Reading Time: 3 minutes

শতবর্ষী পুরানো এ ঢাকায় এলাকা এবং ভিন্ন ভিন্ন এলাকার নামের কোন অভাব নেই। আর প্রায় সব ঢাকাই এলাকার নামেই পেছনেই রয়েছে না জানা নানান কাহিনী। ঢাকাই নামের ইতিকথার প্রথম পর্বে আমরা জেনেছি গেন্ডারিয়া, ধানমন্ডি, শাহবাগ সহ কয়েকটি এলাকার নামকরণের কাহিনী। দ্বিতীয় পর্বে দেখেছি  কীভাবে এল ফার্মগেট, আসাদগেট, পিলখানা বা ভূতের গলির নাম। আজ ঢাকাই নামের ইতিকথার শেষ পর্বে আমরা দেখব মালিবাগ, কাকরাইল, ওয়ারী, ভূতের গলি এবং গুলিস্তান এলাকার নামকরণের ইতিহাস।

মালিবাগ

বাগানের শহর ঢাকার মালিরা থাকতেন যেখানে

আরামবাগ, রাজারবাগ, সেগুনবাগিচা, শাহবাগ, পরীবাগ। নাম শুনে আন্দাজ করা যায় এই ঢাকা শহরে একসময় বাগানের কোন অভাব ছিল না। বরং বাগান বা বাগিচা ছিল বিত্তশালীদের অর্থ-বিত্ত প্রদর্শনের অন্যতম উপায়।  বিত্তশালীরা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যও বড় বড় ফুলের বাগান করতেন। এজন্যই প্রাচীনকালের ঢাকা ছিল আক্ষরিক অর্থেই “বাগানের শহর”।

যে পেশার চাহিদা থাকে সে পেশাজীবী মানুষের কদরও থাকে আলাদা। আর তাই, সে সময়ে ঢাকা শহরে বিপুল চাহিদা ছিল বাগানের পরিচর্যাকারী মালীদের। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বাগান থাকার কারণেই এই চাহিদা তৈরি হয়েছিল। তারা যে শুধু বাগানের পরিচর্যাই করতেন তা নয়, বরং বিভিন্ন প্রয়োজনে ফুল সরবরাহও করতেন তারাই। আর মালীরা যে এলাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন, কালের বিবর্তনে সেই এলাকার নামই হয়ে গিয়েছে মালিবাগ। 

বাগানসহ ডাকার সেই পূরোনো জৌলুস আজ আর নেই। নেই মালীরাও। কিন্তু শত বাগান আর হাজারো মালীর স্মৃতি নিয়ে এলাকার নাম আজও আছে মালিবাগ!

টিকাটুলি  

হুক্কার “টিকিয়া” থেকে টিকাটুলি

কাগজীটোলা, পানিটোলা বা সুক্কাটুলি, ঢাকার বিভিন্ন জায়গার নামের শেষে টুলি বা টোলা দেখতে পাওয়া যায়। মূলত একই পেশাজীবী মানুষ কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস শুরু করলে সেই পেশার শেষে টুলি বা টোলা যুক্ত হয়ে সেটিই এলাকার নাম হয়ে দাঁড়াত।

অনেক আগে থেকেই ঢাকাবাসীদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল, দক্ষতা আর শিল্পনৈপুণ্য দিয়ে তারা নিতান্ত সাধারণ বস্তুকেও অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতেন। টিকাটুলি নামটি এসেছে এমনই এক নিতান্ত সাধারণ বস্তু থেকে। 

পর্তুগীজরাই প্রথম উপমহাদেশের মানুষকে তামাক পাতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর থেকে মোগল আমল হোক, ইংরেজ কিংবা হাল আমলেও তামাক পাতার কদর কমেনি। তো, প্রাচীনকালে তামাক সেবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় ছিল হুকা বা কল্কেতে করে। আর কল্কেতে তামাক সাজানোর পর তাতে আগুন ধরানোর জন্য ব্যবহৃত হত যে বস্তুটি তার নাম “টিকিয়া”। এই টিকিয়া ছিল কয়লার গুঁড়ো দিয়ে মার্বেলের মতো গোলাকৃতি করে বানানো এক রকমের জিনিস।  টিকিয়া তৈরির কারিগরেরা প্রাচীনকালে যে এলাকায় বাস করত, “টুলি বা টোলা” তত্ত্ব মেনে সেই এলাকার নামই হয়ে যায় টিকাটুলি। টিকাটুলির এই কারিগররা অতি নগণ্য টিকিয়াকে অসাধারণ শিল্পে রূপান্তরিত করেছিলো। তাদের তৈরি টিকিয়ার কোনো তুলনা সমগ্র উপমহাদেশে ছিল না।

অর্থ্যাৎ টিকাটুলির “টিকা” হল কল্কেতে আগুন দিতে যে ব্যবহৃত হত সেই টিকিয়ার বিকৃতরূপ।

কাকরাইল 

ককেরেল সাহেবের এলাকা

কাকরাইল নাম শুনে কেউ যদি একে কাঁকড়ার সাথে মিলিয়ে ফেলেন তবে তিনি বড় ভুল করবেন। কেননা কাকরাইলের সাথে কাঁকড়ার কোন সম্পর্কই নেই!

