Reading Time: 5 minutes

সময় এগিয়ে যাচ্ছে তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরাও। দ্রুত বদলে যাওয়া শহরের সাথে বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবন। আর এই জীবনের অনেক বড় একটি  জায়গা দখল করে আছে আমাদের থাকার জায়গা কিংবা বাসস্থান। নিজের এবং পরিবারের জন্য এই থাকার জায়গাটুকু নিশ্চিত করতেই ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগটি করেন ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য। তিলতিল করে সঞ্চয় করা অর্থ, যেখান থেকেই পূর্ণ হবে আজীবন ধরে লালিত ঘরের স্বপ্ন। তাই এই ঘরের জন্য বিনিয়োগ এমন একটি বিনিয়োগ যার সাথে যুক্ত থাকে অসংখ্য চাহিদা আর সম্ভাবনার গল্প। সেই সাথে থাকে সাধ্যের মধ্যে চাহিদার সবটুকু পূরণ হবে কিনা এ নিয়ে নানা দ্বন্দ! তাই গুরুত্বপূর্ণ এই বিনিয়োগটিতে পা ফেলার আগে জানা প্রয়োজন, বিনিয়োগের সঠিক সিদ্ধান্ত কোনটি? নতুন ফ্ল্যাট নাকি পুরাতন ফ্ল্যাট ? 

প্রশ্নের উত্তর জানতে ঠিক করে নিতে হবে কিছু বিশেষ মানদণ্ড। যে মানদণ্ডে নিজেকে ফেলে যে কেউই বুঝে নিতে পারবেন তার জন্য আসলে নতুন ফ্ল্যাট নাকি পুরাতন ফ্ল্যাট কোন বিনিয়োগটি সঠিক হবে। আজকের লেখায় নির্ধারিত সেই মাপকাঠিতে ভর করেই প্রশ্নটির উত্তর দিতে চেষ্টা করব ।   

বাজেটের মধ্যে চাহিদামত ফ্ল্যাট পাচ্ছেন তো?   

নতুন ফ্ল্যাট নাকি পুরাতন ফ্ল্যাট
অনেকে দীর্ঘদিনের সঞ্চয় করা অর্থ একত্রিত করে তা বিনিয়োগ করেন ফ্ল্যাট এর জন্য

ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে প্রথমেই যে বিষয়টিকে মাথায় রেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয় সেটা হল বাজেট। প্রতিটি মানুষের জন্যই বাজেট নির্দিষ্ট। অনেকে দীর্ঘদিনের সঞ্চয় করা অর্থ একত্রিত করে তা বিনিয়োগ করেন ফ্ল্যাট এর জন্য। অনেকে আবার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হোমলোনের সুবিধা নিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে চান। তবে সঞ্চয় হোক অথবা হোমলোন, বিনিয়োগের জন্য এই বাজেটটি কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা। এবং যে কেউ চাইলেই তার নির্দিষ্ট বাজেটের বাইরে গিয়ে প্রপার্টি কিনতে পারেন না। তাই নতুন ফ্ল্যাট নাকি পুরাতন ফ্ল্যাট কোনটি সঠিক সিদ্ধান্ত, তা অনেকখানি নির্ভর করছে ক্রেতার চাহিদা ও বাজেটের উপর। 

