কিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে একটি শহরের কাঠামো? সড়ক, ভবন, নদী, উপত্যকা- আরো অনেক কিছু উঠে আসবে এই প্রশ্নের উত্তরে। তবে নগরায়ণকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে সেখানকার সংস্কৃতি। তাইতো শত বছর ধরে সংস্কৃতির সাথে পথ হেটেই বিশ্বের সেরা শহরগুলো সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর বুকে।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে এই নগর পরিকল্পনার ধারণা। ইতিহাসের পাতায় উন্নত নগর পরিকল্পনা ও নির্মাণশৈলীর তথ্য পাওয়া যায় যিশু খ্রীস্টের জন্মেরও ৩০০০ বছর আগের সময়ে, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু আর মিশরীয় সভ্যতায়। সর্বপ্রথম নগর রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে উত্থান হয় গ্রীক সভ্যতার। তারই ধারাবাহিকতায় গোড়াপত্তন হয়েছিল বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের।
আসলে প্রতিটি সভ্যতাই নগরায়ণের ধারণা নিয়ে এগিয়েছে। গড়ে উঠেছে নগর থেকে রাষ্ট্র। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নগর পরিকল্পনার সংস্কৃতিও পরিবর্তিত হয়েছে। আর আধুনিক পৃথিবীর শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা সহজ করেছে যোগাযোগ, উন্নত করেছে মানুষের জীবনযাপণ, বেগবান করেছে সভ্যতার চাকা।
তাই, আজকে কথা বলবো বিশ্বের সেরা কয়েকটি পরিকল্পিত শহর নিয়ে।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী আর উন্নত শহরটির নাম নিউইয়র্ক। রূপকথার গল্পের মতই সাজানো এ শহর। ঐতিহাসিক ভাস্কর্য থেকে আধুনিক স্থাপত্য- দারুণ সমন্বয় ঘটেছে এ শহরের নির্মাণশৈলীতে।
অসংখ্য গ্যালারি আর সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রে সমৃদ্ধ এই শহর। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর হওয়ার পরেও পরিকল্পিত যাতায়ত ব্যবস্থার কারণে শহরটিকে দ্রুত গতির শহর বললে ভুল বলা হবে না। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাবওয়ে সিস্টেম রয়েছে এখানে, যার মাধ্যমে খুব সহজে ভূগর্ভস্থ ট্রানজিটের মাধ্যমে দ্রুত পৌঁছানো যাবে গন্তব্যে। রয়েছে এরিয়াল ট্রামওয়ে এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ এয়ারপোর্ট সিস্টেম।
নিউইয়র্কের ডিপার্ট্মেন্ট অব স্যানিটেশন(ডিএসএনওয়াই) বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি।
যদিও এ শহরে বসবাস করতে প্রতিদিন গুণতে হবে মোটা অংকের অর্থ, তারপরেও অনেক ধনাঢ্যরা এই শহরে গড়ে তুলেছেন নিজের আবাস।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্যাস্ত হয় না। শত বছরেরো বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শাসন করেছে পৃথিবীর অনেক দেশ। আগের সেই জৌলুস না থাকলেও, ব্রিটিশদের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ধারণ করে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু লন্ডন। শহরের প্রধান প্রধান ভবন ও স্থাপনাগুলি লোকালয়টির ২০০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু এখনকার লন্ডন অনেক আধুনিক। তাইতী আভিজাত্য আর আধুনিকতার মিশেলে যাদুর শহর এটি। লন্ডনে রয়েছে মোট ৩৩ টি নগর জেলা, যেখানে যাওয়ার জন্য চমৎকার যাতায়ত ব্যবস্থাও রয়েছে।
পৃথিবীর সুন্দরতম বাড়িগুলোর অধিকারী এ শহর। রয়েছে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকসের মতো স্বনামধন্য ইনস্টিটিউশন। পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থা, আবাসন এবং অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধায় পরিপূর্ণ এই শহর, পালটে ফেলেছে জীবনযাপণের সংজ্ঞাকেই। শহরটিতে বাস করা তাই অনেকের কাছেই স্বপ্নের শামিল।
কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক
সেরা শহরের তালিকায় নাম উঠেছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন-এর। আধুনিক আর আয়েশী জীবনযাপণে একটুও কমতি রাখেনি এই পরিকল্পিত শহর । বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে উত্তর ইউরোপের সবচেয়ে ধনী শহর এটি।
