Reading Time: 3 minutes

যেকোনো নির্মাণকাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান স্টিল। কিন্তু অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী যেমন সিমেন্ট, ইট, বালুর তুলনায় বাংলাদেশে স্টিলের মূল্য তারতম্য হয় অনেক বেশি। এর বেশ কিছু কারণও আছে। তবে প্রথমে আসুন জেনে নেই, অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের তুলনায় নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যের সূচক কেন এত বেশি ওঠানামা করে। তারপর মূল্য তারতম্যের কারণগুলোর পাশাপাশি গত কয়েক বছরে স্টিলের মূল্য কেমন ছিলো সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হবে। 

নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যের তারতম্য কেন হয়? 

বৃদ্ধির গ্রাফ
অর্থনীতির ভাষায়, প্রাইস ইনইল্যাস্টিসিটি বা মূল্য অস্থিতিস্থাপকতাই নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যের তারতম্য হওয়ার কারণ

অর্থনীতির ভাষায়, প্রাইস ইনইল্যাস্টিসিটি বা মূল্য অস্থিতিস্থাপকতাই নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যের তারতম্য হওয়ার কারণ। যেমন, কোনো মেটাল বা ধাতুর চাহিদা বিশ্বব্যাপী হঠাৎ বেড়ে গেলেও এর যোগান বা সাপ্লাই তাৎক্ষনিকভাবে বাড়ানো অসম্ভব। কেননা সেজন্য বাড়াতে হবে খনির সংখ্যা, নিতে হবে আরো অনেক অতিরিক্ত ব্যবস্থা, যা বাস্তবে কখনোই করা যায় না। আবার নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য তারতম্য যত বেশিই হোক না কেন এক সামগ্রীর পরিবর্তে কিন্তু কখনোই অন্যটি ব্যবহার করা যায় না।

নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যের তারতম্য আসলে কতখানি হয় তা নির্ধারণ করা কঠিন, তবে এর প্রভাব বেশিরভাগ সময় নেতিবাচক। কেননা এর ফলে ভবিষ্যত মূল্য অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়ে, অথচ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

স্টিলের মূল্য তারতম্য কেন হয়? 

জাহাজ থেকে মাল নামানো
ইস্পাত শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়

বাংলাদেশের ইস্পাত শ্রমিকরা দেশের অভ্যন্তরে স্টিলের চাহিদা বেশ ভালোভাবেই মেটাচ্ছে। কিন্তু এ শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কারণ বাংলাদেশে কোনো ইন্টেগ্রেটেড মিল (ব্লাস্ট ফারনেস বেসিক অক্সিজেন ফারনেস মেথড) স্টিল তৈরির জন্য নেই। কিন্তু এ ধরনের মিলই সবচেয়ে এনার্জি এফিসিয়েন্ট। এখানকার স্টিল মিলগুলো কাজ করে ইনডাকশন ফার্নেস বা ইএএফের মাধ্যমে, যার মূল চালিকাশক্তি হলো বিদ্যুৎ।

ইএএফ প্রযুক্তিতে প্রাইমারি কাঁচামাল হলো টুকরো করা স্টিল, ডিরেক্ট রিডিউসড আয়রন (ডিআরআই), হট মেটাল এবং বিদ্যুৎ। ১ টন ক্রুড স্টিল তৈরির জন্য, এ পদ্ধতিতে ৭০১ কেজি স্টিলের টুকরা, ৫৮৬ কেজি আকরিক লোহা বা আয়রন ওর, ৮৮ কেজি লাইমস্টোন এবং ২.৩ গিগাজুল ইলেক্ট্রিসিটি। এর বেশিরভাগ অংশই আমদানিকৃত। এজন্যই কাচামালের দাম বাড়লে বাংলাদেশে স্টিলের মূল্য তারতম্য হয়। 

