ঢাকার আবাসন ইতিহাস ঘাটলে অবধারিতভাবেই এর পাশে যে এলাকাটির নাম আসবে তা পানাম নগর । এই পানাম নগর যা “হারানো শহর” নামেও পরিচিত, ছিল এক রমরমা এলাকা। মানুষের পদচারনায় সবসময় থাকত মুখরিত। তবে সে সবই এখন অতীত। কোনভাবে সাড়ে চারশ বছর আগে ফিরে গেলে হয়ত দেখে মিলত সে প্রাণবন্ত, ব্যস্ত নগরের। কিন্তু আজ পানাম নগর, কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান বৈ কিছু নয়। ব্যস্ত নগর থেকে ব্যস্ততা হারিয়ে গিয়েছে, পড়ে আছে ঐতিহ্য আর স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন।
ইতিহাসে পানাম নগর
যতদূর জানা যায় ১৫ শতকের শাসক, জমিদার ঈশা খাঁ রাজধানী হিসাবে প্রথম পানাম নগরের গোড়াপত্তন করেন। যদিও ১৩ শতকের আগে থেকেই এই এলাকায় রমরমা বসতি গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু রাজধানী স্থাপনের পর থেকেই এই এলাকা বিশেষভাবে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে এখানে বসতি গড়ে উঠে, বড় নগর, পাশ নগর এবং পানাম নগর। আর পানাম নগরই ছিল এদের মধ্যে সবচেয়ে জমজমাট এলাকা।
অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় পানাম নগর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ বিখ্যাত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পূর্ব দিকের শেষ মাথা ছিল এই পানাম নগর। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ছিল মধ্য এশিয়ার সাথে বাংলার যোগাযোগের মাধ্যম। বিভিন্ন জায়গা থেকে অবস্থাসম্পন্ন অসংখ্য মানুষ পানাম নগরে এসে বসতি গেড়েছিলেন। তবে সে অনেক কাল আগের কথা। আজ পানাম নগর ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের এক বড় উদাহরণ হিসাবে দাড়িয়ে আছে।
পানাম নগরের স্থাপত্য রীতি
যদিও কয়েকশ বছর ধরে পানাম নগরে মানুষের বসবাস নেই, তবুও বেশ কিছু স্থাপত্য নিদর্শন আজও ঠায় দাড়িয়ে আছে পানাম নগরের কথা মনে করিয়ে দিতে। প্রাচীন ইউরোপীয় এবং মোগলরীতি মেনে গড়ে উঠেছিল পানাম নগর। তার সিংহভাগই এখনো দাড়িয়ে আছে ইট কাঠ পাথরের মধ্য দিয়ে।
যদিও আজ থেকে প্রায় ৫শ বছর আগের নকশায় নির্মিত হয়েছিল পানাম নগর কিন্তু এর নগর পরিকল্পনা এবং স্থাপত্যরীতির প্রশংসা না করে উপায় নেই। পানাম নগরের ঠিক মাঝ বরারর প্রায় ৬০০ মিটার লম্বা একটি রাস্তা চলে গিয়েছে। এ রাস্তার দু’ধারে কমপক্ষে ৫০টির মত দুই বা তিন তলা বাড়ি রয়েছে। এ বাড়িগুলোর প্রতিটির ছিল নিজস্ব কুয়া বা পানির ব্যবস্থা। একটি বাড়ি থেকে আরেকটির মাঝে আছে বিশাল ফাঁকা স্থান যা সম্ভবত বাগান হিসাবে ব্যবহার করা হত। প্রার্থনা এবং চিত্তবিনোদনের জন্যও ছিল অনেক জায়গা। না জানি প্রতিটি বাড়িরই ছিল আলাদা আলাদা গল্প যা আজ হয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে বিলীন।
সংস্কৃতি
সময় যত গড়িয়েছে পানাম নগর ততই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। তবে এত শত বছর পরেও কিন্তু ধারণা করা যায় সেই সময়ের সংস্কৃতি নিয়ে। বলা হয়ে থাকে, সে সময়ের প্রতিটা সন্ধ্যাই ছিল আনন্দে মোড়ানো। নাচে গানে যে জীবন্ত হয়ে উঠত প্রতিটি সন্ধ্যা। এমনকি সবচেয়ে গোমড়ামুখো, সবচেয়ে দুখি মানুষটিও যেন উৎসবের আনন্দে মেতে উঠত।
পানাম নগরের অবশিষ্ট থাকা স্থাপনার মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলে আজও দেখতে পাওয়া যায় নানান হল, দরবার, নাচের মঞ্চ সহ বিভিন্ন জিনিস। সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পানাম নগরের মানুষকে কত দূর যেতে হয়েছে তা কি আপনি কল্পনা করতে পারছেন? শতবর্ষী পুরানো নাটক, মঞ্চ বা নাচ গানের কথাই বা কতটা ভাবা যায়? কি চমৎকারই না হত যদি যে সময়ে একটি বারের জন্যও ফিরে যাওয়া যেত তাই না!
অতঃপর, একটি যুগের অবসান
সব কিছুরই শেষ আছে, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে মন্ডিত পানাম নগরও দেখেছে তার শেষ। নানান সমস্যা এবং পরিবর্তিত অবস্থায় যখন অনেক ধনী, অবস্থাসম্পন্ন বণিকেরা পানাম নগর ছাড়তে শুরু করলেন, পানাম নগরের শেষটা যেন লেখা হয়ে গিয়েছিল তখনই। ধীরে ধীরে এখানকার মানুষ কমতে শুরু করল এবং ভাঁটা পড়তে শুরু করল এর যৌবনে। ব্যবসায়ীরা এই এলাকার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেন। বরং অন্যান্য নতুন নতুন এলাকা হয়ে উঠল তাদের গন্তব্যস্থল। যে নীল আর মসলিন একসময় জমজমাট করে তুলেছিল পানাম নগরকে, সেগুলোর অনুপস্থিতি ধীরে ধীরে একে করে তুলল এক ভূতুড়ে নগরী। এক জমজমাট এলাকার কী করুণ পরিণতি!
দর্শনার্থীদের গন্তব্য
যদিও অনেকে একে এখন “ঘোস্ট সিটি” বা ভূতুড়ে নগর বলে ডাকেন, আদতে এটি এখন দর্শনার্থীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। দেশি বিদেশী নানান পর্যটকের ভিড়ে এখন মুখরিত থাকে পানাম নগর । আর যতই প্রাচীন বা “ধ্বংসস্তুপ” মনে হোক না কেন, পানাম নগর যাওয়া আসলে খুবই সহজ। এই ঐতিহাসিক স্থানটিতে যাওয়া যায় নানাভাবে। প্রবেশের জন্যে যদিও টিকেট লাগে তবে তা পাওয়া যায় নামমাত্র মূল্যে। দেশী যে কেউ টিকেট পাবেন ১৫ টাকায় যেখানে বিদেশীদের দিতে হবে ১০০ টাকা। ঢাকা থেকে একদিনের মাঝে গিয়েই ঘুরে আসা সম্ভব এই স্থান।
একসময় পানাম নগর ছিল মানুষে মানুষে মুখরিত, জমজমাট এক এলাকা, আজ হয়ত সে কিছু নেই। তবে পানাম নগরে গেলে প্রতিটি ইটে, প্রতিটি স্থাপত্য নিদর্শনে ৪৫০ বছর আগের সে ব্যস্ততা অনুভব করা যায়। পানাম নগরকে নিয়ে বানানো আমাদের এই ভিডিওটি দেখুন। আপনার পরবর্তী পানাম নগর ভ্রমণে এই অনেক সহায়ক হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।