Reading Time: 4 minutes

এই কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে সাইকেল ছিল শুধুই প্রয়োজনের বাহন। ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজে যাওয়া, গ্রামেগঞ্জে মানুষের ছোটখাটো দূরত্বে যাতায়াত কিংবা হাল্কা মালামাল পরিবহন, এপর্যন্তই ছিল সাইকেলের দৌড়। শৈশবে প্রথম চালানো শিখবার পর যে শখ, সাইকেলের সাথে শখের সম্পর্ক ছিল ও পর্যন্তই। কিন্তু বিশ্বের তুলনায় কিছুটা দেরীতে হলেও সময়ের সাথে সাথে পরিবেশবান্ধব এই বাহনটি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে আমাদের দেশেও। বিশেষ করে গত এক দশকে বাংলাদেশে সাইক্লিং এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সাইকেলে করে এখন মানুষ শতশত কিলোমিটার চালিয়ে ফেলছে, চষে ফেলছে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত অব্দি। সাইকেলের সিটে চেপে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, দেশকে, দেশের মানুষকে চিনছে নতুন করে, বাংলার সৌন্দর্য আবিষ্কার করছে নতুনভাবে। সাইকেল এখন শুধু প্রয়োজনই নয়, বরং শখেরও বস্তু। আমাদের আজকের লেখা এমনই লং ডিস্ট্যান্স সাইক্লিং নিয়ে। 

বর্ডার টু বর্ডার

ক্রসকান্ট্রি
দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া (ছবিঃ রাহিকুল ইসলাম চৌধুরী)

শিরোনাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তের কথা বলা হচ্ছে। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দু চাকায় চেপে পায়ের শক্তিতে প্যাডেল দিয়ে এমন দুরত্ব পারি দেয়াকে খুবই স্বাভাবিক বিষয় বানিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। অবশ্য আমাদের দেশের আয়তনও এক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। আয়তনের দিক থেকে খুব বেশি বড় না হওয়ায় অহরহই সাইকেল নিয়ে মানুষ বেড়িয়ে যাচ্ছে দেশ দেখতে বাংলাদেশে সাইক্লিং করতে, এক সীমানা থেকে আরেক সীমানায় সাইকেল চালাতে।  অন্যান্য বড় দেশের জন্য এমন বর্ডার থেকে বর্ডারে চালানোটা অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জিং হলেও বাংলাদেশের জন্য তা তুলনামূলক অনেক সহজ। অনেকে আবার আদর করে একে ডাকেন “ক্রস-কান্ট্রি সাইক্লিং”, দেশের এক সীমানা থেকে অন্য সীমানায় সাইকেল চালালে তা আড়াআড়ি দেশের মাঝখানে একটা দাগ কেটে যায়, সেই ধারণা থেকেই এই নামের উদ্ভাবন। চলুন দেখে নেয়া যাক এমন কয়েকটি জনপ্রিয় ক্রস কান্ট্রি সাইক্লিং রুট সম্পর্কে। 

টেকনাফ – তেতুলিয়া

শাহপরীর দ্বীপে সাইকেল
শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছানোর পর (ছবিঃ তন্ময় ইসলাম)

উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ, হিমালয়কন্যা পঞ্চগড় থেকে বঙ্গপোসাগরের সুবিশাল জলরাশি, তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ, বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পরিচিত রুট খুব সম্ভবত এটিই। দেশের সর্বউত্তর-পশ্চিম প্রান্তে পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া বা বাংলাবান্ধা সীমান্ত থেকে একদম সর্ব পূর্ব-দক্ষিণের প্রান্ত কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত এই পথের বিস্তৃতি। বিভিন্নজন বিভিন্ন দিক দিয়ে এই পথ পারি দেন, তবে যেদিক দিয়েই হোক না কেন মাঝে পারি দিতে হয় কম-বেশি প্রায় হাজার কিলো পথ। তেতুলিয়া বা বাংলাবান্ধা থেকে শুরু করে, উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও হয়ে, মাঝে পদ্মা – যমুনা পারি দিয়ে চট্টগ্রাম এসে কক্সবাজার দিয়ে শেষপ্রান্ত টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপে গিয়ে শেষ হয় এই পরিভ্রমণ।

