Reading Time: 6 minutes

স্কুলের দিনগুলোতে “মাই হবি” প্যারাগ্রাফ লিখতে গিয়ে “গার্ডেনিং” এর কথা লেখেনি এমন মানুষ বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্যারাগ্রাফ লিখতে গিয়ে নাকি নিছক শখ থেকে গাছ নামের এই সহজ-সবুজ প্রাণটির সাথে মনের অজান্তেই আমাদের ভালবাসা জন্মে, সে কথা বলা দুষ্কর। তবে ঢাকার মতো ব্যস্ততম যান্ত্রিক শহরে বিশাল পরিসরে গার্ডেনিং এর ভাবনা ভাবার সুযোগ না থাকলেও, সুযোগ রয়েছে ঘরের ভিতরে ছোট্ট একটা সবুজ পরিসর করে নেয়ার। আর ঠিক এখান থেকেই শুরু ইনডোর প্ল্যান্টের যত কথা!  

শহরে দেয়ালের গায়ে দেয়াল লেগে গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবন। তাই ঘরের মাঝে প্রচুর আলো-বাতাস প্রত্যাশা করাটা অতিরঞ্জিতই বটে। এমন ঘরে কিন্তু সব গাছ বেঁচে থাকতে পারে না। তবে বেশ কিছু গাছ রয়েছে যা স্বল্প আলোতেও ঘরের ভিতরেই টিকে থাকতে সক্ষম। বাকি গাছকে ছাপিয়ে তাই তারা ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ঢাকার বাসিন্দাদের আবাসে ও মননে।  আর জায়গা করবেই না কেন! প্রতিটি  ইনডোর প্ল্যান্টই এতো বেশি সুদর্শন! ঘরের নন্দনশৈলীতেই কেবল নয় ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখারও উপায় হিসেবেও তো জুড়ি নেই এদের।  ঢাকার আকাশচুম্বী ভবনগুলোর আধিক্য আর তীব্র যানজটে আপনি যখন হাঁসফাঁস করছেন, তখন কর্মব্যস্ত দিনের শেষে এই ইনডোর প্ল্যান্টগুলোই হয়ে উঠতে পারে আপনার সবুজসঙ্গী। তবে তার জন্য ওদের সাথে বাড়াতে হবে ঘনিষ্ঠতা, জানতে হবে কোন কোন ইনডোর প্ল্যান্ট আপনার ঘরের পরিবেশের সাথে ঠিক ঠাক খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। এবার তবে ধাপে ধাপে ইনডোর প্ল্যান্টের যত্নআত্তি ও তার রকমফের নিয়ে জানার পালা! 

ইনডোর প্ল্যান্ট ও প্ল্যান্টার

ছোট বড় রঙিন সব প্ল্যান্টার থেকে পছন্দ মতো খুঁজে নিতে পারেন যে কোনোটি

ছায়ায় বেঁচে থাকে, ঘরের ভিতরে টবে লাগানো যায, এমন গাছগুলোই মূলত ইনডোর প্ল্যান্টস। ঘরোয়া এই গাছগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তার তালিকায় কিন্তু বিভিন্ন প্রজাতির ফিলাডেনড্রন, প্যাথোস, পিস লিলি, স্নেক প্ল্যান্ট, মনস্টেরা, ক্যাকটাস, বিভিন্ন প্রকার অর্কিড এবং ফার্ন ইত্যাদিই এগিয়ে। সুদর্শন এই গাছগুলোর জন্য ঘরের সাথে মানানসই টব বা প্ল্যান্টার বেছে নেয়াটাও কঠিন কোনো কাজ নয়। যারা ঘরের সবকিছুতেই  মিনিমালিস্টিক ছাপ রাখতে  চান, তারা চোখ বন্ধ করে সিরামিক প্ল্যান্টারগুলো কিনে নিতে পারেন। যারা ঘরের সাজে বাঙালিয়ানা চান তাদের জন্য মাটির টবের চেয়ে ভালো বিকল্প আর কী হতে পারে! আর যদি ঘরের সাজে রাস্টিক ডেকোরকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে ঝুঁকতে হবে কাঠ অথবা সিমেন্টে তৈরি রাস্টিক লুকের টবের দিকে। এছাড়াও অনলাইনে বিভিন্ন উপকরণে তৈরি গোলাকার, চতুষ্কোণ কিংবা ডায়মন্ড আকৃতির ছোট বড় রঙিন সব প্ল্যান্টার পাওয়া যায় । পছন্দ মতো খুঁজে নিতে পারেন যে কোনোটি। তবে যে ধরণের টবেই গাছ লাগান না কেন, টবের সাইজ নির্ধারণে গাছের সাইজকে প্রাধান্য দিন। ছোট গাছ হয়তো আপনি ছোট টবেই লাগাবেন। তবে একটু একটু করে বড় হয়ে গেলে তখন ওর প্রয়োজন আকার অনুপাতে বড় টবের। এক্ষেত্রে আরেকটু বড় সাইজের টবে রিপটিং করাটাও কিন্তু ইনডোর প্ল্যান্টের যত্নআত্তিরই অংশ।   

