Reading Time: 4 minutes

মহামারী চলাকালীন সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার যে ঝড় বয়ে যায়, বাংলাদেশের আবাসন খাত সেক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ স্থিতিশীলই ছিল বটে। আর এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের আবাসন খাত এর জন্য সংশোধিত বাজেট প্রণয়নের সাথে সাথে, রিয়েল এস্টেট বাজারকে মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করতে বেশ কিছু নতুন নিয়মনীতি নিয়ে কাজ করা হয়। যার ফলাফলও মানুষ দেখতে শুরু করে। তবে ২০২১ সালের শুরুতে সময়টা ভালো গেলেও, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির চিত্র যেন হুট করেই বদলে যায়। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেখা দেয় সংকট, যা বাংলাদেশের আবাসন খাতকে বেশ বড় রকমের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে দেয়। তবে চলুন ফিরে দেখা যাক, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আবাসন খাত এ কোন বিষয় সমূহ প্রভাব ফেলে।  

কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি 

RAW MATERIAL PRICE
কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে ২০২১ সালে প্রপার্টির মূল্যও বৃদ্ধি পায়

কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২১ সালে প্রপার্টির মূল্যও বৃদ্ধি পায় লক্ষণীয় মাত্রায়। আর এর শুরুটা হয় করোনা মহামারীর মধ্য দিয়ে। ফলাফলে ২০২০ সালে সমগ্র বিশ্বই যেন স্থবির হয়ে যায়। আর এর প্রভাব আবাসন খাত থেকে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থির করে ফেলে এবং সময়ের সাথে সাথে কাঁচামাল সহ বিভিন্ন জিনিসের দামও বাড়িয়ে দেয়। 

পরবর্তী সময়ে ইস্পাত, সিমেন্ট এবং অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী তৈরির জন্য উপকরণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করাও বেশ কঠিন হয়ে যায়। যা নির্মাণ শিল্পের গতিতে প্রভাব ফেলে মারাত্মকভাবে। নেতিবাচক এই প্রভাবে আবাসন খাতের মূল্যও যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বিনিয়োগের পরিমাণও আগের চেয়ে অনেকাংশে কমে যায়। 

২০২১ সালের নভেম্বরে, প্রতি টন ইস্পাতের দাম ছিল ৭৭,৫০০ টাকা এবং প্রতি ৫০ কেজি সিমেন্টের দাম দাঁড়ায় ৪৩০ টাকা, যা ২০২০ সালের জুলাই মাসে ছিল যথাক্রমে ৫৩,০০০ টাকা এবং ৩৬০ টাকা; স্টিলের ক্ষেত্রে এই মূল্য বৃদ্ধি ছিল ৪৬% এবং সিমেন্টের জন্য ১৯.৪%। 

এ সময়ে, পাথরের দামও প্রতি টন ৩,০০০ টাকা করে বেড়েছে। সাথে মেঝে ও দেয়ালের টাইলসের দাম বৃদ্ধি সহ বালির দাম ২,০০০ টাকা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ইটের দাম প্রতি পিস বাবদ ১.৫ টাকা, অটো ইট ২.৫ টাকা, সিরামিক ইট ৫ টাকা এবং কংক্রিটের ইটের দাম ৮ টাকা করে বৃদ্ধি পায়। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব 

রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ অর্থনৈতিক বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলে

মহামারীর প্রভাব থেকে বিশ্ব অর্থনীতি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে চলা সংকট যেন আরও তীব্রতর রূপ ধারণ করে। চলমান এ যুদ্ধ ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে, যা আবাসন খাত সহ অন্যান্য শিল্পখাতের গতিকেও স্থির করে তুলেছে।   

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক সপ্তাহ পর, রডের দাম প্রতি টন বাবদ হয় ৬,০০০ – ৭,০০০ টাকা, আমদানি করা পাথর ৩,০০০ টাকা থেকে বেড়ে হয় ৪,০০০ টাকা এবং প্রতি ৫০ কেজি সিমেন্টে ৫০ টাকা করে দাম বৃদ্ধি পায়। 

