Reading Time: 5 minutes

যে কোন দেশের উন্নয়নের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হল ব্রিজ বা সেতু। যে খরস্রোতা নদী পার হতে লেগে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা তা নিমিষেই পার হওয়া যায় ব্রিজের কারণে। আর এভাবেই সেই এলাকার সাথে সাথে দেশের উন্নয়নের চাকাও গড়িয়ে চলে। একটি ব্রিজের কারণে কোন এলাকার বা অঞ্চলের জীবনযাত্রার মানই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে এমন উদাহরণও আছে। তাই বলায় যায়, দেশের থাকা প্রত্যেকটি ব্রিজ, হোক তা ছোট বা বড়, সবকটিই দেশ ও মানুষের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। তবে এর মধ্য কিছু কিছু সেতু আসলেই একটু অন্যরকম। কোনটি হয়ত শতবর্ষ পুরানো আবার কোনটি দেশের বৃহত্তম। তাই চলুন দেখে নেয়া যাক বর্তমানে বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু নিয়ে লেখা এই ব্লগটি।

বঙ্গবন্ধু সেতুঃ উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার

যমুনা সেতু - ট্রেন
যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু

প্রমত্ত যমুনার বুক চিড়ে, একপাশে সিরাজগঞ্জ আরেকপাশে টাঙ্গাইলকে সংযুক্ত করে দেশের সর্ববৃহৎ সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দেশই না বরং ৪৮০০ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটির নির্মাণ কাজ যখন শেষ হয় তখন দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে এটি ছিল বিশ্বের ১১তম। দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম ১০টি সেতুর এটি একটি। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে এটি অনন্য। এটি একটি বহুমুখী সেতু, অর্থাৎ এর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। একদিকে এতে যেমন শুধু সড়কপথই নয় বরং রয়েছে মিটার গেজ এবং ব্রড গেজ রেললাইন, সেই সাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে মৌলিক বেশ কিছু চাহিদা যেমন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থাও করেছে এই সেতু। নিশ্চিতভাবেই এটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেতু এবং উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার। 

মেঘনা ব্রিজঃ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক

ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের অফিসিয়াল নাম এন১ বা ন্যাশনাল হাইওয়ে ১। একে বলা হয় বাংলাদেশের “আর্টারি অফ ট্রান্সপোর্টেশন”  বা দেশের যোগাযোগব্যবস্থার ধমনী। বাণিজ্যিক রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাথে সমগ্র বাংলাদেশের যোগাযোগের মূল উপায় যে এটিই। আর এই এন-১ এই আছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সেতু যার নাম মেঘনা সেতু। নারায়ণগঞ্জের যে এলাকায় এটি অবস্থিত তা মেঘনাঘাট নামেই বেশি পরিচিত সবার কাছে। জাপান থেকে পাওয়া আর্থিক এবং কারিগরি সহযোগিতায় নির্মিত হওয়ায় এই সেতুর দাপ্তরিক নাম জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু হলেও, সবাই একে মেঘনা সেতু নামেই বেশি চিনে থাকেন। প্রায় এক কিলোমিটারের মত দীর্ঘ (৯৩০ মিটার) এই সেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করছে। সম্প্রত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার এন-১ এ গাড়ির চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এজন্য মেঘনাঘাট এলাকায় সৃষ্টি হত অসহনীয় যানজট। তাই মেঘনাঘাটে, প্রথম সেতুর পাশেই দ্বিতীয় মেঘনা সেতু তৈরি করা হয়েছে যা যানজটকে অনেকাংশেই কমিয়ে এনেছে। 

হার্ডিঞ্জ ব্রিজঃ পাবনা

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ
পাবনার বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ                           

“বৃটিশ কোয়ালিটি” বলে বাংলায় প্রচলিত একটি কথা আছে। এটি অত্যন্ত মজবুত ও টেকসই কোনকিছুকেই সাধারণত বুঝানো হয়। নদীবিধৌত এ বাংলায় বৃটিশরাই প্রথম শক্তিশালী একটি রেল-যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলে। আর তা করতে গিয়ে বিভিন্ন বন্ধুর জায়গায় তাদের নির্মাণ করতে হয় বেশ কিছু সেতু ও রেলসেতু। পাবনার বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তারই একটি। আর টেকসইয়ের কথা উঠলে বলতে হয়, ২০১৫ সালে এই ব্রিজের বয়স হয়েছে ১০০ বছর! তৎকালীন ভারতের ভাইসরয়ের নামে নামকৃত এই ব্রিজটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন কয়েকটি ব্রিজের একটি। সেসময়ে কলকাতা এবং পূর্ব বাংলার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে এই রেল সেতুটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। আবার, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এই ব্রিজে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুক্তিসেনারা পাকিস্তানী আর্মির সাথে যশোর এলাকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় যা স্ট্রাটিজিক্যালি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাবনার ঈশ্বরদীতে, পদ্মা নদীর উপরে এই স্টিল নির্মিত ব্রিজটি এমনভাবে বানানো যেন নিচে বয়ে চলা নদীর গতিপথের উপর খুব বেশি প্রভাব না পরে। প্রায় ২ কিলোমিটার লম্বা এই ব্রিজটি হয়ত দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত সেতুর একটি নয়, কিন্তু ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেতু নিয়ে করা যে কোন তালিকায় এর নাম আসবেই।    