ফিলাডেনড্রন ও প্যাথোস

আমাদের দেশে মানিপ্ল্যান্টই ওর আদুরে নাম

ডেভিলস আইভি বলেও ডাকা হয় গাছটিকে। তবে, আমাদের দেশে মানিপ্ল্যান্টই ওর আদুরে নাম। প্রায় ৫০০টি প্রজাতি রয়েছে এদের। আদি নিবাস আমেরিকার উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে হওয়ায়, এই গাছগুলো খানিক নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পছন্দ করে। ঘরোয়া পরিবেশে ১৫-১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সবচেয়ে সাচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠে এরা। অভিযোজন ক্ষমতাও চমৎকার। সামান্য অংশ ছিঁড়ে মাটিতে লাগিয়ে দিলেই হল, তরতর করে বেড়ে উঠবে অনায়াসে। ছোট কাঁচের গ্লাস থেকে শুরু করে যে কোনো কিছুর মধ্যই এই গাছ লাগানো যায়। ছায়ায় রাখলে ফিলোডেনড্রনের রঙ সবুজ থাকে, আর রোদে রাখলে হলুদ। তবে যে আবহাওয়ায়ই রাখুন মাটি সবসময় ভেজা রাখা চাই। এক্ষেত্রে টবের আকার অনুযায়ী পানি দিতে হবে নিয়মিত। যত্নে থাকলে ঘরের ভিতরেই এরা ২০মিটার অব্দি লম্বা হতে পারে। তবে ফিলাডেনড্রন আর প্যাথোসের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিকটি হচ্ছে এরা পানির মধ্যেও চমৎকার টিকে থাকে। তাই অনেকেই পছন্দ করেন স্বচ্ছ পানির পাত্রে একে রাখতে। গাছের শিকড়েরও যে অদ্ভূত সৌন্দর্য আছে, তা বুঝা যায় কাঁচের স্বচ্ছ পাত্রে রাখা ফিলাডেনড্রন বা প্যাথোস এর দিকে নজর দিলে! 

স্নেক প্ল্যান্ট

ঘরের বাতাস পরিশোধনে বাড়তি খ্যাতি আছে স্নেকপ্ল্যান্টের

নাম শুনে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই! স্নেক প্ল্যান্ট বিষধর সাপের মত ক্ষতিকারক তো একেবারেই নয় বরঞ্চ, উপকারী একটি ডিটক্সিফায়ার। বাতাসে ভেসে বেড়ানো ৫টি প্রধান বিষাক্ত উপাদানের ভেতর ৪টিকে এরা শোধন করতে পারে। তাই ঘরের বাতাস পরিশোধনে বাড়তি খ্যাতি আছে স্নেকপ্ল্যান্টের। লম্বা ও শক্তপোক্ত ফ্যাকাশে সবুজ পাতায় গাঢ় বা কালচে সবুজের প্যাটার্ন দেখলেই গাছটির নামকরণের সার্থকতাও টের পাওয়া যায়। এই প্ল্যান্টটির আদি নিবাস দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলবর্তী অঞ্চলে। বাকি ইনডোর প্ল্যান্টের মত অতোটা মনোযোগী হবার প্রয়োজন নেই এদের জন্য। অনাদরেও ওরা সুন্দরভাবে টিকে থাকে। পানি দেয়ার প্রয়োজন তখনই পড়ে, যখন মাটি শুকিয়ে যায়। আর শীতকালে তো মাসে একবার পানি দিলেই ওরা দিব্যি বেঁচে থাকে। লিভিং রুমের কোণায় বা ডাইনিং স্পেসের কাছে দু একটা স্ন্যাক প্ল্যান্ট রেখে দিলে মন্দ হয় না। 

