Reading Time: 3 minutes

দেশের খুব কম মসজিদেই পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা আছে। তাই বাংলাদেশের আর দশজন মেয়ের মতনই মেরিনা  তাবাসসুমও হয়ত মসজিদের ভেতরটা দেখার সুযোগ পাননি খুব বেশি। অথচ তিনি যখন ২০০৫ সালে দায়িত্ব পেলেন একটি মসজিদের নকশা করার, তিনি যে শুধু তা লুফে নিলেন তাই নয়, বরং এতটাই সফলভাবে তা করলেন যে তাঁর এই কাজ পেল “দি আগা খান অ্যাওয়ার্ডের” মত সম্মানজনক পুরষ্কার। এই গুণী স্থপতির নাম মেরিনা তাবাসসুম । বাইতুর-রওফ জামে মসজিদ ছাড়াও তিনি নকশা করেছেন স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের মত বিখ্যাত সব স্থাপনার।  

স্বাধীনতা জাদুঘর

স্বাধীনতা জাদুঘর
স্বাধীনতা জাদুঘর

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে থাকা স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং স্বাধীনতা জাদুঘর বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পের একটি অন্যতম নিদর্শন। সম্পূর্ণ মাটির নিচে থাকা এই জাদুঘরটি দেশের আর দশটি স্থাপনা থেকে ব্যতিক্রম। হবেই বা না কেন, এর ডিজাইনের সাথেও যে ছিলেন মেরিনা তাবাসসুম , যার পুরো গল্পটাই অন্যরকম! আমাদের দেশের স্থাপত্যশিল্পের শীর্ষপর্যায়ের প্রায় সবাই পুরুষ। কিন্তু এর মাঝেও এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম তিনি। ১৯৯৭ সালে একটি জাতীয় পর্যায়ের ডিজাইন প্রতিযোগিতা জিতে তিনি এবং স্থাপত্যবিদ কাশেফ মাহবুব চৌধুরী এই বৃহৎ প্রকল্পের দায়িত্ব পান। আর তাঁরা এই স্বাধীনতা জাদুঘরটির ডিজাইন করেন একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিষয়ের সাথে সাথে পুরো নকশাটির প্রধান আকর্ষণ হল একটি সুউচ্চ আলোক স্তম্ভ, যা স্বাধীনতা স্তম্ভ নামে অধিক পরিচিত। সম্পূর্ণ স্তম্ভটিই কাচের প্যানেল নির্মিত। আর আমাদের স্বাধীনতা জাদুঘরটি ঠিক এই স্তম্ভের নিচেই। পুরো জাদুঘরটি মাটির নিচে হওয়ায় এতে যোগ হয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। এটিই বাংলাদেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ভূগর্ভস্থ জাদুঘর। নিঃসন্দেহে এটি মেরিনা তাবাসসুমের একটি অনবদ্য সৃষ্টি।

বাইতুর রউফ জামে মসজিদ

বাইতুর রউফ মসজিদ
বাইতুর রউফ মসজিদে নামাজরত মুসুল্লিগণ

ঢাকা মসজিদের শহর নামে পরিচিত। শুধু ঢাকাই নয় বরং সমগ্র দেশজুড়েই আছে অসংখ্য মসজিদ। কিন্তু উত্তরা আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে গিয়ে রেললাইন পেরিয়ে রাজধানীর দক্ষিণখান থানার ফায়েদাবাদে গিয়ে আপনি যে মসজিদটির দেখা পাবেন তা কোনভাবেই আর দশটা মসজিদের মতন নয়। আর এটি মেরিনা তাবাসসুমের আরেকটি অনন্য সৃষ্টি, বায়তুর রউফ মসজিদ।
মসজিদ বললেই আমাদের মাথায় আসে ডোম, মিনার বা গম্বুজের কথা। কিন্তু এই মসজিদে নেই তাঁর কিছুই। চারদিকে আটটি পিলারের ওপর তৈরি হয়েছে এটি। এর বিশেষত্ব হলো, কিবলার দিকে ১৩ ডিগ্রি কোনাকুনি করা একটি থাম। আর বায়ু চলাচলব্যবস্থা ও আলোর চমৎকার বিচ্ছুরণ মসজিদের পরিবেশকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। ৭৫৪ বর্গমিটারের এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে সুলতানি আমলের মসজিদের অনুপ্রেরণায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিষয়গুলো এত চমৎকারভাবে কাজে লাগানো হয়েছে স্থাপত্যশিল্পে যে শীত বা গরমে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের কিছুই বোঝা যায় না মসজিদের ভেতর থেকে।

এবং দি আগা খান অ্যাওয়ার্ড

বাইতুর রউফ মসজিদ
এই বাইতুর রউফ মসজিদের জন্যই মেরিনা তাবাসসুম পান আগা খান স্থাপত্য পুরষ্কার

আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার। স্থাপত্যের দুনিয়ায় এ পুরস্কারের স্থান অনেক উপরে। এ পুরষ্কার পেতে হলে তুমুল প্রতিযোগিতা তো আছেই, সাথে সাথে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে তিন বছর। স্থপতিদের উদ্ভাবনী ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (একেডিএন) এই পুরষ্কার দেয় তিন বছরে একবার। এই পুরস্কারের জন্য স্থাপত্য ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব, পরিকল্পনা, ঐতিহাসিক সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের তিনটি স্থাপনা, যথাক্রমে জাতীয় সংসদ ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রকল্প ও রুদ্রপুর স্কুল আগে এই সম্মানজনক পুরষ্কার পেলেও এগুলোর স্থপতিরা সবাই ছিলেন ভিনদেশী। বাংলাদেশে থেকে এ ধরনের পুরস্কারে মনোনয়ন পাওয়াও যেখানে গর্বের বিষয় সেখানে ২০১৬ সালে বাইতুর রউফ জামে মসজিদের জন্য মেরিনা তাবাসসুম আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হন!

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যশনাল লেবার অর্গানাইজেশন বা আইএলও-এর ২০১৮ সালের এক রিপোর্ট অনুসারে ২০০৮ থেকে ২০১৭ এই দশ বছরের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। নিঃসন্দেহে ভাল খবর। কিন্তু, যদি প্রশ্ন করা যায় রিয়েল এস্টেট তথা আবাসন খাতে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার কত? স্বাভাবিকভাবেই তা খুবই কম। আর এ ক্ষেত্রেই একজন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হলেন মেরিনা তাবাসসুম ।
আই এ বি বা ইন্সটিউট অফ আর্কিটেক্টস ইন বাংলাদেশের ২০১৬ সালের এক সমীক্ষা মতে, দেশের শতকরা ৭৬.৫ ভাগ পুরুষ স্থপতির বিপরীতে নারী স্থপতি হাতে গোনা, মাত্র ২৩.৫ ভাগ। এখানেই মেরিনা তাবাসসুমের ভূমিকা অতুলনীয়। বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পে তাঁর দেখানো পথেই হয়ত হাঁটতে শুরু করবেন আরও অনেকে। 

Write A Comment