Reading Time: 5 minutes

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহারের প্রবণতা বেশ বেড়েছে। উন্নত জীবনযাত্রার চাহিদা আর সাধ্যের মধ্যে দাম- দুটোই এর পেছনে বড় কারণ। তবে এয়ার কন্ডিশনার কেনার আগে কয়েকটি ব্যাপার জানা কিন্তু খুবই জরুরি! প্রথমেই আপনার ঘরের জন্য মানানসই এয়ার কন্ডিশনার বেছে নিতে হলে বিভিন্ন রকম এয়ারকন্ডিশনারের বিভিন্ন কার্যক্ষমতার দিকটি মাথায় রাখতে হবে। এরপর খেয়াল রাখতে হবে এর দাম ও রক্ষণাবেক্ষণের খুঁটিনাটির দিকেও। এয়ার কন্ডিশনার সম্পর্কে এসব জরুরি তথ্য যাতে আপনার জানা থাকে তা নিশ্চিত করতেই আমাদের আজকের ব্লগ। বিভিন্ন রকম এয়ার কন্ডিশনারের বিস্তারিত এবং রক্ষণাবেক্ষণের উপায় গুলো জানা থাকলে একদিকে কেনার আগে সিদ্ধান্ত নেয়া যেমন সহজ হবে, তেমনি কেনার পরে আপনার এয়ার কন্ডিশনারটিও থাকবে যত্নে। 

এয়ার কন্ডিশনারের প্রকারভেদ 

এয়ার কন্ডিশনারের বিস্তারিত এবং রক্ষণাবেক্ষণের উপায় জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে এর প্রকারভেদ গুলো। এয়ার কন্ডিশনার সাধারণত দু’রকমের হয়। একটি হলো মনোব্লক, আর আরেকটির নাম স্প্লিট সিস্টেমস। মনোব্লক এয়ার কন্ডিশনারে ইউনিটটি এক ব্লকের হয়। উইনডো এসি ও পোর্টেবল এসি মনোব্লকের অন্তর্ভুক্ত। আর স্প্লিট সিস্টেমস এয়ার কন্ডিশনারের ইউনিট হয় দুই ব্লক বিশিষ্ট। এর ইনডোর ইউনিটটি শীতল বাতাসের উৎস আর আউটডোর ইউনিটের কাজ হলো বাতাস ঠান্ডা করা ও রিসাইকেল করা। বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ৪ ধরনের এয়ার কন্ডিশনারের বিস্তারিত জানতে পারবেন ব্লগের পরবর্তী অংশে। 

পোর্টেবল এয়ার কন্ডিশনার (মনোব্লক) 

portable ac
এগুলো ইনস্টল করতে কোনো অতিরিক্ত জিনিসের প্রয়োজন হয় না এবং দামেও ভীষণ সাশ্রয়ী

পোর্টেবল এয়ার কন্ডিশনার লাগাবার জন্য আলাদা কোনো মাউন্টিং বা কাঠামোর প্রয়োজন পড়ে না। এর সাথে এক ধরনের ফ্লেক্সিবল এক্সহস্ট পাইপ থাকে যা জানালা বা দেয়ালে ছিদ্র করে ঘরের বাইরের দিকে নিতে হয়; কেননা এই এসিগুলো চলার সময় এ থেকে গরম ধোঁয়া নির্গত হয়। পোর্টেবল এয়ার কন্ডিশনারের সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। এর কম্প্রেসরটি আলাদা ইউনিটে থাকে না, বরং এসির ভেতরেই থাকে। ফলে এসি চালালে বিকট শব্দ হয়। এছাড়া কম্প্রেসরের সাইজ ছোট বলে কার্যক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা আছে। 