এলোকেশিয়া

প্রতি কাণ্ডে মাত্র একটি করেই পাতা আর তাতে সামুদ্রিক স্টিং রে এর জালের মত বিস্তৃত প্যাটার্ন আছে  এলোকেশিয়ায়

ভীষণ অভিমানী এই গাছটিকে একটুখানি অবহেলা করেই দেখুন! অভিমানে মুষড়ে পড়তে সময় নেবে না এতটুকুও! তবে তিনি এতোটাই সুদর্শন যে, ইনডোর প্ল্যান্টের যত্নআত্তি তে তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেও বাড়াবাড়ি হবে না।  প্রতি কাণ্ডে মাত্র একটি করেই পাতা আর তাতে সামুদ্রিক স্টিং রে এর জালের মত বিস্তৃত প্যাটার্ন!  ঘরোয়া এই গাছটিকে বাংলায় এলোকেশী বলে ডাকলে কি বিশেষ ক্ষতি হবে? যত্নআত্তির বেলায় কিন্তু গাছের গোড়ার পর্যাপ্ত পানি দেয়াতেই তিনি তুষ্ট হচ্ছেন না। সাথে সাথে দু-চার বেলা পাতাতেও পানি স্প্রে করতে হবে তাকে খুশি রাখতে।  

অর্কিড

নানা বর্ণের ফুলগুলো কয়েকমাস ধরে ফুটে থাকে বলেই ইনডোর প্ল্যান্টের মধ্যে বাড়তি চাহিদা আছে অর্কিডের

ঘরোয়া গাছের তালিকায় ফুল গাছ থাকবে না তা কী করে হয়! ঘরোয়া বাগানীদের অনেকেরই  অর্কিডের প্রতি থাকে বিশেষ দূর্বলতা। নানা বর্ণের ফুলগুলো কয়েকমাস ধরে ফুটে থাকে বলেই বোধ হয় বাগানীদের ইনডোর প্ল্যান্টের মধ্যে বাড়তি চাহিদা আছে অর্কিডের। ঝুলন্ত টবে সবচেয়ে সুন্দর দেখায় অর্কিড। কম আলো, আর্দ্রতা বেশি পায়, ঘরের এমন জায়গাকেই বেছে নিন এদের থাকার জায়গা হিসেবে। তারপর মাটি শুকালে পানি দিলেই হলো। এর বেশি যত্নআত্তি দরকার নেই গাছটির। 

পিস লিলি

সাদা রঙের ফুলগুলো তার নামের মতই প্রশান্তি ছড়ায় ঘরজুড়ে

প্রায় ৪০টি ভিন্ন প্রজাতি পাওয়া যায় এই ফুল গাছটির। সাদা রঙের ফুলগুলো তার নামের মতই প্রশান্তি ছড়ায় ঘরজুড়ে। পিসলিলিরা স্বভাবে ছায়াপ্রিয়, তাই সরাসরি সূর্যের আলো আসে এমন স্থান এড়িয়ে ঘরের ছায়াযুক্ত স্থানেই রাখা ভালো। মাটি শুকিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত পানি দেয়ার প্রয়োজন নেই ওদের। সপ্তাহান্তে একবার পানি দিলেই চলে।

প্রেয়ার প্ল্যান্ট 

একটু রোদহীন, অথচ আলো আসে এমন আর্দ্র পরিবেশই ওদের বেশি প্রিয়

প্রেয়ার প্ল্যান্টও রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির। এর বিশেষত্ব হচ্ছে সকাল বেলা পাতাগুলো ছড়িয়ে থাকে আর রাতে পাতাগুলো দুই পাশ থেকে গুটিয়ে আসে খানিকটা প্রার্থনার করার মত। আবার সকাল হলে ছড়িয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসে। এজন্যই আদর করে এদেরকে ডাকা হয় প্রেয়ার প্ল্যান্ট। এবার আসি কৌতূহলে পূর্ণ এই ইনডোর প্ল্যান্টের যত্নআত্মির কথায়! গাছটিকে রোদে রাখা যাবে না মোটেই। নয়তো পাতা পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে গাছটির সজীবতা ধরে রাখতে জানালার কাঁচের পাশে বা ছায়াযুক্ত স্থানে হালকা রোদ লাগানো যায়। তবে সেটাও রাখতে হবে অল্প সময়ের জন্য। পাতা যদি মরে যায় সেক্ষেত্রে ধারালো কাঁচি দিয়ে ছেঁটে দিলেই হলো। একটু রোদহীন, অথচ আলো আসে এমন আর্দ্র পরিবেশই ওদের বেশি প্রিয়। 