তামাবিল – ভোমরা

সুন্দরবনের আশে পাশে সাইক্লিং
সুন্দরবনের আশেপাশে সাইক্লিং (ছবিঃ নিয়াজ মোর্শেদ)

দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত সিলেটের তামাবিল সীমান্ত থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে থাকা সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তও আরেকটি চমৎকার সাইক্লিং রুট। পূর্বে মেঘালয়ের পাহাড়ের কোল থেকে যাত্রা শুরু করে একদম পশ্চিমে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডেরা সুন্দরবনের কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত এই যাত্রাপথ। আপনার যাত্রা শুরু হবে চায়ের রাজ্য, মেঘালয়ের পাহাড়ঘেরা সিলেটের তামাবিল থেকে। এরপর একে একে সিলেট, হবিগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকা ফেলে, মাওয়া কিংবা পাটুরিয়াঘাট দিয়ে ফেরী পার হয়ে মাগুরা, যশোর কিংবা খুলনা হয়ে পৌঁছানো যায় সাতক্ষীরা ভোমরা সীমান্তে। 

হালুয়াঘাট – কুয়াকাটা

টেকনাফ আর তেতুলিয়ার ভৌগলিক অবস্থান দেশের দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিমপ্রান্তে। তবে কেউ যদি সরাসরি দেশের একদম উত্তর থেকে একদম দক্ষিণপ্রান্তে ভ্রমণ করতে চায় তাহলে তার গন্তব্য হবে এই পথ। মানচিত্রের উপরের দিকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলা আর দক্ষিণে বঙ্গপোসাগরের কোল ঘেঁষে কুয়াকাটা। পথিমধ্যে ময়মনসিংহ, ঢাকা , নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ হয়ে, মাদারীপুর, বরিশাল ফেলে পটুয়াখালী দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। বাংলাদেশে সাইক্লিং করতে চাইলে চমৎকার একটি রুট হতে পারে এটি। 

আখাউড়া – মুজিবনগর

আখাউড়া – মুজিবনগর সাইকেল রাইডের একটি মুহূর্ত

বর্ডার টু বর্ডার সাইক্লিং এর জন্য আলোচিত রুটগুলির মধ্যে সবচেয়ে ছোট বা কম দুরত্বের রুট হল এটি। দেশের মোটামুটি মাঝখান দিয়ে আড়াআড়ি পূর্ব-পশ্চিমে চলে গিয়েছে এটি। একপাশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আখাউড়া সীমান্ত, অন্যদিকে মেহেরপুরের মুজিবনগর। মোটামুটি ৫০০ কিলোমিটার দুরত্বের মাঝেই এই রাইড শেষ করা সম্ভব। একাধিক রুটে এই রাইড শেষ করা যায়। অনেকে আখাউড়া থেকে শুরু করে নায়ারণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ মাওয়া হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে কুষ্টিয়া হয়ে মেহেরপুর যান। আবার অনেকের রুট থাকে কিছুটা অপ্রচলিত, আরেকটু দক্ষিণ ঘেঁষে, আখাউড়া থেকে শুরু করে কুমিল্লা চাঁদপুর দিয়ে মেঘনা পারি দিয়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ দিয়ে, নড়াইল যশোর, চুয়াডাঙ্গা হয়ে মেহেরপুর মুজিবনগর। 

এই মেহেরপুরের মুজিবনগর বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, দুটি স্থানই বাঙালি জাতি  হিসেবে আমাদের খুবই পরিচিত দুটি স্থানের নাম। মুজিবনগরের কথা আমরা কে-ই বা না জানি! মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছিলেন ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে, যা এখন মুজিবনগর নামে পরিচিত। অন্যদিকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পেছনে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনে মূল রসদ ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আখাউড়া সীমান্তের ওপারেই এই আগরতলার অবস্থান। 

সাইক্লিং নতুনভাবে দেশকে দেখতে শেখাচ্ছে লাখো তরুনকে। ভ্রমণের ফলে তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন অধ্যায়। এমন বর্ডার টু বর্ডার ক্রস কান্ট্রি সাইক্লিং হতে পারে আরও অনেক পথেই। তবে বাংলাদেশে সাইক্লিং শুরু করতে চাইলে এই জয়প্রিয় ৪টির মধ্যে একটি বেঁছে নিতে পারেন আগ্রহী কোন সাইক্লিস্ট। 

Write A Comment