Reading Time: 4 minutes

প্রতিবছর জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত হয় বিশ্ব শহর দিবস। এ দিবসটি সাধারণত নগরায়নের ‘সফলতার দিক বা উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ’ কে ঘিরে আবর্তিত হয়। এ বছর বিশ্বব্যাপী ৩১ অক্টোবর ‘যত্নে থাকুক কমিউনিটি ও শহর’ মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালিত হবে। বিশ্ব শহর দিবসের এবারের উদ্দেশ্য এমন একটি টেকসই নগরায়নের পরিকল্পনা তৈরি করা যা এই মহামারীর সময়ের জন্য উপযোগী হবে। ২০২০ সালে এ দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো কীভাবে মেগাসিটিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভূত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং এ সম্পর্কে করণীয় কী।  

‘যত্নে থাকুক কমিউনিটি ও শহর’ থিমের অর্থ আসলে কী?   

ফানুস প্রজ্জ্বলন
কমিউনিটি এনগেজমেন্ট সামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে

বৈশ্বিক কমিউনিটিকে নগরায়নের ক্ষতিকর দিকগুলো হ্রাস করতে উৎসাহিত করা এবারের বিশ্ব শহর দিবস এর অন্যতম লক্ষ্য। বিভিন্ন জাতিকে একত্রে বৈশ্বিক নগরায়নের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কাজ করতে উদ্‌বুদ্ধ করাও এর অংশ। এ থিমের মাধ্যমে জাতিসংঘ সারা বিশ্বের কমিউনিটি ও শহরে টেকসই উন্নয়নের ধারা শুরু করতে চায়, যা সমস্ত পৃথিবীর জন্যই এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।গত এক বছরে নগর জীবনে এসেছে বড় রকমের পরিবর্তন। মহামারীর প্রভাব শুধু শহরবাসীর জনস্বাস্থ্যেই পড়েছে তা তো নয়, এটি তাদের জীবনের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রকে ও জীবনধারাকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। 

টেকসই নগরায়ন ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব   

পরিকল্পিত নগরায়ন
পরিকল্পিত নগরায়ন টেকসই উন্নয়নের জন্য ভীষণ জরুরি

নগরায়নকে উন্নয়ন ও উন্নত জীবনের প্রতিশব্দই মনে করা হয়। আর উন্নয়ন বা উন্নত জীবনের এক বড় অংশ দারিদ্র দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। অথচ নগরের উন্নয়নের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠীর কথা বলবার সময় আমরা প্রায়ই নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবীদের কথা ভুলে যাই।   

প্রায় সব দেশের সরকারই জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর অবদান যে শহুরে জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। বিশেষত মহামারী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তাদের অংশগ্রহণ যে খুবই জরুরি তা স্পষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ নগরায়ন পরিকল্পনায় নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর আলোকপাত না করাটা যে বড় ধরনের ভুল তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক এই মহামারী। নগরায়নের অর্থনৈতিক ভিত্তি শুধু আন্তর্জাতিক বাজার ও জাতীয় বাজারের প্রবৃদ্ধি নয়; স্থানীয় পর্যায়ের সকল জনগোষ্ঠীর অবদানই স্থানীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়নের চাকা সচল রাখে। তাই টেকসই নগরায়নের অর্থনৈতিক প্রভাব বিষয়টি বিশ্ব শহর দিবস এর অন্যতম আলোচ্য। 

টেকসই নগরায়নের প্রাকৃতিক প্রভাব ও কমিউনিটির মাধ্যমে ‘সবুজ নগরায়ন’ প্রতিস্থাপন 

নগরের পরিবেশ রক্ষায়, জলবায়ু সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নগরবাসী বা কমিউনিটির গৃহীত পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে জরুরি ভূমিকা রাখে। এ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে কমিউনিটি গার্ডেনিং, সবুজায়ন প্রকল্প, নদী পরিষ্কারকরণ, পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার অন্যতম। এ পদক্ষেপগুলো কমিউনিটি পর্যায় থেকে শুরু হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিবর্তন আনতে পারে। “পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক পদক্ষেপ” এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট বা মহামারীর চ্যালেঞ্জগুলো আরো একটু স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। আর এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত করতে প্রয়োজন কমিউনিটি সংক্রান্ত জ্ঞান,সক্ষমতা ও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ।  বিশ্ব শহর দিবস এর এবারের প্রতিপাদ্যে তাই কমিউনিটি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। 