ক্যাকটাস ও সাকিউল্যান্ট 

পাতার নানা বিচিত্র আকার এবং অপূর্ব বিন্যাসের জন্য বেশ জনপ্রিয় এই গাছগুলো

ঘরের মধ্যে অল্প কয়েকটি ক্যাকটাস ও সাকিউলেন্ট বসানো ঝক্কির কাজ নয়। অল্প যত্ন-আত্তিতেই এই ধরণের গাছ ভালো থাকে। শুকনো মরুভূমি বা পাহাড়ি অঞ্চলের গাছ এরা। পাতা, কাণ্ড বা মূলে অসময়ের জন্য সঞ্চয় করা থাকে জল। পাতার নানা বিচিত্র আকার এবং অপূর্ব বিন্যাসের জন্য বেশ জনপ্রিয় এই গাছগুলো। চ্যাপ্টা ধরনের পাত্র সাকিউলেন্ট বসানোর জন্য উপযোগী। কারণ এই গাছের শিকড় খুব বেশি থাকে না। মাটির পাত্র হলে ভাল হয়। তাতে সহজে পানি বেরিয়ে যেতে পারে। 

সরাসরি মাটির চাইতে মাটি-বালি-পাথরের মিশ্রণই মরুর এই গাছগুলর জন্য উপযুক্ত। প্রতিদিন পানি না দিয়ে কয়েক দিন পরপর পানি দিন। ঘরে গাছ রাখলে ছিদ্রযুক্ত টবের নিচে ট্রে রাখুন। সেক্ষেত্রে পানি চুইয়ে মেঝে নোংরা হবে না।

যত্নআত্তির আরও কিছু দিক 

পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রবেশ করে সেই জায়গাকেই বেছে নিন ঘরের সবুজ প্রাঙ্গন হিসেবে

আপনার মাত্রাতিরিক্ত যত্ন কিন্তু আপনার প্রিয় ইনডোর প্ল্যান্টের জন্য ভালো নাও হতে পারে। গাছে প্রয়োজন বুঝেই পানি দিন, তার চেয়ে বেশি নয়। এতে উল্টো গাছের গোড়ায় পানি জমে শেকড় পঁচে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় প্রতিটি প্ল্যান্টারেই কয়েকটি করে ড্রেনেজ হোল তৈরি করে নেয়া, যাতে বাড়তি পানি বেরিয়ে যেতে পারে। যে ঘরে আলো-বাতাস চলাচল করে, সেখানেই গাছ রাখুন। গাছ আর্দ্রতা বা ছায়া পছন্দ করে জেনেই তাকে অন্ধকার ঘরে রাখবেন না। ঘরের যে জায়গায় খুব বেশি রোদ আসে না, কিন্তু পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রবেশ করে সেই জায়গাকেই বেছে নিন আপনার ঘরের সবুজ প্রাঙ্গন হিসেবে।  

ইনডোর প্ল্যান্ট মানেই কেবল শৈশবের গল্প থেকে লালিত কোনো শখ, কিংবা শহরের কোলাহল থেকে মুক্ত হতে স্বস্তির একমাত্র সবুজ পরিসর নয়। শহুরে জীবনে ব্যালকনির গল্পগুলোতেও ইনডোর প্ল্যান্টের ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা রয়েছে হোম ডেকোরে সবুজ বৈচিত্র্য যোগ করতে। আপনিও কী ঘরোয়া বাগানী? ইনডোর প্ল্যান্টের যত্নআত্তি ছাড়া যার দিনের প্রথম ভাগটা শুরুই হয় না! তাহলে, কমেন্টে জানিয়ে দিন আপনার ঘরে জায়গা করে নিয়েছে কোন কোন ইনডোর প্ল্যান্ট?  জানিয়ে দিন আপনি কীভাবে যত্ন নিচ্ছেন আপনার ঘরের সবুজ সঙ্গীদের! 

Write A Comment

Author