Reading Time: 5 minutes

ঢাকা, স্বপ্নের নগরী। এর আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। কিন্তু আজকের ইট কাঠ পাথরের জঞ্জালে ভরা ঢাকা শহরকে দেখে অনেকেই ভুল করেন এর প্রকৃত বয়স বুঝতে। আজকের এই ঢাকা কিন্তু একদিনে আসেনি। হ্যা, অল্প কিছুদিন হল প্রায় অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে ঢাকা, এর বিস্তৃতি বেড়েছে ব্যাপকহারে। কিন্তু ঢাকার আবাসন ইতিহাস কিন্তু একদিনের নয়। বরং, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু নদের তীরে মানুষের বাস। আজ থেকে প্রায় ১৩০০ বছর আগে, সেই ৭ম শতাব্দীতে এখানে মানুষের বসবাসের অস্তিত্ব জানা যায়। যদিও প্রথম দিকে এর ব্যাপ্তি বা প্রসার ছিল খুবই ধীর। সবুজ শ্যামলা, বনে ঘেরা ঢাকা আজ কল্পনা করাও কঠিন। ১৬০০ সালে মোগল, পরবর্তীতে ইংরেজদের শাসন, ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানি আমল, এরপর স্বাধীনতা পরবর্তী যুগ এবং হালের মেগাসিটি ঢাকা, কীভাবে হল এসব? ছোট স্কেলে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেছি আমরা। চলুন শুরু করা যাক

মোগল আমলে ঢাকার উত্থান

Development of Dhaka as a city
মোগল আমল থেকেই ঢাকার ঢাকা হওয়া শুরু

৭০০ সালের দিকেও লোকালয়ের খোঁজ পাওয়া গেলেও, মূলত মোগল আমলেই এই ঢাকা এলাকার গুরুত্ব বেড়ে যায় অনেক। বহু প্রচেষ্টার পর ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমদিকে, ইসলাম খাঁর (শেখ আলাউদ্দিন চিশতি) বাংলা দখলের মাধ্যমে মোগল সাম্রাজ্য বাংলায় বিস্তার লাভ করে। ইসলাম খাঁ মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে ঢাকাকে বাংলা প্রদেশের রাজধানী নির্ধারন করেন এবং তখন থেকেই মূলত ঢাকার সম্প্রসারণের প্রথম ধাপ শুরু হয়। 

মোগল আমলে যখন বাংলার রাজধানী হিসাবে ঢাকাকে নির্ধারণ করা হয়, এর গ্রোথ শুরু হয় তখন থেকেই। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আসতে শুরু করে ঢাকার দিকে, হোক তা ব্যবসা বাণিজ্য কিংবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। যেহেতু নতুন রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল, তাই অবকাঠামোগত বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়। আজকে ঢাকার যে এলাকা পুরান ঢাকা নামে পরিচিত, সেটিই মোগল আমলে ছিল ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। লম্বায় ২০ কিলোমিটার এবং আড়াআড়ি প্রায় ১২ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে ছিল তখনকার ঢাকা। সেসময় এখানে প্রায় ১০ লাখ লোক বাস করত বলে ধারণা করা হয়। এছাড়াও আলাদা প্রশাসনিক এলাকা ঢাকার বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে।

কিছুদিন আগেও পুরান ঢাকায় যে কেন্দ্রীয় কারাগার ছিল, মোগল আমলে তা আসলে ছিল একটি দুর্গ। এই দুর্গকে কেন্দ্র করেই মোগল আমলে ঢাকার বিস্তার হয়। ঢাকার আবাসন ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, এই দূর্গ থেকেই পশ্চিম দিকে সরাই বেগমপুর আর উত্তর দিকে বাদশাহী-বাগ পর্যন্ত ঢাকা বিস্তৃত হয়ে পরে। যেহেতু তখন সম্পূর্ণ ঢাকাই ছিল নদীবিধৌত, তাই নদীর পারের এলাকাগুলোই ছিল সবচেয়ে দামী এলাকা। তাই সবচেয়ে বিত্তবান লোকেদেরই স্থান হত এসব এলাকায়। বকশিবাজার, রহমতগঞ্জ, চৌধুরি বাজার ছিল এমন এলাকা। অন্যদিকে, তেজগাঁওয়ের দিকে অনেক ইউরোপিয়ান বাংলোর দেখা পাওয়া যেত, কারণ এখানে ছিল বেশ কিছু শিল্প কারখানা। 

