Reading Time: 4 minutes

বৃহত্তর বঙ্গপ্লাবন ভূমির অংশ রংপুর। উত্তরাঞ্চলের এ জেলায় নদী, সমতল ভূমি মিলিয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। রংপুরের প্রিয় বিষয়গুলো  নিয়েই আমাদের আজকের ব্লগ। আমার প্রিয় জেলা সিরিজের আগের পর্বগুলোতে পড়তে পারেন ঢাকা, রাজশাহী, সিলেটখুলনার প্রিয় বিষয়গুলো সম্পর্ক। 

রংপুরের জীবনযাত্রা 

রংপুর
পূর্বের ‘রঙ্গপুর’ থেকেই কালক্রমে ‘রংপুর’ নামটি এসেছে। ছবিঃ উইকিপিডিয়া 

কোনো স্থানকে ভালোভাবে জানতে হলে, সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা জানতে হয় সবার আগে। রংপুরবাসীর মধ্যে পরিশ্রমী, কর্মঠ ভাব বেশ লক্ষণীয়, যা রংপুরের প্রিয় বিষয়গুলো এর মধ্যে একটি। দীর্ঘদিন মঙ্গা পীড়িত ছিলো এ জেলা। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে পূর্বের ‘রঙ্গপুর’ থেকেই কালক্রমে ‘রংপুর’ নামটি এসেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে উপমহাদেশে ইংরেজরা নীলের চাষ শুরু করে। এই অঞ্চলে মাটি উর্বর হবার কারণে এখানে প্রচুর নীলের চাষ হত। সেই নীলকে স্থানীয় লোকজন রঙ্গ নামেই জানত। কালের বিবর্তনে সেই রঙ্গ থেকে রঙ্গপুর এবং তা থেকেই আজকের রংপুর। অপর একটি প্রচলিত ধারণা থেকে জানা যায় যে রংপুর জেলার পূর্বনাম রঙ্গপুর। প্রাগ জ্যোতিস্বর নরের পুত্র ভগদত্তের রঙ্গমহল এর নামকরণ থেকে এই রঙ্গপুর নামটি আসে। রংপুর জেলার অপর নাম জঙ্গপুর । ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব থাকায় কেউ কেউ এই জেলাকে যমপুর বলেও ডাকত। তবে রংপুর জেলা সুদুর অতীত থেকে আন্দোলন প্রতিরোধের মূল ঘাঁটি ছিল। তাই জঙ্গপুর নামকেই রংপুরের আদি নাম হিসেবে ধরা হয়। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, পুর অর্থ নগর বা শহর। গ্রাম থেকে আগত মানুষ প্রায়ই ইংরেজদের অত্যাচারে নিহত হত বা ম্যালেরিয়ায় মারা যেত। তাই সাধারণ মানুষ শহরে আসতে ভয় পেত। সুদুর অতীতে রংপুর জেলা যে রণভূমি ছিল তা সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায়। ত্রিশের দশকের শেষ ভাগে এ জেলায় কৃষক আন্দোলন যে ভাবে বিকাশ লাভ করে ছিল তার কারণে রংপুরকে লাল রংপুর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।ফলে প্রকৃতির প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করার নীতি, বিপ্লবের সাহস তাদের মজ্জাগত।

এই জেলার বেশিরভাগ মানুষ এখন চাকরিজীবি।তবে কৃষিকাজের সাথেও জড়িত রংপুরের অধিবাসীদের মধ্যে অনেকেই।বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানে নানা শ্রেণী-ধর্ম-পেশার মানুষ একত্রে বাস করে। 

রংপুরের যাতায়াত  

রংপুরের প্রিয় বিষয়গুলো এর তালিকায় এর যাতায়াত ব্যবস্থা থাকবেই। ঢাকা থেকে রংপুরে যাতায়াতের মাধ্যম দুইটি; বাস ও ট্রেন। বাসগুলো বেশ উন্নত, মানসম্পন্ন এবং আধুনিক। রাস্তাও মসৃণ ও মনোরম।নিকটবর্তী বিমানবন্দরটি সৈয়দপুর জেলায় অবস্থিত।সেখান থেকে রংপুরের দূরত্ব মাত্র ৪২ কি.মি.।রংপুরের সাথে উত্তরান্চলের অন্যান্য জেলাও বেশ ভালোভাবে বাস ও ট্রেনের মাধ্যমে সংযুক্ত। রংপুরগামী প্রতিটি ট্রেনেই পাবেন উন্নত সেবা।  রংপুর জেলার ভেতরের রাস্তাও আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো। শহরে চলাচলের জন্য রয়েছে রিকশা ও সি এন জি চালিত অটোরিকশা। 

রংপুরে যা যা দেখবেন  

সুপ্রাচীনকাল থেকেই উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জনপদ রংপুরের রয়েছে গৌরবময় ও বৈচিত্র পূর্ণইতিহাস।রংপুরের মধ্যদিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাগট,যমুনা, ধরলা প্রভৃতি নদ-নদী। নদী তীরের প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ মনোরম। রংপুরের প্রিয় বিষয়গুলো এর কথা বলতে গেলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের এই পীঠস্থানগুলোর কথা না বললেই নয়!