এ ধরনের এসির সুবিধা হলো যে, এগুলো ইনস্টল করতে কোনো অতিরিক্ত জিনিসের প্রয়োজন হয় না এবং দামেও ভীষণ সাশ্রয়ী। তাছাড়া বেশ এনার্জি এফিসিয়েন্ট হওয়ায় এবং পোর্টেবল অর্থাৎ সহজে বহনের সুবিধা থাকায়, এগুলো অনেকের জন্যই দারুণ কার্যকরী। যেমন আপনার শিশুর রুমে পোর্টেবল এয়ার কন্ডিশনার থাকলে তা ঘরের নির্দিষ্ট অংশ ঠান্ডা করতে একদম উপযোগী হবে। 

উইন্ডো এয়ার কন্ডিশনার (মনোব্লক)

Wall mounted air conditioner
তবে এর সাশ্রয়ী দাম এবং সহজে ইনস্টল করার সুবিধাটিও ভুলে গেলে চলবে না

অনেকে উইন্ডো এয়ার কন্ডিশনারকে বলে ‘দেয়ালভেদী এয়ার কন্ডিশনার’। স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনার আসার আগে সারা বিশ্বে এবং আমাদের দেশের অ্যাপার্টমেন্ট, বাসা-বাড়ি, অফিসের কেবিনে এধরনের এসিই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিলো। ভূমধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখনো উইন্ডো এয়ার কন্ডিশনার বহুল প্রচলিত।  

সাধারণ উইন্ডো এয়ার কন্ডিশনার থেকে শুধু শীতল বাতাসই পাওয়া যায়। কিন্তু দামিউইন্ডো এয়ার কন্ডিশনারগুলোতে হিট পাম্প মোড ও রিমোট কন্ট্রোলও পাওয়া যায়। পোর্টেবল এয়ার কন্ডিশনারের মতো এটিও চলার সময় শব্দ করে। এছাড়া অন্যান্য এসির তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ শক্তি খরচ হয় এতে এবং জানালায় বা দেয়ালে ইনস্টল করার সময় আলাদা মাউন্টিং বা প্ল্যাটফর্মেরও প্রয়োজন হয়। তবে এর সাশ্রয়ী দাম এবং সহজে ইনস্টল করার সুবিধাটিও ভুলে গেলে চলবে না।  

ওয়াল মাউন্টেড এয়ার কন্ডিশনার (স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনিং)

Split air conditioner
স্টাইল, কার্যক্ষমতা ও কার্যকারিতায়ও এ এসির বিভিন্ন ধরন বাজারে পাওয়া যায়

ওয়াল মাউন্টেড এয়ার কন্ডিশনার বাংলাদেশে ব্যবহৃত স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। স্টাইল, কার্যক্ষমতা ও কার্যকারিতায়ও এ এসির বিভিন্ন ধরন বাজারে পাওয়া যায়। তবে এর ইন্সটলেশনের ধরন হলো ইঞ্জিনিয়ার ফিট, অর্থাৎ চটজলদি নিজের মতো লাগিয়ে নেয়ার সুবিধা এতে নেই। ইন্সটলেশন প্রসেস বেশ জটিলও বটে!  তবে সুবিধা হলো যে, ইন্সটলেশন বেশ নিখুঁত হয়। সাধারণত ঘরের উঁচু স্থানে ওয়াল মাউন্টেড এয়ার কন্ডিশনার লাগানো হয় এবং হিট পাম্প, টাইমার, রিমোট কন্ট্রোল, এয়ার পিউরিফিকেশনের মতো বেশ কিছু অপারেটিং মোড ও  ফিচার রয়েছে এতে। এছাড়া অন্যান্য এসির তুলনায় এতে কম বিদ্যুৎ শক্তি খরচ হয়। 

সিলিং ক্যাসেট বা সিলিং সাসপেন্ডেড এয়ার কন্ডিশনার (স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনিং)

Ceiling cassette
এগুলো দেখতে আধুনিক আর জানালা বা মেঝে ভেদ করে ইনস্টল করার প্রয়োজন হয় না