একুশ শতক থেকেই সভ্যতা আর সাংস্কৃতিক ব্যপ্তি পেয়েছে এই শহর। ওয়াইন্ড পাওয়ার, বায়োম্যাস ফুয়েল, বর্জ্য ব্যাবস্থাপণাসহ আরো অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নিউট্রাল শহর হবার লক্ষ্যে এগোচ্ছে কোপেনহেগেন।
বাই সাইকেল চালাতে যারা পছন্দ করেন তাদের কাছে এই শহরের চেয়ে প্রিয় আর কিছু হতেই পারে না। পায়ে হাঁটা এবং সাইক্লিং-এর জন্য আলাদা সুনাম রয়েছে কোপেনহেগেনের।
অন্য ভাষায়, কোপেনহেগেন হচ্ছে বিশের অন্যতম পরিবেশ বান্ধব শহর। সপ্তাহে ৩৭ ঘন্টা কাজের সাথে পর্যাপ্ত অবসর , ১ বছরের মাতৃত্বকালীণ ছুটি – চমৎকার এ নীতির জন্য সমগ্র বিশ্বের সুনাম কুড়িয়েছে শহরটি। জীবন আর কাজের পারফেক্ট ব্যালেন্স কীভাবে করতে হয় তার উদাহরণ শান্তির নগরী কোপেনহেগেন।
টোকিও, জাপান
অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত শহর হচ্ছে টোকিও। ২০১৮ সালের সবচেয়ে জনাকীর্ণ মেট্রোপলিটন টোকিও। প্রযুক্তির মুন্সিয়ানায় গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছে শহরটি। ট্রান্সপোর্ট থেকে শুরু করে কনভেনিয়েন্স স্টোর সবকিছুতেই শহরটি তার প্রতিটি নাগরিককে দিয়েছে জীবনযাপণের সব সুযোগ সুবিধা।
প্রতিদিন চার হাজারেরও বেশি ট্রেন টোকিও স্টেশনে যাওয়া আসা করে । বিশাল এই জংশন স্টেশনে জাপানের অন্য যে কোনো স্টেশন থেকে এখানে বেশি ট্রেনের আনাগোনা দেখা যায় ।
মজার বিষয় হল, অন্যান্য দেশের মত বর্জ্যের ভাগাড় পর্যন্ত নেই এখানে, কারণ তারা সবরকম বর্জ্য বিশেষ পদ্ধতিতে রিসাইকেল করে ফেলে! যেগুলো রিসাইকেল করা সম্ভব না সেগুলো খুব সুশৃংখল একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়। তাই দারুণ পরিচ্ছন্ন এই পরিকল্পিত শহর ভ্রমণ, হোক তা পায়ে হেঁটে বা যে কোনো ট্রান্সপোর্ট ব্যাবহার করে, যে কারো কাছে হয়ে উঠবে আনন্দদায়ক।
টোকিওকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহর। এই শহরের যেখানেই থাকেন আপনি, দু পা এগোলেই দেখা মিলবে প্রকৃতির। এমন আরো অনেক কারন রয়েছে যার জন্য পরিকল্পিত নগরায়নের আদর্শ বলা হয় টোকিওকে।
সিঙ্গাপুর সিটি, সিঙ্গাপুর
মাত্র ৪০ থেকে ৫০ বছরের ব্যাবধানে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ থেকে একটি পরিপূর্ণ উন্নত দেশে পরিণত হয়ে সিঙ্গাপুর চমক সৃষ্টি করেছে। যুগোপযোগী পরিকল্পনা এবং উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন বদলে দিয়েছে এই শহরের চালচিত্র। ফোর্বস এর মতে, বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি প্রভাবশালী শহরের মধ্যে একটি হল পরিকল্পিত শহর সিঙ্গাপুর। তাই বসবাসের জন্য সিঙ্গাপুর এখন অনেকের কাছেই এক দারুণ আকর্ষণের নাম। ট্রান্সপোর্ট, স্বাস্থ্যসুবিধা, বিনোদন, আর সবকিছুর সহজলভ্যতার কারনে এশিয়ার বাকি শহরগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা সিঙ্গাপুর। জীবনযাপণ এখানে আধুনিকতার আরেক নাম।
সিঙ্গাপুরের যাতায়াত ব্যবস্থা এতই উন্নত যে এখানে ব্যক্তিগত গাড়ির প্রয়োজন হয় না। নিরাপদ যাতায়তের জন্য রয়েছে বিশেষ ট্রেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, ট্যাক্সি ইত্যাদি। মজার বিষয় হল এখানে রাস্তায় কোন ট্রাফিক পুলিশ পরিকল্পিত বর্জ্যব্যাবস্থাপণার কারনে সব সময়ই পরিচ্ছন্ন এই নগরী। নান্দনিক স্থাপত্য আর কৃত্রিম গ্রিন স্পেস রয়েছে এই শহরে। একই সাথে বহুতল ভবন নির্মাণ করে শহরটি চাপ কমিয়েছে তার জমির উপর। তাই আপনি যদি আধুনিকতার শিখরে থাকা একটি শহরে বসবাস করার কথা ভেবে থাকেন, তাহলে সেই শহরটি হতে পারে সিঙ্গাপুর।
এই ছিল বিশ্বের সেরা পাঁচ পরিকল্পিত শহর । যেখানে শিল্প, সংস্কৃতি আর আধুনিকতা জীবনযাপণে এনেছে বৈচিত্র্য। আর পাঁচটি শহরের একটি বিষয় কিন্তু নির্বিঘ্নে মিলে যাবে । আর তা হল শহরটির সুপরিকল্পনা, যা যুগিয়েছে সর্বাধুনিক জীবনযাণের সকল চাহিদা।
তো, শীর্ষে থাকা শহরগুলো নিয়ে আপনি কী ভাবছেন? জানিয়ে দিন কমেন্ট বক্সে। কারণ আমরা আছি আপনার উত্তরের অপেক্ষায়।