কাঁচামালের এই অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির ফলে শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাটের দাম ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি ২০২১ ও ২০২২ সালে বিক্রি হওয়া প্রায় ৫০% ফ্ল্যাটের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রপার্টির সামগ্রিক মূল্যও বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় যারা নতুন করে নির্মিত প্রপার্টি কিনতে ইচ্ছুক ছিলেন, তারা মূল্যবৃদ্ধির ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছুটা দ্বিধাদন্দের মধ্যেই পড়ে যান।     

সেকেন্ডারি প্রপার্টি মার্কেট এর চাহিদা বৃদ্ধি 

সেকেন্ডারি প্রপার্টি
বাড়ি নির্মাণের বদলে সেকেন্ডারি প্রপার্টি কেনার ক্ষেত্রে চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ

প্রপার্টির মূল্য হঠাৎ করে বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের আবাসন খাতের জন্য এটি মোকাবেলা করা বেশ বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। বিশেষ করে মধ্যম আয়ের মানুষদের জন্য যারা নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ সঞ্চয় করে আসছেন বাড়ি বানানোর জন্য বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, তাদের জন্য কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির এই ধাক্কা যেন সামলে ওঠা বেশ কঠিন এক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। 

ফলাফলে নতুন করে বাড়ি নির্মাণের বদলে সেকেন্ডারি প্রপার্টি কেনার ক্ষেত্রে চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। কেননা, সঞ্চয় করা একই পরিমাণ অর্থ দিয়ে যেখানে বাড়ি নির্মাণ প্রায় অনিশ্চিত ছিল, সেখানে তারা দ্রুত সময়ে সেকেন্ডারি প্রপার্টির মালিক হতে পারছেন। আর এ কারণেই সেকেন্ডারি প্রপার্টি মার্কেট এর চাহিদা বৃদ্ধি পায় উল্লেখযোগ্য হারে। বিপ্রপার্টির ডাটাবেজ অনুযায়ী, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সেকেন্ডারি প্রপার্টি বিষয়ে গ্রাহকদের অনুসন্ধান প্রায় ১৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। 

বিল্ডিং কন্সট্রাকশন রুল – ২০২১ 

বিল্ডিং কন্সট্রাকশন রুল
বিল্ডিং কন্সট্রাকশন রুল- ২০২১- এ বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়

লক্ষ্য করার মতো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিল্ডিং কন্সট্রাকশন রুলস ২০২১ এর ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান ২০১৬-২০৩৫ বা ড্যাপ এর প্রস্তাবনা সমূহ। বিশেষজ্ঞদের মতে নতুন এই নিয়ম সমূহ শুধু বিতর্কিতই নয়, বরং আবাসন খাতের জন্য বেশ ধ্বংসাত্মকও বটে। তবে নতুন এ নিয়ম সমূহ যদি চূড়ান্ত করা হয়, সেক্ষেত্রে ক্রেতা এবং প্রপার্টি ব্যবসায়ের উপর এর প্রভাব তো পড়বেই, সাথে প্রপার্টির মূল্যও বৃদ্ধি করে দিবে কয়েক গুণ।

পূর্ববর্তী সময়ে, ২০ ফিট রাস্তার পাশে ৫ কাঠা জমিতে ১৩,৫০০ বর্গফুট জায়গার উপর আপনি খুব সহজেই একটি 8 তলা বিল্ডিং নির্মাণ করে বসবাস করতে পারতেন। তবে প্রস্তাবিত বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন রুলস ২০২১ অনুযায়ী, একই জায়গাতে এখন আপনি শুধুমাত্র ৯,০০০ বর্গফুটের উপর বাড়ি নির্মাণ করতে পারবেন।

বিগত কয়েক বছর ধরে আবাসন খাতকে সচল রাখার জন্য বেশ কিছু ধারাবাহিক উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশের আবাসন খাতকে স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৩টি বিষয় হল- করবিহীন আয় বিনিয়োগের অনুমতি, একক-সংখ্যার সুদের হার বাস্তবায়ন এবং সামগ্রিকভাবে প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশনের খরচ ১৪-১৫% থেকে কমিয়ে মোট দলিল মূল্যের ১০-১১.৫% করা। 

তবে এ সকল বিষয়ের সাথে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আবাসন খাত -এ কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং রেগুলেটরি পলিসির কারণে রিয়েল এস্টেট মার্কেট বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। যদিও ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেটের মাধ্যমে, আমরা কেবল আবাসন খাতের ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাবাদী হতে পারি। 

Write A Comment

Author