বাড়ির বড় স্পেসে বা কমার্শিয়াল স্পেসের জন্য সিলিং ক্যাসেট বা সিলিং সাসপেন্ডেড এয়ার কন্ডিশনার উপযুক্ত। সিলিংয়ে লাগানো বা ঝুলে থাকা এধরনের এসি সাধারণত বিল্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে আসা এয়ার পাইপে সংযুক্ত থাকে। নান্দনিক সৌন্দর্য ও কার্যক্ষমতা- দুটোই এতে পাবেন আপনি। কারণ এগুলো দেখতে আধুনিক আর জানালা বা মেঝে ভেদ করে ইনস্টল করার প্রয়োজন হয় না। বাইরে থেকে শুধু এর ৪টি আউটলেট ল্যুভারসই দেখা যায়। যেহেতু এটি উচ্চ কার্যক্ষমতা সম্পন্ন তাই একটি সিলিং সাসপেন্ডেড এয়ার কন্ডিশনার ৩-৪টি ওয়াল মাউন্টেড ইউনিটের সমান কাজ করতে পারে। তবে বেশি বিদ্যুৎও খরচ হয় এতে। 

এয়ার কন্ডিশনারের বিস্তারিত এবং রক্ষণাবেক্ষণের উপায় জানতে হলে আরো একটি বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। এসি মনোব্লক হোক কিংবা স্প্লিট সিস্টেম, এগুলোর কোনো কোনোটিতে থাকে ইনভার্টার প্রযুক্তি, কোনোটিতে আবার তা অনুপস্থিত। ইনভার্টার সম্বলিত এসি কম্প্রেসরের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ফলে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস ফ্লো রেটও থাকে নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ এগুলো কম বিদ্যুৎ শক্তি খরচ করে। তাই যারা এনার্জি এফিশিয়েন্ট এয়ার কন্ডিশনার খুঁজছেন,  তাদের জন্য ইনভার্টার প্রযুক্তি সহ এসি কেনাই সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। 

খরচ 

বাজারে বিভিন্ন দামের এয়ার কন্ডিশনার পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সাধারণত এসির ধারণ ক্ষমতা বি টি ইউ এর পরিবর্তে টন দিয়ে মাপা হয়। যত বেশি টনের এসি কিনবেন, দাম ততই বেশি হবে। যেমন, এক টন বা ১২০০০ বি টি ইউ পার আওয়ারের এসি পাবেন ৩০,০০০ বা এর চেয়ে কমমূল্যে। [রেফ:০১]. ইনভার্টার প্রযুক্তির এসির দাম আবার বেশি হয়। পোর্টেবল এসির দাম বাজারের অন্যান্য এসির তুলনায় কম, তবে ক্যাসেট বা সাসপেন্ডেড এসির দাম সবচেয়ে বেশি হয় এর উচ্চ কার্যক্ষমতার কারণে। 

এয়ার কন্ডিশনারের ধারণ ক্ষমতা 

এয়ার কন্ডিশনারের বিস্তারিত এবং রক্ষণাবেক্ষণের উপায়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক এর ধারণ ক্ষমতার বিষয়টি। রুম যত বড় হয় এয়ার কন্ডিশনারের ধারণ ক্ষমতা তত বেশিই হওয়ার কথা। তবে পৃথিবীর কোন অংশে আপনি থাকেন, সেখানকার আবহাওয়া-জলবায়ুও এখানে জরুরি বিষয়। যেমন বাংলাদেশের মতো আবহাওয়ায় ১১০ স্কয়ার ফিট স্পেসে ১ টন বা ১২,০০০ বি টি ইউ পার আওয়ারের এসি উপযুক্ত। তবে সঠিক ধারণা পেতে এরিয়া মেথড ব্যবহার করে হিসেবও করে নিতে পারেন আপনি।  

এরিয়া মেথড:  

প্রথমে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মেপে স্পেসের  স্কয়ার ফুট কত সেটি বের করুন। এরপর এর বর্গমূলকে ১০ দিয়ে ভাগ করুন। ভাগফলই বলবে আপনার ঘরের জন্য উপযুক্ত এসি কত টনের হতে হবে। [রেফঃ০২]