নতুন ফ্ল্যাটের আবেদন সব সময়ই অন্যরকম। সেখানে প্রথম পায়ের ছাপটি ক্রেতার নিজের হয়ে থাকে। যারা এই আবেগটিকে গুরুত্ব দেন এবং চান ঘরের প্রতিটি ইট থেকে শুরু করে ফিটিংস, সবকিছু হবে একদম নতুন, তাদের জন্য ব্রান্ড নিউ ফ্ল্যাটই সঠিক সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে নতুন ফ্লোর, নতুন ফিটিংস, নতুন প্লাম্বিংস, প্রতিটি উপকরণ নতুন বলে, ফ্ল্যাটের স্থায়িত্ব নিয়ে ক্রেতাকে ভাবতে হচ্ছে না। এছাড়া, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার হিসাব কষলেও দেখা যাবে এটাই ক্রেতার জন্য ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ নতুন ফ্ল্যাটের দাম একটু বেশি হলেও, এখানে ব্যবহার করা হয়েছে  সবচেয়ে আধুনিক উপকরণ, যা পুরাতন ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে, ক্রেতার বাজেট যদি সীমিত হয়, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরাতন ফ্ল্যাটই তার জন্য অধিক লাভজনক। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে, পুরানো ফ্ল্যাটের স্থায়িত্ব আসলে কতটুকু? একটি ফ্ল্যাটের স্থায়িত্ব কমপক্ষে ১০০ বছর হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ৫/৬ বছর ব্যবহৃত কোনো ফ্ল্যাট যদি কেনা যায় তাহলে তার স্থায়িত্ব নতুন ফ্ল্যাটের কাছাকাছিই হবে। তাই পুরাতন ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে যারা স্থায়িত্বকে গুরুত্ব দেন তারা মাত্র ৫ বা ১০ বছরের বেশি পুরনো হয়নি এমন ফ্ল্যাটের ব্যাপারে ভাবতে পারেন। ধরুন, আপনি একটি নির্ধারিত বাজেটে ঢাকার কোনো প্রাইম লোকেশনে, প্রায় ১৪০০ স্কয়ার ফিটের কোনো অ্যাপার্টমেন্ট এর জন্য বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন।  কিন্তু নির্ধারিত বাজেটের মধ্যে পছন্দের লোকেশনে চাহিদামত ফ্ল্যাট পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে হয় আপনাকে লোকেশন এর ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দিতে হবে অথবা ফ্ল্যাটের সাইজের ব্যাপারে ছাড় দিতে হবে। অথচ লোকেশন এবং সাইজ ঠিক রেখেই, কোথাও এতটুকু ছাড় না দিয়েও ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব যদি আপনি পুরাতন ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ এ ধরণের ফ্ল্যাটের মূল্য নতুন ফ্ল্যাটের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম হয়ে থাকে। 

ইউটিলিটি সংযোগ আছে কিনা

পুরাতন ফ্ল্যাট কিনলে গ্যাস সংযোগ নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই ক্রেতাকে দুশ্চিন্তা করতে হয় না

ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ইস্যু হলো ইউটিলিটি সার্ভিস। বিশেষত নতুন ফ্ল্যাটে গ্যাসের সংযোগ পাওয়া বর্তমানে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ পুরাতন ফ্ল্যাটেই ইউটিলিটি কানেকশনের এই নিশ্চয়তাটুকু পাওয়া যায়। তাই নতুন ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে ক্রেতাকে ইউটিলিটি কানেকশনের এই বাড়তি ঝামেলাটুকু মাথায় রাখতে হবে। অন্যদিকে, পুরাতন ফ্ল্যাট কিনলে অন্য অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হলেও গ্যাস সংযোগ নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই ক্রেতাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। 

বাড়তি মেরামতের প্রয়োজন হবে কি?   

পুরাতন প্রপার্টিতে কিনলে নতুন ফিটিংস বসানো, দেয়ালে রঙ করা ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাবস্থা ক্রেতাকেই করতে হয়

পুরাতন বা প্রি-ওনড ফ্ল্যাটের বেশ কিছু অসুবিধার একটি হল রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামত করার বাড়তি ঝামেলা। নতুন ফ্ল্যাটে প্রতিটি উপকরণই যেহেতু নতুন, তাই এখানে বাড়তি রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের প্রয়োজন পড়ে না। পুরাতন ফ্ল্যাট এর জন্য প্রয়োজন হয় নানা রকম পরিকল্পনা এবং কিছু বাড়তি পদক্ষেপ। রুটিন মেনে এই সমস্ত রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চালিয়েও যেতে হয়। এবং সবার আগে জানতে হয়, পুরাতন ফ্ল্যাট রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে করতে হয়। তাই, পুরাতন প্রপার্টিতে বিনিয়োগ করলে করলে নতুন করে  ফিটিংস বসানো, ফ্লোর ডিজাইন করা, দেয়ালে রঙ করা, কিংবা প্লাম্বিং পরিবর্তন- এমন অনেক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাবস্থা ক্রেতাকেই করে নিতে হয়। যার জন্য বাড়তি শ্রমের সাথে সাথে বাড়তি কিছু খরচও বহন করতে হয়। ক্রেতা আসলে এ ধরণের ঝামেলা নিতে কতটুকু প্রস্তুত তার উপরেও অনেকটা নির্ভর করবে, তার পুরাতন কিংবা নতুন ফ্ল্যাট কেনার সঠিক সিদ্ধান্ত।    

নতুন ফিচার যোগ করা যাবে তো?  