রংপুর জেলায় ভ্রমণের জন্য উল্লেখযোগ্য স্থান তাজহাট জমিদারবাড়ি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় এটি নির্মাণ করেন।১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাসাদটি ব্যবহৃত হয় রংপুর হাইকোর্ট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একটি শাখা বা বেঞ্চ হিসেবে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা সদরে বাংলাদেশের হাই কোর্ট বিভাগের আঞ্চলিক বেঞ্চ স্থাপন করেন যার একটি রংপুরে স্থাপিত হয়েছিল। পরে, ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর এই পদ্ধতি তুলে দেয়া হয়। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রাসাদটিকে একটি সংরক্ষিত স্থাপনা তথা স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করে।

এছাড়া রয়েছে শাশ্বতবাংলা নামের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, রংপুরচিড়িয়াখানা ,মিঠাপুকুর তিনকাতারের মসজিদ, ইটাকুমারী জমিদারবাড়ি, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ,দেওয়ানবাড়ির জমিদারবাড়ি, বেগমরোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র, আনন্দনগর প্রভৃতি।

রংপুরের খাবার-দাবার  

রংপুর অঞ্চলের রয়েছে নিজস্ব কিছু খাবার। এর মধ্যে ‘সেঁদোল’ বা ‘সিঁদোল’ নামের একটি খাবার বেশ জনপ্রিয়। শুটকি মাছ দিয়ে তৈরি হয় বড়াজাতীয় এই খাবারটি।রংপুরের আরো একটি ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম হচ্ছে ‘শোলকা’। আঞ্চলিক এই খাবারটি পাট শাক আর সোডা দিয়ে রান্না করতে হয়। রংপুরের দই-মিষ্টিও বেশ সুস্বাদু। ঘোষ ভান্ডার ও পুষ্টি নামের মিষ্টির দোকানের সুখ্যাতি রয়েছে পুরো রংপুর জুড়ে।

বুঝতেই পারছেন, রংপুর জেলায় বেড়াতে গেলে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের কল্যাণে খাদ্যরসিকরা একেবারেই হতাশ হবেন না। আর রংপুরের প্রিয় বিষয়গুলো এর তালিকায় এ খাবার গুলোর কথা আসবেই।

রংপুরের নদী 

তিস্তা

রংপুরের প্রধান নদী তিস্তা। ছবিঃ উইকিপিডিয়া

নদী মাতৃক দেশের বৃহত্তর অংশ হিসাবে রংপুর  জেলায়ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নাম জানা ও না-জানা অসংখ্য ছোট বড় নদী। এ এলাকায় কৃষি ও অথনৈতিক ক্ষেত্রে এসব নদীর ভুমিকা অনস্বীকার্য । বৃহত্তর রংপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তা, ব্রহ্মপূত্র, যুমনা, ধরলা, ঘাঘট, দুধকুমার, প্রভৃতি নদী। রংপুরের নদ-নদীর আয়তন ৫শ ২৩ দশমিক ৬২ কিলোমিটার  বা ৩শ ২ বর্গমাইল।

রংপুরের প্রধান নদী তিস্তা। এটি ব্রহ্মপুত্রের একটি উপনদী। ভারতের উত্তর সিকিমের পার্বত্য এলাকায় এর উৎপত্তি।এছাড়া রয়েছে আখিরা নামের একটি ছোট নদী। রংপুর জেলা পীরগঞ্জ থানা এলাকা ও দিনাজপুর জেলা ঘোড়াঘাট থানা এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষের সময় জরুরী ভিত্তিতে খাদ্য সরবরাহের জন্য এ নদীর উৎপত্তি হয়।আকারে ও আকৃতিতে খালের মতো হলেও এ এলাকার জনজীবনে নদীটির ভুমিকা রয়েছে অনেক। 

তামাক শিল্পের রংপুর 

রংপুর অঞ্চলকে তামাকের জন্য বিখ্যাত বলা হয়। এখানে উৎপাদিত তামাক দিয়ে সারা দেশের চাহিদা মেটানো হয়। রংপুরে প্রচুর পরিমাণ ধান-পাট-আলু ও হাড়িভাঙ্গা আমও উৎপাদিত হয় এবং সম্মিলিত খামারও গড়ে উঠছে যা অর্থনীতিতে ব্যাপক হারে প্রভাব ফেলছে।

তবে রংপুরে তামাক চাষের আধিক্যের ফলে দেখা গেছে কিছু ক্ষতিকর দিকও। তামাক শিল্পে ব্যাপক লাভের জন্য প্রচুর আবাদী জমি কেবলমাত্র তামাক চাষেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

রংপুরের প্রিয় বিষয়গুলো  বলতে শুরু করলে আর শেষ হবে না। রংপুর মানে ছিমছাম প্রকৃতি আর নদীর কলতান। রংপুর মানে এক শান্ত, নিরিবিলি জনপদ; য আপনাকে মুগ্ধ করবে সহজেই।

Write A Comment