। তাই ঘরে বন্দী থাকতে গিয়ে বিরক্তি এসে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এসময় পড়ার মত যথেষ্ট বই সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। টানা সময় পাওয়া যায় না বলে অনেকের অনেক ইচ্ছা পূরণ হয়ে উঠে না। এসময়ে সেজন্য সময় বরাদ্দ রাখতে পারেন। কেউ কোন ইন্সট্রুমেন্ট শিখতে চাইলে ইন্টারনেটের সহায়তায় তা করতে পারেন। কেউ ছবি আঁকতে পছন্দ করলে তা করতে পারেন।  

তবে লক্ষ্য রাখতে হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেন কেনা না হয়। তা আপনার এবং সামগ্রিকভাবে সবার জন্যই ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। 

হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার আভিধানিক অর্থ বলে, প্রয়োজনে কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবেন। তবে তা হতে হবে অতীব জরুরী প্রয়োজন। বের হতে হলেও মাস্ক, হ্যান্ড গ্লভস, চশমা পরে তবেই বের হোন। অন্যথায় ঘরে থাকুন। অনেকেই অভিযোগ করতেন ব্যস্ত জীবনে দুদন্ড দম ফেলার সময় পাওয়া যায় না। কিছুটা অনাকাঙ্ক্ষিত উপায়ে হলেও, এখন কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষিত অবসর পাওয়া গিয়েছে। তাই নিজ ঘরে অন্তরীণ থেকে যদি দেশ ও দশের উপকার হয় তা করাই কি শ্রেয় নয়?  

Write A Comment