আন্ডার কন্সট্রাকশন ফ্ল্যাট কিনলে চাহিদামত যে কোনো ফিচার যোগ করা যায়

নতুন ফ্ল্যাট নাকি পুরাতন ফ্ল্যাট সেই সিদ্ধান্তের আগে ফ্ল্যাটের ফিচার সংক্রান্ত কিছু বিষয়ও মনে রাখা জরুরি। সাধারণত, পুরাতন প্রপার্টিতে  আলাদা করে কোনো ফিচার যোগ করার সুযোগ থাকে না। আর যোগ করতে চাইলেও পুরোটা ভেঙে আবার নতুন করে করতে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়।  অথচ, ক্রেতা যদি একটি আন্ডার কন্সট্রাকশন ফ্ল্যাট কিনেন, তাহলে তিনি একবারেই তার চাহিদামত সমস্ত ফিচার যোগ করতে পারছেন। যেমনঃ পছন্দমত ওয়াল পার্টিশন, ফ্লোর ডিজাইন, ইন্টেরিয়র, ফিটিংস, এমন আরো অনেক কিছু। সুতরাং এ ধরণের ফ্ল্যাটে ক্রেতা ফিচার যোগ করার সুযোগ বেশি পাবেন। 

কতটা নান্দনিক? 

Partitions in a room
বেশিরভাগ মানুষই আধুনিক ডিজাইনের ফ্ল্যাট পছন্দ করেন

যে কোনো ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রেই আরেকটি বিষয় গুরুত্ব পায়। সেটা হল এর নান্দনিকতা। অর্থাৎ ফ্ল্যাটটি আসলে ক্রেতার কাছে কতটা আকর্ষণীয়? বেশিরভাগ মানুষই আধুনিক ডিজাইনের ফ্ল্যাট পছন্দ করেন। যেখানে ভেন্টিলেশন, ব্যালকনি থেকে শুরু করে সবকিছুই থাকে আধুনিক পরিকল্পনামাফিক। আবার, কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা একটু পুরাতন ডিজাইনের ফ্ল্যাটগুলোতে নান্দনিকতা খুঁজে পান। পুরাতন ফ্ল্যাটগুলোতে খোলা ব্যালকনি বা ঘরগুলো বড় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এক্ষেত্রে নতুন ফ্ল্যাট নাকি পুরাতন ফ্ল্যাট ক্রেতা কোনটিকে বেছে নেবেন সেটা একান্তই নির্ভর করবে তার রুচি ও পছন্দের উপর।  

সার্ভিস চার্জ দিতে ইচ্ছুক তো?  

money and time
সাপোর্ট সার্ভিস থাকা মানে প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে সার্ভিস চার্জ বহন করা

নতুন ফ্ল্যাটে ইনভেস্ট করলে জেনারেটর, লিফট, ফায়ার সেফটি, সিকিউরিটি, কমিউনিটি হল এরকম সাপোর্ট সার্ভিসগুলো সহজেই পাওয়া যায়। অন্যদিকে পুরাতন অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে এই সাপোর্ট সার্ভিসগুলো না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। তবে এই সাপোর্ট সার্ভিস থাকা মানেই কিন্তু প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে সার্ভিস চার্জ বহন করা। পুরানো ফ্ল্যাটগুলোতে যেখানে এ ধরণের সার্ভিস নেই, তারা এই সার্ভিস চার্জ দেয়ার ঝামেলা থেকেও মুক্তি পাচ্ছেন।  

সুতরাং, আপনি আসলে কোন ধরণের বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত, কতটুকু ঝামেলা আপনি নিতে আগ্রহী, কিংবা কিছুটা ঝামেলা মেনে নিয়েও অপেক্ষাকৃত কম দামে ফ্ল্যাট কিনতে চান কিনা, এমন আরো অনেক কিছুর উপরই নির্ভর করছে আপনার বিনিয়োগের সঠিক সিদ্ধান্ত।  তাহলে নতুন ফ্ল্যাট নাকি পুরাতন ফ্ল্যাট আপনার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত কোনটি এবং কেন? জানিয়ে দিন কমেন্টে।

Write A Comment

Author