যেমন:

ঘরটি যদি ১০ ফিট প্রস্থ ও ১৫ ফিট দৈর্ঘ্যের হয়, এটি আসলে ১৫০ স্কয়ার ফিটের ঘর। আর এখানে আপনার প্রয়োজন প্রায় ১.২টনের এসি।

[সতর্কতাঃ

১। এই হিসাবের পদ্ধতিটি আপনাকে অনুমান করতে সহায়তা করবে। তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়াই উত্তম। 

২। ঘরে কী কী জিনিস আছে এর ওপরও এসির ধারণ ক্ষমতা নির্ভরশীল। অর্থাৎ ফাঁকা ঘর যে এসিতে দ্রুত ঠান্ডা হবে, জিনিসপত্রে ভর্তি ঘর কিন্তু ঐ একই এসিতে এত দ্রুত ঠান্ডা হবে না।]

এয়ার কন্ডিশনারের যত্ন নিবেন যেভাবে 

অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা এড়াতে চাইলে এয়ার কন্ডিশনারের যত্ন নেয়ার উপায়গুলো জানতেই হবে। এছাড়া এসি মেরামতের খরচ বাঁচাতে এবং দীর্ঘদিন ভালো সার্ভিস পেতে হলেও এ ব্যাপারে নজর দেয়া উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বছরে একবার এসির সার্ভিসিং করাতে হবে। এছাড়া এসি ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা সেটির জন্য নিয়মিত ‘চেক আপ’ তো অবশ্যই প্রয়োজনীয়। আর এটি করার কিছু উপায় এমন যে তা ডি আই ওয়াই পদ্ধতিতে অর্থাৎ নিজেই করে ফেলা যায়। যেমন, এসির ইউনিটের ফিল্টার স্লটটি কোথায় সেটি খুঁজে বের করুন। এরপর পুরোনো ফিল্টারটি বের করে নিয়ে সেখানে নতুন ফিল্টারটি দিয়ে দিন বা পুরোনোটিই পরিষ্কার করে পুনরায় ব্যবহার করুন। এর জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র বাতাস প্রবাহের দিক, ফিল্টারের সঠিক দিক ইত্যাদির দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। আর ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়াল দেখে তো ফিল্টারের সাইজ ও খুঁটিনাটি জেনে নেয়াও সহজ। 

তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রফেশনাল সার্ভিস আপনাকে নিতেই হবে। যেমন এসি থেকে আসা অদ্ভূত শব্দ কিংবা হঠাৎ শীতল বাতাস প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো কিছু হলে, প্রফেশনাল কাউকে ডাকাই শ্রেয়। এসির ঠিকঠাক যত্নের জন্য অপ্রত্যাশিত যেকোনো কিছু দেখলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ কথা কে না জানে যে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম! 

আপনি যখন প্রথম বারের মতো এয়ার কন্ডিশনার কিনবেন তখন এয়ার কন্ডিশনারের বিস্তারিত এবং রক্ষণাবেক্ষণের উপায়গুলো মাথায় রাখা সত্যিই খুব দরকারি। কারণ এটি আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ও খরচও বাঁচায়। সে কথা মাথায় রেখেই আজকের ব্লগের প্রতিপাদ্য এয়ার কন্ডিশনারের বিস্তারিত এবং রক্ষণাবেক্ষণের উপায়। আশা করছি এটি আনার জন্য সহায়ক হবে। কমেন্টস বক্সে এ সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে ভুলবেন না। 

রেফ ০১ঃ https://www.daraz.com.bd/catalog/?from=input&q=ac&sort=priceasc&ppath=40052:193061

রেফ ০২ঃ  https://www.blueleavesdesign.co.in/post/how-to-calculate-the-perfect-ac-size

Write A Comment