ব্রিটিশ কলোনিয়াল পিরিয়ড

Growth of Dhaka as a important city in the empire
বৃটিশ আমলের স্থাপথ্য শিল্পের বেশ কিছু নিদর্শন আছে ঢাকায়

মোগল আমলের পর বেশ অনেকদিন ঢাকা তাঁর জৌলুশ হারিয়ে ফেলে। আকার এবং জনসংখ্যা, উভয় দিক থেকেই ঢাকা ছোট হয়ে আসে। কমতে কমতে মাত্র ২১ বর্গকিলোমিটার এবং প্রায় ৫০ হাজার মানুষের এলাকায় পরিণত হয় ঢাকা। তবে উনিশ শতকের মধ্যভাগে আবার ধীরে ধীরে ঢাকা গড়ে উঠতে শুরু করে ব্রিটিশ শাসকদের হাত ধরে। বৃটিশেরা ঢাকার বিস্তারের দিকে নজর না দিয়ে বরং একে একটি আধুনিক শহর হিসাবে গড়ার দিকে মনযোগী হয়। বিভিন্ন রাস্তাঘাট, খোলা জায়গা এবং পার্ক, রাস্তার বাতি এবং আলোকসজ্জা, বিশুদ্ধ পানির সাপ্লাই এবং সুরারেজ সিস্টেম তাদের সময়ে নির্মিত হয়। ভিক্টোরিয়া পার্ক, যা এখন বাহাদুর শাহ পার্ক নামে পরিচিত, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি পার্ক। এই পার্কটি এখনো দেশের অন্যতম সেরা পার্ক বলে বিবেচিত।

বৃটিশ আমলেই ঢাকা মিউনিসিপলিটি এবং ঢাকার বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ দুয়ের সম্মিলিত উদ্যোগে ঢাকার বেশ সম্প্রসারণ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছিল অপরিকল্পিত। এসময়েই ঢাকা সম্প্রসারিত হয়ে ফুলবাড়িয়া, নওয়াবপুর এবং চকবাজারের দিকে যায়। এসময় রমনা, শাহবাগ, পল্টন এবং কাকরাইল ছিল সবচেয়ে দামী এলাকা।

পূর্ব পাকিস্তান আমলে ঢাকার আবাসন ইতিহাস

Exapsion of the city to Motijheel area
মতিঝিল এলাকা হয়ে ওঠে রমরমা পাকিস্তান আমলেই

সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা ডিটিআই গঠিত হয় ১৯৫০ সালে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক ঢাকা শহরের বিস্তার করার উদ্দেশ্যে। দেশভাগের পর থেকেই মূলত জনসংখ্যার চাপে চিরেচ্যাপ্টা হতে শুরু করে ঢাকা শহর। এসময়েই অসংখ্যা নদীনালা ও খাল ভরাট বা বেদখল হয়ে যায়। ঢাকার বিস্তার সবসময়ই যেদিকে ফাঁকা এলাকা রয়েছে সেদিকেই গিয়েছে। তাই এসময়েও তাঁর ব্যতিক্রম হয় নি। মতিঝিল একসময় ছিল জলা-জংলায় ভরা নির্জন একটি এলাকা। কালেভাদ্রে এখানে মানুষের আনাগোনা ছিল। সেই এলাকা পাকিস্তানি আমলে এসে হয়ে উঠে ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র। প্রায় সকল অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানই ছিল মতিঝিল ভিত্তিক।

জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপের জন্য নতুন নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠতে শুরু করে। দেশের উচ্চবিত্তদের অনেকেই ধানমন্ডি এলাকার দিকে বসবাস শুরু করায় এটি সবচেয়ে দামি এলাকার একটিতে পরিণত হয়। এছাড়াও মিরপুর রোডের উন্নতি হওয়ায় মিরপুরে এবং মোহাম্মদপুর এলাকাতেও অনেক মানুষ বসবাস করতে আরম্ভ করে। সরকারও কিছু পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে গুলশান এবং বনানী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর পথ ধরেই স্বাধীনতা পরবর্তীযুগে ধীরে ধীরে উত্তরা বা বারিধারার মত পরিকল্পিত এলাকার বিকাশ ঘটে। শহরের উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত মানুষের আবাসিক এলাকা হিসেবে এগুলো গড়ে উঠতে থাকে পরবর্তিতে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ঢাকা

Expansion of Dhaka after independence
জাতীয় সংসদ ভবন নির্মিত হয় স্বাধীনতার পরেই