কমিউনিটি এনগেঞ্জমেন্ট ও নগরের সামাজিক মূল্যবোধ 

কমিউনিটির জন্য নির্দিষ্ট ভূমিকা তৈরি এবং বৈশ্বিক সক্ষমতা বাড়াতে কমিউনিটি রিমডেল বা ঢেলে সাজানোর ওপরও গুরুত্ব আরোপ করছে বিশ্ব শহর দিবস ২০২০। তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটির ছোট ছোট ভূমিকাও বৃহত্তর ক্ষেত্রে অর্থাৎ জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় প্রভাব ফেলে। আবার বৃহত্তর ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে; যেমন নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগের সময় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সুবিধা-অসুবিধা ও অংশগ্রহণের ব্যাপারটিও ভেবে দেখা জরুরি। তাই পরিবর্তন আনার আগে অবশ্যই প্রয়োজন ধাপে ধাপে পরিকল্পনা করা এবং ধারাবাহিক ভাবে তা বাস্তবায়ন করা।  

তাহলেই সে পরিবর্তনগুলো সত্যিকার অর্থে টেকসই হবে। মনে রাখতে হবে যে, কমিউনিটি এনগেঞ্জমেন্ট একটি ধারাবাহিক ও পুনরাবৃত্তিক প্রক্রিয়া যার মূল চালিকাশক্তি আইন ও নীতিমালা। সঠিক পদ্ধতিতে কমিউনিটি এনগেঞ্জমেন্ট করতে পারলে তা উদ্ভাবন ও সমাধানের ক্ষেত্রে সবার সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। 

সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে এর সমাধান 

উদ্ভাবনের কথা বললেই মাথায় আসে কল্পবিজ্ঞানের সেই ভবিষ্যতের পৃথিবী! কিন্তু বিশ্বের অনেক শহরই এখন ধীরে ধীরে সেই ভবিষ্যতের পৃথিবীর দিকেই এগোচ্ছে। পড়ে থাকা জায়গাগুলো এসব শহরে বিভিন্ন সৃজনশীল উপায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে উচ্চমানের গবেষণাগার, কোনো কোনোটি হয়ে উঠেছে কোল্যাবরেটিভ ওয়ার্কস্পেস। অর্থাৎ উদ্ভাবনের একরকম কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠছে এ জায়গাগুলো। তাই এ কথা বলাই যায় যে, নগরের সফলতার পেছনে বৈশ্বিক ট্রেন্ড সম্পর্কে দূরদর্শী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই আমরা বলতে পারি যে একটি শহরের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করে বিশ্বে ভবিষ্যতে কী ধরণের পরিবর্তন আসবে তা অনুমান করে সে সম্পর্কিত পদক্ষেপ নেবার উপরে। সেই অনুমান অনেকক্ষেত্রেই ফলপ্রসূ এবং বাস্তবসম্মত হবে যদি আমরা বৈশ্বিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাসঙ্গিক স্থানীয় সমাধানকে আধুনিক উদ্ভাবনের সাথে মিলিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করতে পারি। বিশ্ব নগর দিবস ২০২০ এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ই হল ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে নতুন নতুন ধারণা ও চিন্তাধারার উদ্ভাবন। এ জন্য দেশ বা জাতি হিসেবে নয় বরং বিশ্বের সকলকে এক ছাতার নিচে এসে সুস্থায়ী ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে একসাথে কাজ করতে হবে। 

রেলগাড়ির ছাদে মানুষের ভিড়
সঠিক উদ্ভাবন ও এর দ্রুত বাস্তবায়ন নগর জীবনের ভোগান্তি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে

এসব স্থানীয় পর্যায়ের উদ্ভাবনী ধারণা আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত নগর-কেন্দ্রিক উদ্ভাবন এবং টেকসই সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে। যা ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সমাধান এবং ভবিষ্যতের নীতি প্রণয়নে রাখবে সহায়ক ভূমিকা। যে সমাজ শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট, সম্মানিত বা উত্সাহিত করতে পারবে, ভবিষ্যত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তারাই হবে পথপ্রদর্শক।

কমিউনিটি নির্মাণ, মহামারীর বিরুদ্ধে এক হয়ে রুখে দাঁড়ানো এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মত বিষয়গুলোর দিকে আলোকপাত করতে চায় বিশ্ব নগর দিবস ২০২০ । এমন একটি দিবসকে যথাযথভাবে পালন করার মাধ্যমে আমরা একটি উজ্জ্বল, উদ্ভাবনী ভবিষ্যত নির্মাণের দিকে একধাপ এগিয়ে যেতে পারি।

Write A Comment