আন্তর্জাতিক বাজারে স্টিলের দামের অস্থিতিশীলতাও বাংলাদেশে স্টিলের মূল্য তারতম্য এর কারণ। যেমন, ২০১৪ সালে যখন চীনে নির্মাণ প্রবণতা খানিকটা কমে আসলো, তখন সে দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় চীন স্টিল তৈরির হারও কমিয়ে দেয়। ফলে, স্টিল ও আকরিক লোহার দাম অনেকখানি কমে যায় এবং ২০১৫ পর্যন্ত তা কমতাই থাকে। 

এছাড়াও, বাংলাদেশে ভ্যাট ও অন্যান্য কর বৃদ্ধি, বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ার সাথে সাথে নতুন ভ্যাট আইন প্রয়োগ, সুদের উচ্চ হার এবং ব্যক্তিগত ঋণ ধীর গতিতে বৃদ্ধি এ ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা ও মূল্য দুটোকেই প্রভাবিত করে।  

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে স্টিলের মূল্য তারতম্য 

বাংলাদেশি টাকা
চাহিদা হ্রাস, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য কমে যাওয়া এবং এ অর্থনৈতিক বছরে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট কম হওয়ায় মাইল্ড স্টিল রডের মূল্য হ্রাস পেয়েছে

প্রচুর কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ও মেগা প্রজেক্টের কাজ হচ্ছে বলে বাংলাদেশের স্টিল ইন্ডাস্ট্রি দ্রুতই উন্নতি করছে। এক তথ্য থেকে জানা যায়, মাইল্ড স্টিল রড, প্রিফ্যাব্রিকেটেড স্টিল এবং করুগেটেড আয়রন শিট মিলিয়ে এক দশক আগে স্টিল বিক্রয়ের হার ছিলো ১.৬ মিলিয়ন টন। কিন্তু ২০১৮ সালের তথ্য়ে দেখা যায়, এ হার হয়েছে ৭.৫ মিলিয়ন টন, এমনকি যা ২০১৭ এর ৫০,০০০ কোটি টাকার শিল্পের চাইতেও ৩৭.৫% বেশি।  

২০১৮ তে ৬০-গ্রেড এমএস রেবার বা এর চেয়েও উন্নত মানের স্টিল বিক্রি হতো অন্তত প্রতি টন ৭১,০০০ টাকা দামে। ৪০-গ্রেড এমএস রডের জন্য এটি ২০১৮ তে ছিলো ৫৯,৫০০-৬০,৫০০ টাকা, যা আরো আগে পাওয়া যেত প্রতি টন ৫০,৫০০-৫১,৫০০ টাকা । 

তবে, ২০১৯ সালে চাহিদা হ্রাস, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য কমে যাওয়া এবং এ অর্থনৈতিক বছরে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট কম হওয়ায় মাইল্ড স্টিল রডের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। 

ঢাকায় ৬০-গ্রেড রড বিক্রি করা হতো প্রতি টন ৬৫,০০০-৭০,০০০ টাকায় আর ৪০ গ্রেড এমএস রড বিক্রি হতো ৫৭,০০০-৬০,০০০ টাকায়। এ চিত্র ২০১৮ এর সাথে তুলনা করলে হতাশাজনকই মনে হবে। 

বর্তমানে, এই চলমান মহামারীর সময়ে, নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা খুবই হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে এগুলোর মূল্যও এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভীষণ কম। কিন্তু ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির দিকেই এগোচ্ছি আমরা, বাড়ছে নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা।বর্তমানে ৬০-গ্রেড স্টিলের দাম প্রতি টন ৫৮,০০০-৬০,০০০ টাকা, তবে আরো কম মূল্যেও বিক্রয় করা হচ্ছে।

অন্য যেকোনো নির্মাণ সামগ্রীর তুলনায় বাংলাদেশে স্টিলের মূল্য তারতম্য হয় অনেক বেশি। বিভিন্ন কারণে কখনো এর দাম বাড়ে, কখনো হয় নিম্নগামী। তাই স্টিল কেনার সময় উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো ভেবে তবেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। 

Write A Comment