আয়তন এবং জনসংখ্যা, উভয় দিক দিয়েই ঢাকা এক বিশাল পরিবর্তন দেখে। পাকিস্তান আমলে গঠিত হওয়া ডিআইটির নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক। আবাসনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ঢাকার বেশিরভাগ ফাঁকা অঞ্চল যেখানে ছিল অনেক গাছপালা তা বিলীন হয়ে যায়। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উন্নয়ন প্রজেক্ট বেশ জোরেশোরে আরম্ভ হয় স্বাধীনতার পর। মালিবাগ, রামপুরা, মিরপুরের মত এলাকায় আরও বেশি বেশি মানুষ বাস করতে শুরু করে। বেশিরভাগ বিস্তারই ছিল বেসরকারি উদ্যোগে, সরকারি উদ্যোগ এসময়ে খুব কমই চোখে পরে।

ঢাকার আবাসন ইতিহাস দেখলে দেখা যায় এসময়েই গুলশান এবং বনানীতে জমির দাম আকাশছোঁয়া হতে শুরু করে। কেননা অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠা সকল উপাদানই মজুদ ছিল এই এলাকায় এবং তা হয়ও। আর এসময়েই নিকেতনের মত এলাকা আত্মপ্রকাশ করে গুলাশানের আশপাশে থাকার এলাকা হিসাবে। গুলশান এবং বনানীতে অত্যাধুনিক এবং দৃষ্টিনন্দন সব বাসাবাড়ি গড়ে উঠতে আরম্ভ করে। মাত্র এক-দুই দশকেই এই এলাকা হয়ে উঠে উচ্চবিত্তদের এলাকা। ঢাকার সবচেয়ে ধনী ও স্বচ্ছল লোকেরা এখানে বসবাস শুরু করে। এবং শতাব্দীর শেষ দিকে এসে শুরু হয় আবাসন খাতের এক নতুন ট্রেন্ড, “ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং”। মূলত এটিই নিয়ে আসে ঢাকার জীবনে এক বিশাল পরিবর্তন। 

মেগাসিটি ঢাকা

Growth of Dhaka as a megacity
হালের মেগাসিটি ঢাকা

ঢাকার এমন অতিদ্রুত বিস্তার ঢাকাকে পরিণত করেছে এক মেগাসিটিতে। ঢাকা এখন পৃথিবীর ১১তম বৃহৎ মেগাসিটি। প্রায় দুই কোটি মানুষকে স্থান দিতে দিয়ে ভবনগুলোকে হতে হয়েছে আকাশছোঁয়া, সবুজে ঘেরা বৃক্ষরাজিকে জানাতে হয়েছে বিদায়। অনুমিতভাবেই ঢাকার অধিকাংশ মানুষই ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা। এক গবেষণায় দেখা যায় মোট জনসংখ্যার মাত্র ২১ভাগই ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, বাকিরা জীবন ও জীবিকার টানে এসেছেন ঢাকায়। গত প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে ক্রমাগত উত্তরে বাড়ার পর ঢাকা এবার বেড়ে চলেছে পূর্ব দিকে, গড়ে উঠছে পূর্বাচলের মত এলাকা। উত্তরা চমৎকার আবাসিক এলাকা হবার পর গড়ে উঠেছে উত্তরখান। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া সামনে আর কোন উপায়ও খোলা নেই, এই হল বিশেষজ্ঞদের মতামত।  

বর্তমান সময়ে বসুন্ধরা, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী বা উত্তরাতে ফ্ল্যাটের দাম সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে বনশ্রী, বাড্ডা, রামপুরা বা মিরপুরের দিকে কিছুটা হলেও সহনীয়। ঢাকায় বিভিন্ন, রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে যোগাযোগও আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত হয়েছে। অসহনীয় যানজট থাকলেও পিক আওয়ারে তা অধিকাংশ মেগাসিটিতেই থাকে। স্বপ্নের মেট্রোরেলের জন্য এখন ঢাকাবাসী অপেক্ষা করছে। এবং দিনেদিনে ঢাকা হয়ে উঠছে একটি বৈশ্বিক শহর। 

স্মরণকালের মধ্যে ঢাকা এখন সবচেয়ে বেশি জনবহুল এবং বিশাল এলাকা। প্রতিনিয়ত ঢাকার বিস্তার আজ ঢাকাকে নিয়ে গিয়েছে এক নতুন উচ্চতায়। ঢাকার আবাসন ইতিহাস জেনে এত সব যুগের মধ্যে কোন আমলে ঢাকা সবচেয়ে বেশি বাসযোগ্য ছিল বলে আপনার মনে হয়? 

Write A Comment