শাহ আমানত সেতুঃ চট্টগ্রাম

শাহ আমানত সেতুঃ চট্টগ্রাম
শাহ আমানত সেতুঃ চট্টগ্রাম

বাংলাদেশের অন্যতম ব্যস্ত হাইওয়েতে অবস্থিত কর্ণফূলী নদীর শাহ্‌ আমানত সেতু দেশের দক্ষিণ প্রান্তের জেলাগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করে। ৯৫০ মিটার দীর্ঘ এবং ২৪.৪৭ মিটার প্রশস্ত এ সেতুটি দেশের প্রথম বৃহৎ কোন ক্যাবল সাপোর্টেড সেতু। কর্ণফুলী নদীর উপর এমন তৃতীয় সেতু হওয়ায় এটি তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু নামেও পরিচিত। এই সেতুর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায় কারণ দেশের অন্যতম কিছু টুরিস্ট স্পটের রাস্তাতেই এর অবস্থান। অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও এই ব্রিজকে যতটা সম্ভব প্রশস্ত করা হয়েছে। তাই এতে আছে চারটি আলাদা লেনের পাশাপাশি দেড় মিটার করে দুটি আলাদা লেন যা দিয়ে রিকশার মত পেশীচালিত যানবাহন চলাচল করতে পারে।

কীন ব্রিজঃ সিলেট

কীন ব্রিজ - সিলেট
কীন ব্রিজ – সিলেট

মেঘালয়ের কোলঘেঁষা, টিলাঘেরা সিলেট অঞ্চল বৃটিশদের কাছে প্রিয় ছিল অসংখ্য চা বাগানের জন্য। এজন্য এখানে বৃটিশ আমলের বেশ কিছু স্থাপনা দেখা যায়। সিলেট সুরমা নদীর উপর অবস্থিত বিখ্যাত কীন ব্রিজ যার মধ্যে অন্যতম। ১৯৩৬ সালে নির্মিত অত্যন্ত মজবুতও টেকসই এই ব্রিজটি যে ব্রিটিশ কোয়ালিটির আরেকটি উদাহরণ। আসাম অঞ্চলের গভর্নর মাইকেল কীনের নামে নামকৃত এই সেতুটি নির্মাণের পরেই সিলেট অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ হয়ে উঠে অনেক সহজ। বর্তমানে সিলেট শহরে আরও দুটি ব্রিজ নির্মাণ করা হলেও কীন ব্রিজের গুরুত্ব কোনভাবেই কমেনি বরং এটিই সিলেটের সবচেয়ে ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ সেতু । ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও প্রায় সাড়ে ৫ মিটার চওড়া এই সেতুটি দেশের সবচেয়ে সুন্দর একটি সেতুও বটে!

রূপসা সেতুঃ খুলনার অতি গুরুত্বপূর্ণ সেতু

রূপসা সেতু - খুলনা
রূপসা সেতু

কীন ব্রিজ যদি হয় সিলেটে ঢোকার রাস্তা তাহলে দেশের অন্যপ্রান্তে থাকা রূপসা সেতু হল খুলনার দরজা! যে নদীর উপর নির্মিত সেই রূপসা নদীর নামেই মানুষের মুখে নাম পেয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ সেতু । নদী এবং ব্রিজের সৌন্দর্য্য দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে জড় হয়। সুন্দর তো বটেই, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করাতেও এর ভূমিকা অপরিসীম। রূপসা সেতু বা দাপ্তরিক নাম “খান জাহান আলী সেতু”, যে নামেই ডাকুন না কেন, মংলা পোর্ট থেকে মালপত্র খালাস হয়ে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই গুরুত্বপূর্ণ সেতু দিয়েই। ১.৬৪ কিলোমিটার লম্বা এবং ১৬.৪৮ মিটার চওড়া এই ব্রিজটি দেশের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক তৈরিতে তাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 

খালি চোখে দেখলে একটি ব্রিজকে হয়ত আর দশটি স্থাপনাই মনে হবে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় কীভাবে কোন সেতু একটি অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রাকেই পাল্টে ফেলে। নগরায়নের সাথে সাথে এই ব্রিজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নানান শিল্প-কারখানা এবং ঘুরতে শুরু করে এলাকাবাসীর ভাগ্যের চাকা। অনেক সময়ই দেখা যায় রাজনৈতিক নেতারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করছেন তাদের এলাকার কোন সেতুর কথা! তাই বলাই যায়, দেশ যত উন্নত হচ্ছে, সাথে সাথে উন্নত হচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থা এবং নির্মিত হচ্ছে নতুন নতুন ব্রিজ। 

উপরের ব্রিজগুলোর মধ্যে আপনার প্রিয় ব্রিজ কোনটি? কোনটি নিয়ে আপনার কি আছে বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা? শেয়ার করুন আমাদের সাথে। যদি মনে হয় আপনার এলাকার কোন ব্রিজ এই লিস্টে আসতে পারে, তাও জানিয়ে দিন আমাদেরকে।

Write A Comment