বরং ঢাকায় দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনের সাক্ষ্য বহন করছে যে অনেকগুলো ঢাকাই এলাকার নাম, কাকরাইল তাদের মধ্যে একটি। 

ঢাকায় ককেরেল (Cockerell) নামে একজন ব্রিটিশ কমিশনার ছিলেন ১৯ শতকের শেষ দিকে।  ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের মতে, যেহেতু কূটনীতিকদের নামানুসারে ঢাকার সড়কের নামকরণ হত প্রায়শই, তাই ককেরেল সাহেবের নামানুসারে একটি রাস্তার নামকরণ করা ছিল খুবই সম্ভব। আর পরবর্তীতে এই রাস্তার আশেপাশের এলাকাই মানুষের মুখে মুখে ককেরেল থেকে হয়ে উঠে “কাকরাইল”!

ওয়ারী

মিস্টার ওয়্যারের নামেই ওয়ারী

বৃটিশ শাসনের আরও একটি নিদর্শন রয়ে গিয়েছে রাজধানীর এলাকা “ওয়ারী” নামের মধ্য দিয়ে। 

পুরান ঢাকার চকবাজার, বাংলাবাজার, নবাবপুর ইত্যাদি এলাকায় সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপন হলে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলের শেষদিকে এসে উদ্যোগ গৃহীত হয় একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা নির্মাণের। এ উদ্দেশ্যে সেসময় কাছেই থাকা জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাকে  কেন্দ্র করে এই নগর গঠনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ১৮৮৪ সালে ঢাকার রাজস্ব প্রশাসক বা ডিসট্রিক্ট কালেক্টরের নাম ছিল ফ্রেডরিক ওয়্যার। তিনিই মূলত কয়েকভাগে ভাগ করে পুরো এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু করেন। যে ফ্রেডরিক ওয়্যার আজকের ওয়ারীর এলাকার গোড়াপত্তন করেছিলেন, তার নামেই এই ঢাকাই এলাকার নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

গুলিস্তান  

বিখ্যাত সিনেমা হলের নামে এলাকার নাম

গুলিস্তান, নাম বললে যে কেউ চিনবে এক নামে। অথচ ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিংয়ের তালিকায় গুলিস্তান নামের কোনো জায়গায় নাম নেই। বরং এ এলাকার কেতাবী নাম বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। কিন্তু গুলিস্তান নামটি তাহলে কীভাবে আসল?

আদতে গুলিস্তান ছিল একটি সিনেমাহলের নাম। এই সিনেমাহলটি রমনার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উত্তরে, ঢাকা জেলা ক্রীড়া মিলনায়তন এবং পল্টন মাঠের পাশে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কলকাতার বিখ্যাত চিত্র ব্যবসায়ী ছিলেন খান বাহাদুর ফজল আহমেদ দোশানি। তিনি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর হাত ধরেই পরবর্তীতে এই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করা হয়। 

দেশের প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই হলটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে মানুষজন এই হলের নামেই এলাকাকে ডাকতে থাকে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে পরিবর্তিত অবস্থায় দোশানি পাকিস্তানে চলে যান। ফলে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি গুলিস্তান সিনেমা হল পরিণত হয় পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে। যা পরবর্তীতে দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দিয়ে দেয়া হয়।

গুলিস্তান শব্দটির শাব্দিক অর্থ “ফুলের বাগান”। আজকের গুলিস্তানে ফুলের বাগান কিংবা সেই সিনেমা হল, কোনটিই নেই। কিন্তু  মানুষের মুখে মুখে নামটি রয়ে গিয়েছে এত বছর পরেও।

শেষের আগে

খুব কম এলাকার নামকরণের ইতিহাস নিয়েই সবসময় শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়। বরং মানুষের মুখে প্রচলিত বিভিন্ন ঘটনা, নামকরণের কারণ, নামের সাথে বিষয়াদির মিল নিজস্ব বিবেচনার মত নানা জিনিস থেকেই ধারণা করে নিতে হয় কোন ঢাকাই এলাকার নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে।
তাই ইন্টারনেটের বিভিন্ন সোর্স এবং বিভিন্ন শ্রদ্ধেয় লেখকের লেখা বই থেকেই মূলত আমাদের তথ্যগুলো সংগৃহীত হয়। যেমন বইয়ের কথা বললে নির্দিষ্টভাবে মুনতাসীর মামুন তাঁর “স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী” বইতে নানা তথ্যের আলোকপাত করেছেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা নিজে খুব চমৎকার আলোচনা আছে এই বইটিতে। আপনি চাইলেই পড়ে ফেলতে পারেন। এছাড়া অনলাইনেও মিলবে অসংখ্য তথ্যের খোঁজ। 

ঢাকাই এলাকার নামের উৎসের খোঁজে আমাদের প্রচেষ্টার তৃতীয় এবং শেষ কিস্তি ছিল এটি। কোন তথ্য বিভ্রাট থাকলে কিংবা নতুন কোন নামের উৎস সম্পর্কে আপনার জানা থাকলে তা আমাদের মন্তব্যের ঘরে জানান। লেখাগুলো কেমন লাগলো তা জানাতেও ভুলবেন না যেন! 

Write A Comment